কিচ্ছু পাল্টায়নি, সটান উত্তর এল। এই তো সে দিন এক মন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন যে, আমাদের বেছে নিতে হবে উন্নয়ন চাই, না পরিবেশ। হ্যাঁ, ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে, যখন সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, অবিলম্বে পরিবেশকে প্রাধান্য না দিলে জলবায়ু পরিবর্তনকে যাবতীয় পরিকল্পনার মধ্যমণি করতে না পারলে উন্নয়ন তো দূরস্থান, হয়তো পৃথিবীটাকেই বাসযোগ্য রাখা যাবে না, তখনও অধিকাংশ রাজনীতিবিদ উন্নয়ন বনাম পরিবেশের যুদ্ধই দেখছেন!
মেধা পাটকরের সঙ্গে কথা বলতে বসে প্রথম প্রশ্নই ছিল— এই বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সঙ্কটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রাজনীতিবিদদের উন্নয়ন সম্পর্কে, পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা কি পাল্টাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে? মেধাজি স্পষ্ট করলেন যে, কেউ কেউ মুখ ফস্কে বলে ফেললেও, মনেপ্রাণে দলমত নির্বিশেষে অধিকাংশ নেতা-নেত্রীই মনে করেন, খাল-বিল ভরাট করে, নদী দখল করে, বাতাসে বিষ ঢেলে, ‘রাস্তা জুড়ে’ দাঁড়িয়ে থাকে যে ব্রিজ থেকে বহুতল— সেটাই আসল উন্নয়ন।
উদাহরণ অজস্র। ডেউচা-পাঁচামি থেকে কেরলের কে-রেল প্রকল্প। ডেউচা-পাঁচামির পরিকল্পিত কয়লাখনি প্রকল্প নিয়ে পরিবেশের প্রশ্ন স্বাভাবিক ও সঠিক, কয়লা পোড়ানো নিয়ে আন্তর্জাতিক ভাবনাচিন্তা ও বীরভূমের স্থানীয় পরিস্থিতি বিচার করে। কিন্তু মেধা মৃদু হেসে জানালেন, বামপন্থীরা এ রাজ্যে পরিবেশের কারণে ডেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্পের প্রবল বিরোধিতা করলেও, কেন্দ্রের বুলেট ট্রেনের বিরোধিতা করলেও, তাঁরাই আবার যাবতীয় পরিবেশ প্রশ্নকে শিকেয় তুলে কেরলে কে-রেল প্রকল্প আনতে বদ্ধপরিকর, যা তাঁর মতে বুলেট ট্রেনেরই আর এক রূপ। তথৈবচ অবস্থা বিজেপির। রাজনৈতিক প্রয়োজনে আজ তারাও ডেউচা-পাঁচামির বিরোধিতা করছে এ কথাকে সন্তর্পণে পাশে সরিয়ে রেখে যে, প্রকল্পটি পশ্চিমবঙ্গকে দিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারই। এবং পরিবেশ ছাড়পত্র তারাই দেবে! অন্য দিকে, তৃণমূল যে সিঙ্গুর ও নয়াচর আন্দোলনের হাত ধরে ৩৪ বছরের বাম শাসনকে সরিয়ে মসনদে এসেছে, সেই আন্দোলনগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল পরিবেশ!
আসলে প্রকল্প আমার প্রয়োজন মতো, বা বলা ভাল আমার ইচ্ছামতো হলে পরিবেশ আইন পকেটে তালাচাবির মধ্যে থাকবে, আর উল্টোটা হলে আইন পকেট থেকে বেরিয়ে প্রকল্পে তালাচাবি দেবে, এটাই দস্তুর। বাম আমলে সুন্দরবনে একটি মেগা পর্যটন প্রকল্প প্রায় উদ্বোধন হওয়ার মুখে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, কেননা প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা সংস্থাটির সঙ্গে শেষ মুহূর্তে মতের অমিল হয় রাজ্য সরকারের। বন্ধ করার ঢাল হিসেবে বলা হয়, প্রকল্পটির ‘এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ রিপোর্ট নাকি সঠিক নয়! উল্টো দিকে, দক্ষিণ কলকাতার এক আকাশচুম্বী আবাসন সরকারি তথ্য অনুযায়ী যাবতীয় পরিবেশ আইন ভেঙে তৈরি হলেও তার একটি ইটও স্পর্শ করা যায়নি; না বাম আমলে, না বর্তমান সরকারের সময়। কেননা, এ ক্ষেত্রে যাবতীয় হিসাবনিকাশ ঠিকমতো মিলিয়েই উন্নয়ন আক্ষরিক অর্থে মাথা তুলেছিল পাশের জলাশয়কে সরকারি হিসাবেই ‘এক একর’-এর উপর ভরাট করে। রাজ্যে ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও এ সব প্রবণতার কোনও পরিবর্তন হয়নি।
উন্নয়নের খড়্গে পরিবেশকে কচুকাটা করার প্রবণতা সব সময় থাকলেও এটা ঘটনা যে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের সময় তাতে ‘অফিশিয়াল’ তকমা পড়েছে, এবং এক অন্য মাত্রা পেয়েছে। ‘ইজ় অব ডুইং বিজ়নেস’-এর নামে শিল্পসংস্থাদের যা খুশি করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়ার বিষয়টিকে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলা হচ্ছে, যাবতীয় পরিবেশ সংক্রান্ত আইন দুর্বল করা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিধিরাম বানিয়ে রাখা হচ্ছে— অভিযোগের তালিকা লম্বা। মেধা পাটকরের কথায়, এক দিকে আমরা যাবতীয় পরিবেশ নামাবলি গায়ে জড়ানো দিবসগুলি সাড়ম্বরে পালন করছি, অন্য দিকে প্রায় প্রত্যেক মানুষের জীবনের প্রতিটি দিক কোনও না কোনও পরিবেশ বিপর্যয়ে অবিরত ধাক্কা খাচ্ছে। আসলে পরিবেশকে পিছনে ঠেলে যে উন্নয়ন হয়, শেষে যে সে-উন্নয়নও বাঁচে না, এটা আজ আর তত্ত্বকথা নয়; হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া সত্য।
নর্মদা বাঁধ থেকে এ বিষয়ে ভাল আর কোনও উদাহরণ পাওয়া কঠিন। মেধাজির কথায়, প্রকল্প গড়ার আগে নর্মদা নিয়ে আন্দোলনের সময় বার বার সাবধান করা হয়েছিল, যে ভাবে পরিবেশকে অবজ্ঞা করে প্রকল্পটি গড়া হচ্ছে, তাতে পরিবেশ বাঁচানো তো দূর, সরকার প্রকল্পটি ঘিরে যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সেগুলোও পূরণ হওয়া কঠিন। সে কথা কেউ শোনেনি। “আজ দেখুন, প্রাথমিক খরচের যে হিসাব করা হয়েছিল, তার প্রায় পনেরো গুণ খরচ বাড়ার পরেও কী অবস্থা। সমুদ্র বেশ খানিকটা এগিয়ে এসেছে এবং লবণাক্ততা বাড়ছে; নর্মদার জল এত দূষিত যে, আধিকারিকরাই বলছেন এই জল ব্যবহার করলে জৈব চাষের সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে না। অবাধে বেআইনি বালি উত্তোলন চলছে; কচ্ছ-এ প্রতিশ্রুতি মতো জল পৌঁছনো যায়নি। পূর্ণ হয়নি বিদ্যুৎ তৈরির পরিকল্পনা। বাদ-বিসংবাদ, মামলা-মকদ্দমা চলছে গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের মধ্যে, এমনকি প্রকল্পের জন্য হওয়া ক্ষতি সামলাতে বিশাল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিপূরণের দাবিও তুলেছে মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশ।”
মেধাজির স্পষ্ট বক্তব্য— সরকারকে, তা সে কেন্দ্রেই হোক বা রাজ্যে, আগামী দিনে যাবতীয় নতুন প্রকল্পের ছাড়পত্রে সিলমোহর লাগানোর আগে নর্মদার সর্দার সরোবর বাঁধের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আর তা না নিলে মানুষের মধ্যে আন্দোলন গড়াটাই মূল রাস্তা, যেমনটা কৃষক আন্দোলন করে দেখিয়েছে। কাকতালীয় নয় যে, পৃথিবী জুড়ে পরিবেশকেন্দ্রিক যে সাড়ে তিন হাজারের উপর আন্দোলনের তালিকা এ মুহূর্তে মজুত, সেখানে চিনের পরেই রয়েছে ভারতের স্থান।