সাল ২০৩১। বড়দিনের ছুটির ঠিক আগে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ তুঙ্গে। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হল, গোটা পৃথিবী জুড়েই হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে যে, সর্দি-কাশি-জ্বর প্রবল ভাবে বেড়ে গিয়েছে। সমস্ত হাসপাতালেই রোগীর ভিড়। কোথাও কোনও বেড খালি নেই। মৃতের সংখ্যাও অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল যে, এক নতুন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণেই এই পরিস্থিতির সূত্রপাত। ভয়ের ব্যাপার হল, বোঝা যাচ্ছে না যে, এই ভাইরাসের উৎপত্তি কোথা থেকে। জিনোম বিশ্লেষণ করেও কোনও কূল-কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। তাই প্রতিষেধক তৈরি করতে হিমশিম খাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস তো মরসুমি, প্রতি বছর দেখা দেয়, তা হলে বোধ হয় চিন্তিত হওয়ার তেমন প্রয়োজন নেই— এই ধারণার বশবর্তী হয়ে সরকারি হুঁশিয়ারিও লোকে গ্রাহ্য করছে না। এটা ঠিক যে, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সংক্রমণে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যান, কিন্তু এ বছর সেই মৃতের সংখ্যা ৫-১০ গুণ বৃদ্ধি পেতে চলেছে। বিজ্ঞানীদের অনুমান, এই মারাত্মক ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের থেকে অনেকটাই বেশি, ফলে সংক্রমণ মহামারি থেকে অতিমারি-র আকার নিতে চলেছে। দাবানলের মতো এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ভারতে ইনফ্লুয়েঞ্জা খুব কম হয়। কিন্তু এ বারে পরিস্থিতি একেবারে অন্য রকম, ঘরে ঘরে দেখা দিচ্ছে সংক্রমণ। যদিও এই অতিমারি এক দশক আগের করোনা-অতিমারির মতোই আচমকা উপস্থিত হয়েছে, আশ্চর্যের ব্যাপার হল, সারা দুনিয়াই এ বারেও ঠিক আগের বারের মতোই ঘোরতর অপ্রস্তুত।
এটা কিন্তু নিছক মনগড়া কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয়। আমরা যদি এখন থেকে সতর্ক না হই, পৃথিবীতে পরের অতিমারি অনায়াসেই এই পর্যায়ে যেতে পারে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র বিশেষজ্ঞদের অনুমান, পরের অতিমারি খুব সম্ভবত এক নতুন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস থেকেই হবে। করোনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, অতিমারির জন্য প্রস্তুত না থাকলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা কতটা দুর্বিষহ হতে পারে। ঘরে ঘরে মৃত্যু, গোটা দেশই অচল, গৃহবন্দি জীবন, রুজি-রোজগার বন্ধ, পৃথিবী যেন হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েছে। একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক বর্তমান অতিমারি থেকে আমরা কী শিখেছি, আর সেই শিক্ষা কী ভাবে কাজে লাগাতে পারি ভবিষ্যতের অতিমারি প্রতিরোধ করার জন্য। ঠিক কবে আর কী আকারে পরবর্তী অতিমারি প্রকাশ পাবে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আগামী দশকের মধ্যেই যে ফের নতুন কোনও সংক্রমণ অতিমারির আকার নেবে, সে বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, পরিসংখ্যানবিদ ও জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বহু বিশেষজ্ঞ।
বিগত কয়েক দশক ধরে গ্লোবাল ওয়ার্মিং, আনুষঙ্গিক ইকোলজিক্যাল পরিবর্তন আর শহুরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সংক্রামক রোগের আক্রমণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আগে যে ভাইরাসের অস্তিত্ব হয়তো কোনও দুর্গম গুহার মধ্যে সীমিত ছিল, তা আজ মানুষের সংস্পর্শে এসেছে, যেমন সার্স-কোভ-২। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসবাস আর অবারিত আন্তর্জাতিক যাতায়াতের জন্য এক বার কোনও নতুন ছোঁয়াচে রোগ শহরে দেখা দিলে তা গোটা দুনিয়ায় খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ছে। ভাইরাস এক মানুষের শরীর থেকে অন্য জনের শরীরে গিয়ে আস্তানা নেয়; তাই যেখানে জনবসতির ঘনত্ব বেশি, সেখানে সংক্রমণ অনিবার্য। আর যতই সংক্রমণ ছড়াবে ভাইরাস ততই মিউটেশনের মাধ্যমে নিজেকে বদলাতে থাকবে, সেই সঙ্গে তার সংক্রমণের ক্ষমতাও বাড়তে থাকবে। জ্বলন্ত উদাহরণ সার্স-কোভ-২’এর ডেল্টা ভেরিয়েন্ট। এর উপর রয়েছে ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণেরও ভয়াবহ হয়ে ওঠার আশঙ্কা। মুড়িমুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক ব্যাকটিরিয়া তৈরি হচ্ছে, যা এক দিন মহামারি থেকে অতিমারির আকার নিতে পারে। কিন্তু শহরতলি আর গ্রামের পরিকাঠামোয় উন্নতি না হলে, কাজের সুযোগ তৈরি না হলে শহরে পরিযায়ী শ্রমিকের ভিড় জমানো কমবে না। তাই শহরের জনঘনত্বও কমবে না। তা হলে ভবিষ্যতের অতিমারি ঠেকানোর উপায় কী?
জনস্বাস্থ্যের এক মূল স্তম্ভ হল সুষ্ঠু প্রচার ব্যবস্থা এবং গণস্বাস্থ্যশিক্ষা। প্রত্যেক দেশেই সরকারি প্রচার ব্যবস্থার কাঠামো আছে। সরকারি স্বাস্থ্যশিক্ষার ব্যবস্থাও রয়েছে। এর সঙ্গে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সরাসরি সহযোগিতার নেটওয়ার্ক থাকা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক কর্মসমন্বয়ের পরিকাঠামোও থাকা দরকার। এই কাজগুলোই করে থাকে ‘হু’। কিন্তু শক্তিশালী দেশগুলোর রাজনৈতিক টানাপড়েনে এই সংস্থার কার্যকারিতাও কমে গিয়েছে। ভবিষ্যতের অতিমারি রুখতে প্রথমেই ‘হু’কে শক্তিশালী হতে হবে এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। সরকারি প্রচার ব্যবস্থা আর গণস্বাস্থ্যশিক্ষার যৌথ পথনির্দেশ তৈরি করতে হবে, যা গ্রাম থেকে শহরে সর্বত্রই প্রযোজ্য। ইন্টারনেটের যুগে গণ-প্রচারের ব্যাপক ব্যবস্থা না থাকার কোনও যুক্তি নেই। জনস্বাস্থ্য নিয়ে যে কুসংস্কার বা ভুল তথ্য প্রচলিত আছে, তার মোকাবিলা করার এটা অন্যতম উপায়। ভুল ও মিথ্যা প্রচার শুধু জনস্বাস্থ্যের জন্যেই ক্ষতিকর নয়, দেশের আপাত-নিরাপত্তার জন্যও মারাত্মক হতে পারে।
জনস্বাস্থ্যের দ্বিতীয় স্তম্ভ হল সর্বস্তরে সুলভ চিকিৎসা। স্বাস্থ্যব্যবস্থা শুধুমাত্র কতিপয় বিত্তবান লোকের জন্য সুলভ হলে সেটা জনস্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। অসাম্য জনস্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। শুধু প্রাথমিক চিকিৎসাই নয়, প্রত্যেক জেলায় প্রকৃত হাসপাতাল থাকা প্রয়োজন, যেখানে আধুনিক চিকিৎসার যথাযথ সুযোগ থাকবে। এ ছাড়াও সর্বত্র স্থানীয় ক্লিনিক থাকা জরুরি। আজকের ডিজিটাল যুগে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত রেকর্ড নথিভুক্ত না হওয়ারও কোনও অজুহাত থাকতে পারে না। সেই রেকর্ড কম্পিউটারের মাধ্যমে বিশ্বের সর্বত্র অধিগত করা যায় যাতে, সেটা দেখা উচিত।
জনস্বাস্থ্যের তৃতীয় স্তম্ভ হল সংক্রমণের গতিপথ চিহ্নিতকরণ। এ ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অবশ্য প্রয়োজন। বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তৈরি আন্তর্জাতিক দল ‘হু’-র তত্ত্বাবধানে দেশ-দেশান্তরে নানান সংক্রামক রোগের অস্তিত্ব নির্ধারণ করবে। এদের রিপোর্ট অবিলম্বে দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের জনস্বাস্থ্য দফতরে পৌঁছে দিতে হবে। রিপোর্ট অনুযায়ী সংক্রমণ প্রতিরোধের যথাযথ পরিকল্পনা করা হবে। কোনও রকম রাজনৈতিক দলাদলির মাধ্যমে নয়, সংক্রমণের গতিবিধিতে নজর রাখতে তথ্যভিত্তিক বিচারের পথ বেছে নেওয়াই উপায়।
জনস্বাস্থ্যের চতুর্থ স্তম্ভ হল বৈজ্ঞানিক গবেষণা। কোথা থেকে ভাইরাসের উৎপত্তি, কী ভাবে ভাইরাস মিউটেশনের মাধ্যমে বদলাচ্ছে, অথবা কোন কোন ব্যাকটিরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক হয়ে উঠছে, কোন নতুন পদ্ধতিতে নতুন ভাইরাসের প্রতিষেধক দ্রুত তৈরি করা যায়, বা কোনও নতুন ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা— এ সমস্ত বিষয় নিয়ে বিশদে গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। করোনার ভ্যাকসিন মাত্র এক বছরে বাজারে এসেছে, কারণ উন্নত প্রযুক্তির ভ্যাকসিন-গবেষণা অনেক দিন আগে থেকেই চলছিল। ভ্যাকসিন ও ওষুধের সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন, মাস্ক এবং পিপিই কিট যথেষ্ট পরিমাণে মজুত রাখতে হবে। ব্যক্তিগত লাভের জন্য বা মুনাফা লোটার জন্য নয়, সমগ্র জনসাধারণের স্বার্থে হাতে হাত মিলিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, মহামারি বা অতিমারি কিন্তু কোনও একটি দরিদ্র বা বিত্তবান দেশের সমস্যা নয়, সমগ্র পৃথিবীর সমস্যা।
তবে যে প্রসঙ্গ কিছুটা অনালোচিত রয়ে গেল, তা হল অর্থ বিনিয়োগ। বিপদ উপস্থিত হওয়ার পরে নয়, সরকার এবং বেসরকারি বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলো কি অতিমারির প্রস্তুতির জন্য অগ্রিম অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত? এই প্রশ্নের উত্তরের উপর অনেকটাই নির্ভর করছে আগামী অতিমারির প্রস্তুতি। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে, আগে থেকে প্রস্তুত থাকতে হলে অগ্রিম বিনিয়োগ করতেই হবে। তা না হলে, ঘরবন্দি হয়ে পস্তাতে হবে, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে, প্রিয়জনের এবং নিজেদের মৃত্যুর আশঙ্কায় দিন গুনতে হবে। আমরা একটা মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে— কোন পথটা আমাদের নেওয়া উচিত, নিজেদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ মাথায় রাখলে সেটা কিন্তু পরিষ্কার।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ,
ওয়াশিংটন ডিসি