কিছু দিন আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের কাছে একটি ফোন আসে। মুম্বই পুলিশের সন্ত্রাস দমন শাখার অফিসার বলে পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি জানান যে, ওই অধ্যাপকের ফোন থেকে বেশ কিছু নাশকতামূলক কাজের ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। সেই জন্য তাঁকে অপরাধ দমন শাখার কিছু প্রশ্নোত্তরের মুখোমুখি হতে হবে মুম্বই গিয়ে অথবা অনলাইনে। বিষয়টি কোনও একটি অনলাইন প্রতারণা চক্রের কাজ, এমনটা আন্দাজ করে ওই অধ্যাপক বলেন যে তিনি পরে কথা বলবেন। এর পর স্থানীয় থানায় বিষয়টি জানান তিনি। থানা থেকে তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের প্রশংসা করে বলা হয় যে, তিনি একটা বড় অনলাইন প্রতারণার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছেন।
শুধু ওই অধ্যাপক নন, সাম্প্রতিক সময়ে এই ধরনের অনলাইন প্রতারণার শিকার হয়ে বহু টাকা খুইয়েছেন অনেকেই। কিছু দিন আগে পুণের এক ৭৩ বছরের প্রবীণ ব্যক্তিকে গৃহবন্দি করে রেখে তাঁর থেকে ৪৫ লক্ষ টাকা হাতিয়েছে কয়েক জন প্রতারক। তাঁকে বলা হয়েছিল তাঁর ফোন নম্বর থেকে আর্থিক তছরুপ ও মাদক পাচারের অভিযোগ আছে। এই ধরনের ঘটনা বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়েছে। এমনটা নয় যে, আর্থিক বিষয়ে তেমন প্রাজ্ঞ নন বা আজকের সাইবার জগৎ সম্পর্কে তেমন ধ্যানধারণা নেই, এমন মানুষই এই সব প্রতারণার শিকার হয়েছেন বা হয়ে চলেছেন। বহু শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ, এমনকি বেশ কয়েক জন ছোটখাটো শিল্পপতিও এই জালিয়াতি চক্রের পাল্লায় পড়ে বহু টাকা খুইয়েছেন।
ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম রিপোর্টিং পোর্টাল-এর তথ্য বলছে, শুধু ২০২৪ সালের আর্থিক বছরের প্রথম তিন মাসে গোটা দেশে সব মিলিয়ে প্রায় ১২০ কোটি টাকার এই ধরনের অনলাইন প্রতারণা ঘটেছে। আরবিআই-এর বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে কার্ড বা ইন্টারনেট-জনিত প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে ২৯,০৮২টি।
বিষয়টা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে এই বিষয়ে কথা বলেছেন। এর আবার একটা গালভরা নামও দেওয়া হয়েছে— ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’। যথারীতি, জনগণকেই সচেতন হতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু শুধু জনগণ সচেতন হলেই কি এই সমস্যার সমাধান হবে? সরকার বা প্রশাসনের কি কোনও দায়িত্ব নেই? যদিও তিনি জাতীয় সাইবার কোঅর্ডিনেশন সেন্টারের কথা বলেছেন, যারা অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করবে। এমন ঘটনা ঘটলেই সরকার যাতে দ্রুত পদক্ষেপ করে অপরাধীদের গ্রেফতার করে সেই ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। কিন্তু আজ অবধি কেন এক জন অপরাধীকেও ধরা যায়নি, তা নিয়ে তিনি নিশ্চুপ থেকেছেন। তা হলে কি বড় কোনও মাথা এই প্রতারণা চক্রের সঙ্গে যুক্ত? না কি সরকারি কোনও ভুল নীতির ফলে নাগরিকরা এই ধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছেন?
যাঁরা এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের বক্তব্য মোটের উপর একই রকম— বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রতারণা চক্রের তরফ থেকে প্রথমেই বলা হয়, ‘আপনার আধার নম্বরটির একটি প্রতারণার সঙ্গে সম্পর্ক আছে’ বা ‘আপনার ফোন নম্বরটি একটি সন্ত্রাসমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত’। এমন কথা শুনে বেআইনি কোনও কাজে নাম জড়ানো ও আইনি জটিলতার আশঙ্কায় স্বাভাবিক ভাবেই বেশির ভাগ মানুষ ভয় পেয়ে যান। প্রতারণাটি চলার মাঝে বহু বার টেলিকম দফতরের কোনও বড় কিন্তু ‘ভুয়ো’ অফিসারের কাছ থেকে ফোন আসে শিকারের কাছে, যাতে এক বারের জন্যেও তাঁর মনে না হয়, তিনি প্রতারিত হতে চলেছেন। মাঝেমধ্যেই তাঁর সঙ্গে ‘মুম্বই ক্রাইম ব্রাঞ্চ’-এর তরফে যোগাযোগ করে বলা হয়, তিনি যেন বাড়ির অন্য কাউকে এই বিষয়টা না জানান এবং ঘরের দরজা বন্ধ করে তবেই যেন ইন্টারনেটের সামনে বসেন। ভিডিয়ো কল চলাকালীন বারংবার তাঁকে বলা হয়, তাঁর আধার নম্বরটি একটি ‘বিপৎকালীন’ অবস্থায় আছে।
২০১৮ সালে প্রথম বার খবর হয়েছিল প্রায় এক কোটি মানুষের আধার তথ্য ফাঁস হওয়ার কথা। অতিমারির সময়েও একই ধরনের আরও একটি খবর জনসমক্ষে আসে— কোউইন মোবাইল অ্যাপ থেকে অসংখ্য মানুষের আধার এবং মোবাইল তথ্য চুরি গিয়েছে। অর্থাৎ, দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষের আধার, মোবাইল নম্বর, ইমেল অ্যাড্রেস রয়েছে প্রতারকদের হাতে। অথচ, সরকার দাবি করে এসেছে, সব তথ্য সুরক্ষিত আছে।
এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ২০১৮ সালের শুনানির সময়েও সরকার পক্ষ বলেছিল, আধার তথ্য চুরি হওয়ার কোনও কারণই নেই, অতএব নাগরিকদের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। সরকার যতই অস্বীকার করুক, যে দিন থেকে কোনও ব্যক্তির প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত তথ্যের সঙ্গে আধারকে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে, সে দিন থেকেই প্রতারণার সম্ভাবনা প্রবল হয়েছে। এত দিন পরে ভারতের কম্পিউটার ইমারজেন্সি রেসপন্স টিমের পক্ষ থেকে একটি নির্দেশ জারি করা হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে সমস্ত আম যাতে একটি ঝুড়িতে না রাখা হয়, যাতে একটা ঝুড়ি চুরি হলে সমস্ত আম খোয়া না যায়।
কিন্তু আধার নম্বর সব কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকলে, এই ধরনের ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ বা অনলাইন প্রতারণার ফাঁদে পড়ে আম-ছালা সবই যাবে।