সমুদ্র যেখানে পরাভূত জনসমুদ্রের কাছে।
এক ঝকঝকে সমুদ্র সৈকতকে ‘খুন’ করতে বারো বছর বোধ হয় যথেষ্ট সময়। ‘খুন’ই তো। অন্তত এক ভরা পৌষের বিকেলে দিঘা বা উদয়পুর তটভূমি দেখলে এমনই মনে হয়। সমুদ্র সেখানে আজ সমূহ পরাভূত জনসমুদ্রের কাছে। এক সময় যেখানে ছিল বিস্তীর্ণ এক বেলাভূমি, অজস্র লাল কাঁকড়ার গর্ত, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ঝিনুকের সারি, এক যুগ পর সেখানেই চতুর্দিকে ডালপালা মেলেছে কুৎসিত-দর্শন প্লাস্টিকের সাম্রাজ্য। সারবাঁধা অস্থায়ী প্লাস্টিকের ছাউনি আর থিকথিকে ভিড়ে সমুদ্র যেন দেখা দিতেই চায় না। লাল কাঁকড়া, ঝিনুকের ঘর-বাড়ির দখল নিয়েছে বাঁকাচোরা লাল রঙা টেবিল-চেয়ার-বেখাপ্পা ছাতা, ইতিউতি ছড়িয়ে আছে বিয়ারের ভাঙা বোতল, ভাজা মাছের কঙ্কাল। উৎকট আঁশটে গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে।
পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্র সৈকত সংখ্যায় স্বল্প, কিন্তু বঙ্গভূমিতে তার ভূমিকা কম গুরুতর নয়। উদয়পুর সৈকত সদ্য-পরিচিত, মন্দারমণি-তাজপুরেরও এই সবে শৈশব পার হল, দিঘার বয়স আরও কয়েক দশক বেশি। কিন্তু এই সৈকতভূমি নিয়ে বাংলার গৌরবের শেষ নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা-র বিচরণ ছিল এই সৈকতেই: “রসুলপুরের মুখ হইতে সুবর্ণরেখা পর্যন্ত অবাধে কয়েক যোজন পথ ব্যাপিত করিয়া এক বালুকাস্তূপশ্রেণী বিরাজিত আছে।... এক্ষণে লোকে উহাকে বালিয়াড়ি বলে।... অধোভাগমণ্ডনকারী বৃক্ষাদির মধ্যে ঝাটী, বনঝাউ এবং বনপুষ্পই অধিক।”
এখন যাঁরা ষাট-সত্তরের কোঠায়, তাঁদের অনেকেরই মনে দিঘা বলতে কিছুতেই এখনকার কংক্রিট-শোভিত, পার্ক-ঘেরা রূপটি ফোটে না, বার বার দেখেও। তাঁরা এখনও চোখ বন্ধ করলেই সেই দিঘা দেখতে পান, যেখানে ঝাউবন পেরিয়ে সমুদ্রতীরে পৌঁছনোর আবেগ তাঁদের স্মৃতিপটে চির-আঁকা। তাঁরা আকণ্ঠ ডুবে থাকতে চান সেই সোনালি বালি চিকচিক স্মৃতিতে, প্রথম ঝিনুক কুড়োনোর হুটোপাটির বিস্মৃত বিস্ময়ে। বিয়ের পর লৌকিকতার পালা সেরে, সংসার খরচ থেকে বাঁচিয়ে রাখা সামান্য টাকা সম্বল করে মধুচন্দ্রিমার জন্য তাঁরা সেই অপরূপ বেলাভূমিতেই ভরসা রাখতেন। দিঘার সৈকততটে ঝাউছায়াতেই তাঁদের নিজেকেও প্রথম চেনা, সঙ্গীর সঙ্গে প্রথম বার মন খুলে কথা কওয়া।
আজ? সেই দিঘাতে ঝাউবন খুঁজতে হলে দূরবিনই ভরসা। সামুদ্রিক ভাঙন আর ঝাউবন ধ্বংস করে হোটেল ব্যবসার রমরমা ক্রমশ গিলে খাচ্ছে সৈকতের পরিসরটুকু। দিঘা ছেড়ে তখন তাঁরা কাছেই অন্য তটের খোঁজে বেরিয়েছিলেন, দেখেছিলেন একমাত্র উদয়পুরের সৈকতেই তবু পুরনো দিঘাকে ফিরে পাওয়ার সান্ত্বনা। সে সব বারো বছর আগের কথা। তখন উদয়পুর সৈকত প্রায় পর্যটকহীন। দোকান বলতে ধু ধু সৈকতের এক কোণে একটিমাত্র অস্থায়ী চা, ডাবের দোকান আর স্থানীয়দের কিছু ঝিনুকের পসরা। লম্বা পায়ে হাঁটা দিলেই লাল কাঁকড়াদের পথ পেরিয়ে মোহনাকে ছুঁয়ে আসা যায়। বারো বছর এক যুগ, সত্যিই, এখন এ সব কথা যুগান্তের। সেই একই জায়গায় সৈকত আগলে রাখা মনোরম ঝাউবন সরতে সরতে আজ অদৃশ্যপ্রায়। বালির উপর তেল পুড়িয়ে চলছে বাইক আর স্কুটির দাপাদাপি। আবর্জনা মিশে তীরের কাছে সমুদ্রের জলও কালচে বর্ণ।
দিঘার সমুদ্র বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রায়শই একটা কথা শোনা যায়— সমুদ্র এখানে আগ্রাসী। এক-এক করে তার ভাঙনে তলিয়ে যাচ্ছে সৈকত, সংলগ্ন ঝাউবন। উষ্ণায়নের ধাক্কায় সমুদ্রের আগ্রাসন এখন আর অপ্রত্যাশিত নয়। অপ্রত্যাশিত যা— এখনও যেটুকু আছে, যতটুকুকে আগলে রাখা সম্ভব ছিল, তাকেও কী ভাবে আমরা, মানুষেরা প্রতি দিন ভেঙেচুরে তছনছ করে চলেছি। পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন প্রশাসনও বুঝছে না, সৈকতের ধার ঘেঁষে বসার ব্যবস্থা, রঙিন টাইলসের কায়দা, বিনোদন পার্ক, আর আলোকসজ্জাই শেষ কথা নয়, সৈকতকে বাঁচাতে গেলে তার স্বাভাবিকতাকে ধরে রাখতে হবে যতটা সম্ভব। যে ঝাউবন সমুদ্রের আগ্রাসন আর জনবসতির মাঝে কিছুমাত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তাকে উজাড় করে কংক্রিটের নির্মাণ মানে জনবসতিকে সেই আগ্রাসনের সামনে একেবারে বেআব্রু করে দেওয়া।
আবেগটাই অবশ্য একমাত্র কথা নয়। সমুদ্রসৈকত জুড়ে অপরিকল্পিত বাড়িঘর বানিয়ে তোলা শুধুমাত্র দৃশ্যদূষণই ঘটায় না, তার অভিঘাত আরও অনেক বেশি গভীর, অনেক বেশি তীব্র। আজ যখন পাহাড় কেটে, বন উচ্ছেদ করে রাস্তা তৈরি হয়, পাহাড়ি নদীকে বাঁধ দিয়ে বেঁধে ‘উন্নয়নের জোয়ার’ আনা হয়, তখন প্রকৃতি তার নিজের নিয়মেই প্রতিশোধ নেয়। সে প্রতিশোধ খালি চোখেই স্পষ্ট। উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ, সিকিমের একের পর এক বিপর্যয়ে সেই প্রতিশোধের তীব্রতা আমরা টের পেয়েছি, বেআব্রু হয়েছে প্রশাসনের লোভ আর নির্বুদ্ধিতা। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে সমুদ্রও কি ছারখার করেনি জনবসতি? দক্ষিণ ২৪ পরগনা বা পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূল অঞ্চলে এখনও সেই তাণ্ডবের চিহ্ন ইতিউতি ছড়িয়ে। সমুদ্র ঢুকে পড়ে গিলে খেয়েছে রাস্তা, চাষের জমি, পুকুর, বসতিও। অথচ নিরাপদ পরিসরটুকু মুছে সমুদ্রের ঘাড়ের কাছে ‘উন্নয়ন’কে ঠেলে দেওয়ার নির্বোধ আগ্রহ তাতেও বিন্দুমাত্র কমেনি। উদ্বেগের বিষয় হল, ভারতের সমুদ্রতীরবর্তী জনপ্রিয় পর্যটন ক্ষেত্রগুলির এক বড় অংশই সেই বিপজ্জনক পথে পা বাড়িয়েছে।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে উপকূলে আবর্জনা জড়ো করার বদভ্যাস। এ দেশের প্রায় ৭৫০০ কিলোমিটার বিস্তৃত উপকূলরেখা ন’টি রাজ্যের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ১৪.২ শতাংশ সমুদ্রোপকূলেই বসবাস করেন। সুতরাং, উপকূল সংলগ্ন অঞ্চলের গুরুত্ব শুধুমাত্র তার জীববৈচিত্রের কারণেই নয়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বিপুল সংখ্যক মানুষের সু্ষ্ঠু জীবনযাপনের জন্যও তাকে সুস্থ রাখা বিশেষ জরুরি। কিন্তু সেই গুরুত্ব এখনও আমাদের মগজস্থ হয়নি। হয়নি বলেই ভারতের উপকূল অঞ্চলের দূষণ, বিশেষত প্লাস্টিক দূষণ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর এ দেশে হাজার হাজার টন জঞ্জাল জমা হয় সমুদ্র-লাগোয়া অঞ্চলে। এবং এই বিশাল পরিমাণ আবর্জনার ৬০ শতাংশই প্লাস্টিক। পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গাসাগর মেলা-অন্তে প্রতি বছর সমুদ্রতট ছেয়ে যায় পুজোর ফুল, মালা, প্লাস্টিকের জলের পাউচে। দূষণ ছড়ায় এক শ্রেণির পুণ্যার্থীর যত্র তত্র শৌচকর্ম করার অভ্যাসের কারণেও। সাগরমেলার দূষণ ঠেকাতে প্রশাসন নানা পদক্ষেপ করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা কতটুকু? বালি-মাটির নীচে চাপা পড়া আবর্জনা সাফ করার উদ্যোগও যথেষ্ট তো? জঞ্জালের ক্ষেত্রে ভারতের অন্য সৈকতগুলিও খুব পিছিয়ে নেই। বছরখানেক আগে এক গবেষণায় জানা গিয়েছিল, মুম্বইয়ের মাত্র দু’টি সৈকত থেকে যে পরিমাণ আবর্জনা সংগ্রহ করা হয়েছে, তার মধ্যে ৭৫ শতাংশেরও বেশি বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ভেঙে গিয়েই জন্ম নেয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক। সামুদ্রিক প্রাণী থেকে মানবশরীরে যার কুপ্রভাব এখন বহুচর্চিত বিষয়।
এ সব কথা অবশ্য আমরা হামেশাই শুনি। সংবাদপত্রে, টিভির পর্দায়, আলোচনা চক্রেও। তার পরও আমরা সমুদ্রের ধারে বসে প্লাস্টিকের কাপে চা আর কাগজের ঠোঙায় ঝালমুড়ি খেয়ে নির্দ্বিধায় ছুড়ে ফেলি জলে। তার পর এক দিন সেই সৈকত যখন পা রাখার অযোগ্য হয়ে পড়ে, তখন খুঁজতে চাই অন্য এক সুন্দর পরিপাটি সৈকত, ফের আবর্জনায় তাকে ভরিয়ে তোলার জন্য।
এটুকুও বুঝতে চাই না, সমুদ্রের পরিবেশ বিপন্ন হলে তার সঙ্গে হারিয়ে যাবে আরও অনেক কিছুই। যেমন— সমুদ্রের সঙ্গে মানবমনের সেই নিবিড় সংযোগ। অনন্ত, বিপুল জলরাশির সামনে ক্ষণিক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালে আপনিই যে সংযোগ রচিত হয়। সমুদ্রের সঙ্গে যেন তার অনেক দিনের বোঝাপড়ার সম্পর্ক। দমচাপা কষ্ট, না-বলা অনুভূতি অনায়াসে উজাড় করে দেওয়া যায় তাকে, সব কিছুই সে বিনা প্রশ্নে শুষে দেয়, আবার ফিরিয়েও দেয় অনেক কিছুই— পুরনো স্মৃতি, এক নতুন শুরুর আশা। এই সমুদ্রতটে বসেই যুগান্ত ছবির দীপক অনসূয়াকে শুনিয়েছিল তাদের ভেঙে যাওয়া সম্পর্কটাকে গুছিয়ে নতুন করে শুরু করার কথা। কিন্তু অনসূয়া তত দিনে ঘোর বাস্তববাদী, অনেকটা এই পরিবর্তিত সময়ের মতোই। সমুদ্রের সঙ্গে সে আর কথা কয় না, বরং সে প্রসঙ্গও তার কাছে এখন অপরিণত মস্তিষ্কের ভাবনা।
সত্যিই এই কালে সাগরের সঙ্গে ব্যক্তিগত কথোপকথনের অবকাশ নেই। সমুদ্র আজ যেন বড় বেশি ‘হ্যাপেনিং’, আমোদের ঠিকানা। যে সাগরপাড়ে দাঁড়িয়েই আশা-নিরাশায় দোদুল্যমান প্রেমিকপ্রবর গেয়ে উঠেছিলেন— “এই বালুকা বেলায় আমি লিখেছিনু/ একটি সে নাম আমি লিখেছিনু/ আজ সাগরের ঢেউ দিয়ে তারে যেন মুছিয়া দিলাম”— তার এখন অর্থই গেছে পাল্টে! সাগরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হৃদয়মোচড়ানো সেই গানের কথাগুলো কানে বাজলেও, আলাদা কোনও দৃশ্যকল্প আর তৈরি হয় না। সবটাই হারিয়ে যায় দামি রিসর্ট, আর বছরভর কার্নিভালের রঙিন চাঁদোয়ার নীচে। নিকাশির জল, আবর্জনা, খাবারের উচ্ছিষ্ট, ঘোড়া-উটের বিনোদন-ঠাসা কালচে বালির সৈকতে কি ভবিষ্যতে শিশুরাও বালি-ঘর বানানোয় বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাবে? সমুদ্রসৈকতের ধ্বংস তো শুধু পরিবেশের ক্ষতি নয়, এত কালের অর্জিত, সঞ্চিত, মনোরঞ্জিত সংস্কৃতি-চিহ্নগুলিরও অকালবিদায়।
প্রকৃতির নিয়মেই সমুদ্র অবশ্য এক সৈকত হারিয়ে গেলে ফের নতুন এক সৈকত গড়বে। মানুষকে ক্ষমা করে দিয়ে আবারও বালুকাবেলা গড়ে দেবে। নিজের সবটুকু উজাড় করে রূপের ডালি সাজিয়ে অপেক্ষা করবে, আরও এক বার মানুষের হাতে ‘খুন’ হওয়ার জন্য।