হেফাজতে থাকাকালীন এক অভিযুক্ত নাকি পুলিশের বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে গুলি চালাচ্ছে পুলিশেরদিকেই। পুলিশের বক্তব্য খুবই সরল, আত্মরক্ষার অধিকার সকলেরই রয়েছে— পুলিশেরও। অতএব পাল্টা ওই অভিযুক্তকে নিশানা... নিমেষে লাশ ওই বন্দি। মহারাষ্ট্রের বদলাপুরের ঘটনার নির্যাস এমনটাই।
অগস্ট মাসে বদলাপুরের একটি স্কুলে দুই ও চার বছরের দুই শিশুকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ ঘিরে আলোড়িত হয় মহারাষ্ট্র। গত ১৭ অগস্ট গ্রেফতার করা হয় অভিযুক্ত অক্ষয় শিন্দেকে। সে ছিল ওই স্কুলের সাফাইকর্মী। তার পরে? ওই অভিযুক্তই দোষী কি না, তদন্তের মাধ্যমে তা সামনে আনতে হত পুলিশকে। তার পরিবর্তে হল এনকাউন্টার। আত্মপক্ষ সমর্থনে পুলিশের তরফে বাঁচার অধিকারের কথা তুলে ধরা হলেও প্রশ্ন ওঠে হেফাজতে থাকাকালীন ওই বন্দি কী ভাবে পুলিশের বন্দুকের নাগাল পেল? তার দায় কার? সে সবউত্তর অধরা।
বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার অজুহাতে বিচারহীন ভাবেই সমাজমাধ্যমে খাপ পঞ্চায়েত বসিয়ে যদি এনকাউন্টারের নিদান দেওয়া হয়, তাতে আত্মতৃপ্তি থাকতে পারে, থাকে না ন্যায়বিচারের গরিমা। বিচারের বাণী সে ক্ষেত্রে সত্যিই নীরবে নিভৃতে কাঁদে। যেমনটা হল বদলাপুরে।
তদন্ত এখনও ঢের বাকি। ওই স্কুলে শিশু নিগ্রহে কোনও প্রভাবশালী জড়িত কি না, তা-ও খোলসা হয়নি। তার আগেই অভিযুক্তের নিকাশে মামলার রফাদফা। শিকড়ে পৌঁছনোর আগেই সমস্ত যোগসূত্র কেটে দেওয়া হল। এ বার হয়তো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে শুরু হবে আর এক বিচার। কিন্তু শিশু নিগ্রহের বিষয়টি কি আর আগের মতো প্রাসঙ্গিক থাকল? অভিযুক্ত যদি এখনও অধরা থাকে, ভবিষ্যতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না, কে বলতে পারে! সম্প্রতি একই ভাবে এক সন্দেহভাজন মদ মাফিয়াকে এনকাউন্টার করেছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের এসটিএফ। অভিযোগ, ওই সন্দেহভাজন দু’জন আরপিএফ কনস্টেবলকে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল। তার পরেই সেই চেনা প্লট— এনকাউন্টার!
ঠিক একই মডেলে বছর পাঁচেক আগে হায়দরাবাদেও ২৬ বছরের এক পশুচিকিৎসককে গণধর্ষণ ও খুনে অভিযুক্তদের নিকাশ করে দিয়েছিল রাষ্ট্রশক্তির প্রতিমূর্তি পুলিশ। ঘটনার পুনর্নির্মাণের জন্য ভোরবেলা অপরাধস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অভিযুক্তদের। এর পরে সেই চিরাচরিত প্লট। পুলিশের ভাষ্য, অভিযুক্তেরা পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করেই গুলি চালিয়েছিল। চেষ্টা করেছিল পালিয়ে যেতে। প্রত্যাঘাতে বাধ্যহয় পুলিশ। বিভ্রম জাগে, হায়দরাবাদ না কি বদলাপুর? দ্রুত হেস্তনেস্তর চোরাগলিতে হারিয়ে যায় ন্যায় বিচার।
বদলাপুরের ঘটনায় গভীর চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছেন অভিযুক্তের বাবা-মা। পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, মালয়ালম সিনেমা জনগণমন। সেখানে দেখানো হয়েছে, কী ভাবে ভুয়ো সংঘর্ষের মাধ্যমে নিকাশ করে দেওয়া হচ্ছে এক মহিলা অধ্যাপককে খুনে অভিযুক্তদের। শেষ পর্যন্ত আদালত কক্ষেই খোলসা হয়, প্রকৃত অপরাধী কে বা কারা। বাস্তবে ট্রিগার-মত্ত পুলিশের এনকাউন্টারের পিছনেও কোনও কিছু ধামাচাপা দেওয়ার কৌশল নেই তো? তদন্ত এবং বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে যা প্রকাশ্যে আসার সম্ভাবনা ছিল, তা কি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল না?
এই এনকাউন্টারের পিছনেও কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তুতন্ত্র কাজ করে। কোনও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে জনমানসে ক্ষোভের পারদ তুঙ্গে পৌঁছলে তাঁকে নিকাশ করে দেওয়ার মধ্যে বাহবা কুড়িয়ে নেওয়ার কৌশল কাজ করে। ঠিক যে ভাবে বদলাপুরের এনকাউন্টারের পরে বহু জায়গায় উল্লাস চলেছে। আর জি কর কাণ্ডের পরেও তো এনকাউন্টারের নিদান দেওয়া হয়েছিল। আসলে কোনও অন্যায়কে কেন্দ্র করে ঘুণ ধরে যাওয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপরে মানুষের ক্ষোভের পারদ চড়তে থাকে। সেই অসন্তোষই কাজে লাগাতে চান রাজনেতাদের একাংশ। আর তার সহজতম পন্থা আইন হাতে তুলে নেওয়ার কৌশল। ঠিক যে ভাবে উত্তরপ্রদেশে ‘বুলডোজ়ার নীতি’ হাততালি কুড়িয়েছে কিন্তু গণতন্ত্রকে করেছে কালিমালিপ্ত।
পাল্টা সরব হলে অনেকেরই অভিযোগ, এ দেশে অভিযুক্তের মানবাধিকার রয়েছে কিন্তু নির্যাতিতার নেই। আসলে নির্যাতিতার ন্যায়বিচারের স্বার্থেই উপযুক্ত তদন্ত এবং বিচার প্রয়োজন। নির্যাতনের পিছনে কোনও গোপন উদ্দেশ্য কিংবা প্রভাবশালী সংযোগ রয়েছে কি না, তা যাচাই করা খুব দরকার। সে কারণেই ন্যায্য তদন্ত ও আইনি পরিসর প্রয়োজন। রাস্তা লম্বা হোক কিন্তু ন্যায়ের পরশটুকু যেন থাকে। অপরাধী সাজা পাক আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে।
তার পরিবর্তে ‘ইনস্ট্যান্ট জাস্টিস’-এর পথে হাঁটলে কিন্তু পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ। তার মাসুল দিতে হতে পারে আমজনতাকেই। এমনিতেই দেশে গণতান্ত্রিক পরিসর ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। বিরোধিতা করলেই দেগে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ। কঠিন ধারায় মামলা করা হচ্ছে। এক বার ভাবুন, সেই মামলার নাগপাশ কেটে বেরোনোর আগেই যদি এনকাউন্টারের দাওয়াত সাজানো হয়? জনপরিসরে কিন্তু প্রতিটি ‘ভুয়ো সংঘর্ষ’-এর কারণ সুচারু ভাবে উপস্থাপন করা হয়। আমজনতা মনে করবেন, ‘ঠিকই তো এদের সোজা গুলি করে খুলি উড়িয়ে দিক।’ আর সেই জাঁতাকলে হয়তো কোনও এক দিন থেমে যাবে কোনও নিরপরাধীর শ্বাস। যিনি আমাদেরই সহনাগরিক, আত্মীয়।
মনে রাখা উচিত, এ দেশে আজমল কসাবেরও ফাঁসি হয় আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। আর এখানেই বিচার ব্যবস্থার মাহাত্ম্য।