এখন শুভ্র শরৎকাল। প্রাচীন কালে এই সময়েই রাজারা দিগ্বিজয়ে বাহির হইতেন। আমি কলিকাতা ছাড়িয়া কখনও কোথাও যাই নাই, কিন্তু সেই জন্যই আমার মনটা পৃথিবীময় ঘুরিয়া বেড়ায়। আমি যেন আমার ঘরের কোণে চিরপ্রবাসী, বাহিরের পৃথিবীর জন্য আমার সর্বদা মন কেমন করে।” শরৎ এলেই ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের বইমুখো কেরানির এই কথা আজও মনে পড়ে বইকি। কিন্তু সেই শরৎগুলো আগে ভরে থাকত নতুন কাগজ ও কালির গন্ধে। শারদ সাহিত্যের খসখসানিতে। আজও কি তা-ই?
শারদ সাহিত্য নাকি আর আগের মতো নেই। আমপাঠকের কেবলই অতৃপ্তি। দীর্ঘশ্বাস। আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম। কম বয়সে যে শারদ সাহিত্য পেতাম, তা আর পাই না। সেই টান নেই, সেই প্লট নেই, সেই লেখক নেই। উল্টো দিকে লেখকের হাহুতাশ। লেখা আছে, পাঠক নেই! মনে পড়ে আগের প্রজন্মের কথা। আশির দশকের শারদ সংখ্যা খুলে তাঁদের চিরাচরিত হাহুতাশ। ইস্, প্রথমেই পরশুরাম আর তার পরেই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প, এ দুটো না থাকলে আর পুজোসংখ্যা কী! আমাদের প্রজন্মের এখন সেই বয়স। সত্তরের শারদ সংখ্যার নস্টালজিয়া আমরা ছাড়তে পারছি না।
পুজোসংখ্যা শব্দটা থেকে আমরা পুজোর গন্ধ মুছেছি। শরতের শিউলি আর নীল আকাশে সাদা মেঘের অনুষঙ্গ ছাড়িনি। এখন দুটো লেখা-পার্বণ বাঙালির। শারদ সাহিত্যের পার্বণ, আর বইমেলার পার্বণ। দুটোর মধ্যে মোটামুটি যে সময়ের ফারাক, তা ছ’মাসের কাছাকাছি বলেই, বছরটাকে এই দুই ভাগে ভাগ করে দেখার চল। কবিরা বইমেলায় চোদ্দোটা পত্রিকায় আর শরৎকালে বাইশটা পত্রিকায় লেখেন। উপন্যাসকাররা অনুপাতের অঙ্ক কষলে শারদে বেশি, বইমেলায় কম।
তা, যে সময় থেকে বাঙালির স্বর্ণযুগ, শারদ কাগজের আমেজে অভ্যস্ত হলাম আমরা নতুন জামা-জুতোর সঙ্গে, সেই সময়টা পঞ্চাশ-ষাটের দশক। বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের স্বর্গীয় সময়। ছোটরা পেত দেব সাহিত্য কুটীরের মোটা মোটা শারদ সঙ্কলন। রীতিমতো বই। সে সব বইয়ের লেখক তালিকা ছিল ঈর্ষণীয়। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার গল্প, বিধায়ক ভট্টাচার্যের অমরেশ-কেন্দ্রিক নাটক, বুদ্ধদেব বসুর অসামান্য কিছু ছোটদের গল্প। বিখ্যাত লেখকের তালিকার শুরু হত তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণকে দিয়ে। চোখ এড়াতেন না মহাশ্বেতা দেবী, প্রতিভা বসু, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, শৈলবালা ঘোষজায়া, আশাপূর্ণা দেবীরাও। সেই মনোবীণা, আজব বই, বলাকা নামের বইগুলো।
১৯৬০-এর আশপাশ থেকে শুরু হয়েছিল সত্যজিৎ রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত নবপর্যায়ের সন্দেশ পত্রিকা, যেখানে দাপটে লিখতেন লীলা মজুমদার, গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নলিনী দাশ (‘গণ্ডালু’র স্রষ্টা)। অন্নদাশঙ্করের ছড়া দিয়ে শুরু। মুখস্থ হয়ে যেত দ্রুত। ছিল কিশোর ভারতী, শুকতারা! নারায়ণ দেবনাথের তুলিকলমের জোরে এই সংখ্যাগুলি হুমড়ি খেয়ে পড়া, দেখা! শুকতারা-য় বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদাভোঁদা আর কিশোর ভারতী-তে নন্টে ফন্টে। ছবিতে গল্পের অমোঘ আকর্ষণ! ময়ূখ চৌধুরী! এর পর পরই আনন্দমেলা। ১৯৭৩-পরবর্তী ছোটদের দুনিয়াতে টেক্কা দিতে লাগল অনবদ্য প্রচ্ছদ আর অলঙ্করণ নিয়ে। বিমল দাসের সেই গোল মুখের শিশুরা, সূক্ষ্মতম তুলির আঁচড়ে আটকে থাকা শৈশব। কে আর ভুলবে।
সে সময়ে অনেক ভাইবোন মিলে একটি পুজোসংখ্যা কাড়াকাড়ি করে পড়া। আনন্দমেলা শারদ সংখ্যা খুললেই প্রফেসর শঙ্কু, তার বাইরে সন্দেশ-এ একটি বড় গল্প সত্যজিৎ রায়ের কলমে। আর নৈবেদ্যের উপর সন্দেশ, শারদ দেশ-এ সত্যজিৎ রায়ের একটি আনকোরা ফেলুদা! এগুলো ছিল প্রতি বছরের ঔৎসুক্যের, অপেক্ষার জিনিস।
তবে, সত্তরের দশক থেকে আশির দশক অবধি চেনা নামগুলিই কেবল ঘুরে ফিরে এসেছে। এক-এক বার নতুন লেখক যোগ হয়েছেন বটে, তবু সীমিত চিহ্নিত প্রতিষ্ঠিতের তখন জয়জয়কার। নিষিদ্ধ ফল লাভের আশায় ফেলুদার পাতায় আঙুল রেখে শারদীয়া দেশ উল্টে, বা মা-মাসির দুপুরের ঘুমের ফাঁকফোকরে আনন্দবাজার পত্রিকা-র পুজোসংখ্যা টেনে পড়তাম ‘বড়দের’ লেখাগুলো! রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর, বুদ্ধদেব গুহ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-নীললোহিত, সমরেশ বসু-কালকূট। আর একটু পরে, আবিষ্কৃত হয়েছেন অজস্র নতুন লেখক। চমকে দেওয়া সব ছোটগল্প পেয়েছি। কবিতা চিনতেও সাহায্য করেছে শারদ সংখ্যা। শারদ পাতায় পেয়েছি রাজলক্ষ্মী দেবীর আশ্চর্য করে দেওয়া কবিতা, বা প্রতি বছরের কবিতা পড়তে পড়তেই তারাপদ রায়ের ভক্ত হয়ে গিয়েছি।
উল্লেখ না করলে ক্ষমার অযোগ্য হবে এ সব কাগজের আশ্চর্য করে দেওয়া শারদ অলঙ্করণগুলির কথা। দেশ আর আনন্দবাজার-এ সুধীর মৈত্র, সমীর সরকার (গোড়ার দিকের শঙ্কু ও ফেলুদা অলঙ্করণগুলোতে সত্যজিৎ রায়), পূর্ণেন্দু পত্রী— চোখকাড়া কাজ। এঁদের এবং আরও অগুনতি শিল্পীর চূড়ান্ত অনুশীলন আর পরীক্ষানিরীক্ষার ফসল থাকত কাগজে-কাগজে। কয়েক আঁচড়ে বিস্ময়কর জাদু। সুধীর মৈত্রের রেখায়, রমাপদ চৌধুরীর লেখায় ‘এখনই’ বা ‘পিকনিক’-এর সেই সব ছিপছিপে মেয়ে ও গুরুশার্ট-পরা চুলে কেয়ারি করা সুঠাম ছেলেদের কে ভুলতে পারে? আমার এ সব দেখার সময় সদ্যকৈশোর। ফলে দ্রুততর হৃৎস্পন্দন। অঙ্কখাতার পিছনের সাদা পাতায় সেই সব টানটোনের হাত মকশো চলত আমাদের। অর্থাৎ, আমাদের নস্টালজিয়ার অনেকটা জুড়ে আছে যে শারদ সাহিত্য, তা কিন্তু শুধুই পড়া নয়, দেখাও। কিন্তু, সে সময়ের কিশোর-কিশোরীদের তো পড়াটাই ছিল একমাত্র বিনোদন। সেই মন ছিল, সছিদ্র স্পঞ্জের মতো, সাহিত্যরস টেনে নেওয়ার।
এই অবধি একটা সমস্যা ছিল অনেক নবীন লেখকের। লেখক হতে চান যাঁরা, তাঁদের জন্য তখনও লেখার জায়গা বেশি নেই। হাউসের লেখক, বাণিজ্যিক কাগজের লেখক বনাম ছোট কাগজের লেখক, এই ভাগাভাগিটাও তখন তাই তীক্ষ্ণ অবয়ব নিয়ে হাজির। তরুণ কবি, তরুণ গল্পকারেরা হন্যে। বড় পত্রিকায় লেখা পাঠান। অনেক লেখা অমনোনীত হয়ে ফেরত আসে।
বদলের সূত্রপাত নব্বইয়ের দশক থেকে। কেননা মনমোহনায়িত অর্থনীতির মুক্ত বাজার। সহজতর ছাপার পদ্ধতি, কম্পোজ়িং হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে। অনেক পত্রিকার পথ খুলছে। পাশাপাশি চোখে দেখার মতো পরিবর্তন আসছে সম্ভাব্য পাঠকসমাজে। একটা প্রজন্মের পড়া কমছে, আঁকা ছবি দেখাও কমছে, কারণ তাদের চোখ ও মনকে অধিকার করছে দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমগুলো। দূরদর্শন এসেছিল সত্তরের মাঝামাঝি, কিন্তু নব্বইতে এল বাহাত্তর চ্যানেলের স্বাধীনতা। ফলত, দেখা আর শোনার ধরন পাল্টাতে শুরু করল দ্রুত। ডিজিটাল দুনিয়ার দিকে যত এগিয়ে যাব এর পর, তত দ্রুত একটা নতুন প্রজন্ম উঠে আসবে। সে প্রজন্মের কাছে তাৎক্ষণিক ভাবে পৌঁছে যাচ্ছে তথ্য, থাকছে না অবসর, বিশেষ কিছু ছুটির দিনে বিশেষ কিছু পড়া।
এর পরের প্রতি দশ বছর এক-একটা বিশাল পরিবর্তনের জলবিভাজিকা। ২০০০ সালের জাতকেরা ভাত খেয়েছে টম অ্যান্ড জেরি দেখে। বড় হয়েছে বাবা-মায়ের কম্পিউটারের মেনু ঘেঁটে। ২০১০-এর ভিতরে সমস্ত জনতা-জনার্দনের হাতে হাতে উঠে আসছে স্মার্টফোন, এন্ট্রি নিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া, হোয়াটসঅ্যাপ এসে তৈরি করছে নতুন ধরনের এক পড়ুয়াও। ‘হো আ বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে এক নতুন শব্দবন্ধই গজিয়ে উঠেছে। সত্য-মিথ্যা, পোস্ট-ট্রুথ, অর্ধসত্য মিলিয়ে ফনফনিয়ে উঠেছে জ্ঞানবৃক্ষের আগাছারা এই মাধ্যমে।
অ-সাহিত্য তরল পড়ার পাশে সিরিয়াস সুগম্ভীর লেখালিখি পড়াশোনাও কি আর থেমে থাকছে? থাকছে না। শুধু অজস্র পথ বেয়ে তার আনাগোনা। অনেক লেখক। বহুপ্রজ মাধ্যম। অমোঘ ক্লাটারিং, যা প্রায় শ্বেত কোলাহল বা হোয়াইট নয়েজ়ের মতো করে চেতনাবিলোপী একটি স্রোতধারায় পরিণত।
আরও কী এসেছে? কাগজ-কালির খরচ নেই। নেটযোগে আসতে শুরু করেছে ডিজিটাল পত্রিকা বা ই-পত্রিকা। ভাল কিছু ই-পত্রিকা ২০১০-এর আশেপাশে এসেছে। ব্যতিক্রমী। অনেক বর্ষীয়ান লিটল ম্যাগ সম্পাদক তরুণ তুর্কি নয়া প্রজন্মের হাত ধরে এই ফরম্যাটে পত্রিকা করলেন। এই সব ই-পত্রিকার রমরমা ২০২০-র দশকে বিস্ফোরণে পরিণত হবে। ৫জি মোবাইল কানেক্টিভিটি এসে গিয়েছে। ডিজিটাল ডিভাইড ক্রমশ কমছে, গ্রাম-মফস্সলের ছেলেমেয়েরাও ব্লগ বা ডোমেন ভাড়া করে পত্রিকা চালু করছেন। পাঠকের সাকিন বিশ্বের যে কোনও প্রান্ত হতে পারে।
লকডাউন-পরবর্তী পর্যায়ে বহু ছাপা কাগজও নেটভিত্তিক অনলাইন পত্রিকায় নিজেদের এনে ফেলল। ২০২২-এ এসে কী দেখলাম? অসমর্থিত হিসাব বলছে, গোটা বইপাড়ায় তিন হাজার শারদ পত্রিকা নাকি বেরচ্ছে, ওয়েব বা অনলাইন আর ছাপা মিলিয়ে। মাঝারি ব্যবসায়িক পত্রিকারও অভাব নেই এখন। নবীন পত্রিকা ঠাঁই দিচ্ছেন অজস্র নতুন উঠে আসা লেখককে। লেখার জায়গার অভাব নেই।
বাংলা পত্রপত্রিকার এই বহুপ্রজনন দেখে কেউ কেউ বলেন, এখন তো সবাই লেখক। কিন্তু, পাঠকের নিজের হাত মকশো করার ইচ্ছা কোনও অন্যায় নয়। অজস্র লেখকের উঠে আসা অবশ্যই সাহিত্যের জীবিতাবস্থা প্রমাণ করে। প্রযুক্তির ফলেই সহজ হয়েছে এত লেখকের প্রকাশিত হওয়া। কিন্তু কে লিখছেন আর কে পড়ছেন, বুঝে নেওয়া মুশকিল। আজ পাঠকের হাতে বেছে নেওয়ার বস্তু অগণিত। বাছার জন্য যে ধৈর্য ও মেধা দরকার, সেটাই শুধু বেমিল। আর বেমিল অবসর। ওটিটি-তে ইতিমধ্যে অভ্যাস হয়েছে থ্রিলার দেখার, তাও আবার সিরিজ়ে। মানে এক বার ধরলে আর ছাড়া নেই। টিভি সিরিয়াল আগের প্রজন্মের দ্বিপ্রাহরিক গল্প-উপন্যাস পড়া কেড়েছে। তেমন করেই পরের প্রজন্মেরও স্বাদগ্রন্থির বদল ঘটেছে।
এত বিক্ষিপ্ততার মাঝেও আজও নিমগ্ন, প্রকৃত পাঠক আছেন, যিনি প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য পত্রিকাগুলোর প্রায় সব লেখায় চোখ বোলান, বা প্রিয় লেখককে অনুসরণ করে তাঁর লেখা যে কাগজে বেরোল, সেটি জোগাড় করে পড়ে ফেলেন। আসলে নিরবচ্ছিন্ন ধারানিবদ্ধ লেখালিখি পাঠ। গোটা বছর জুড়ে। এটাই এখন ভাল পাঠকের একমাত্র নিয়তি।
এখনও বাঙালির ভাদ্র মাস থেকে মন আনচান করে, বাতাসে এখনও পুজো পুজো গন্ধ ভাসে। সারা বছর ধরে লেখা অজস্র লেখার স্বর্ণধান্য শারদ সাহিত্যের সোনার তরীটিতে চাপিয়ে দিয়ে উৎসুক থাকেন লেখকেরা। ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে পাঠক মন! অঢেল খাদ্য সম্ভার। বুফে মেনুতে খাওয়াদাওয়া করার মতো, প্লেটে ও পেটে, স্থান ওইটুকুই। যেটুকু ধরবে, নেবেন পাঠক।