তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরে, শরিকি চাপে আটকে কিছুটা স্তিমিত থাকলেও নরেন্দ্র মোদীর মুসলমান বিদ্বেষে একটুও ভাটা পড়েনি। কারণটা পরিষ্কার। মুসলমান বিদ্বেষই আসলে বিজেপির প্রধানতম রাজনৈতিক মূলধন। ‘মন্দির ওয়হি বনেগা’ তাদের দু’টি লোকসভা, এবং একাধিক রাজ্যের নির্বাচনী বৈতরণি পার করতে সাহায্য করেছে। অথচ এ বার রামরাজ্যের রাজধানী অযোধ্যায় হার হজম করতে হল। রামমন্দির নির্মাণের ফলে দীর্ঘ দিন জিইয়ে রাখা বিষয়ের অবসান হয়েছে। তাই এখন চলছে আরও নতুন বিষয়ের উদ্ভাবন ও সন্ধান। গত লোকসভা নির্বাচনে এনআরসি প্রচারের পালেও নতুন করে হাওয়া দেওয়া হল। দেশের মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে দেখানো, ও তাঁদের প্রাত্যহিক জীবনে ‘অনিশ্চয়তা ও ভয়’ তৈরি করা— এই ছিল উদ্দেশ্য। এর পরের ধাপ, সম্পত্তির উপর মুসলমানদের অধিকারে আঘাত হানা।
বর্তমান লোকসভার প্রথম অধিবেশনে ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল ২০২৪ আনা হল। বলা হচ্ছে, রাজ্যের ওয়াকফ বোর্ড এই সম্পত্তির সঠিক দেখভাল করতে পারছে না, এবং সরকারি বিভিন্ন সম্পত্তি ওয়াকফ বোর্ড বেদখল করে বসে আছে। অথচ বাস্তব অন্য কথা বলে। কলকাতার গল্ফ ক্লাব ও টলি ক্লাবের কিছু অংশ এবং ডালহৌসি চত্বরে ওয়ালেস হাউস আদতে ওয়াকফ সম্পত্তি। এই বিপুল সম্পত্তি কেন্দ্রীয় সরকার নিজের হাতে রাখতে চায়। অর্থাৎ, এটা জমি দখলের লড়াই।
প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলির মধ্যে, নিয়ম প্রণয়ন, ওয়াকফ রেকর্ড এবং তথ্য পরিচালনা-সহ ওয়াকফের সাধারণ কাজ যেমন নিবন্ধন, বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সাধারণ ফর্মগুলি কেন্দ্রীয় সরকার নিজের হাতে রাখতে চায়। এখন পর্যন্ত ওয়াকফ বোর্ড এবং এমনকি হিন্দু এনডাওমেন্টগুলি দেখভালের দায়িত্বে থাকে রাজ্য সরকার। এই আইন পাশ হলে শুধুমাত্র মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না— দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতিও সম্পূর্ণ অনাস্থা দেখানো হবে।
ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল-এ বলা হচ্ছে, বিভিন্ন স্তরে সরকারি আধিকারিক ও অ-মুসলমানদের হাতে এই সম্পত্তি পরিচালনার ভার দেওয়া হবে। বিলের প্রতিটি ধারার পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার মধ্যে না গিয়েও বলা যায়, এই নতুন ব্যবস্থা মুসলমানদের আর্থিক ভাবে কোণঠাসা করবে, সংবিধান প্রদত্ত ধারা অর্থাৎ ধর্মীয় সংস্থা পরিচালনা করার অধিকারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা হবে। দেশ জুড়ে বিভিন্ন মন্দির পরিচালন কমিটিতে সরাসরি কেন্দ্র সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, তা হলে ওয়াকফ পরিচালনায় কেন সরকারি হস্তক্ষেপ থাকবে?
একই ভাবে বিজেপি-শাসিত রাজ্য থেকে শতাব্দী প্রাচীন মাদ্রাসা ব্যবস্থা তুলে দেওয়া চলছে। এ ব্যাপারে উত্তরপ্রদেশ সরকার খুবই আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে। ইলাহাবাদ হাই কোর্টের মতে, ‘উত্তরপ্রদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড আইন, ২০০৪’ আইনটি অসাংবিধানিক, কারণ এমন এক শিক্ষাব্যবস্থাকে বৈধতা দেয় যা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি লঙ্ঘন করে। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষপে এই প্রক্রিয়া কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হয়। প্রসঙ্গত, উত্তরপ্রদেশে মাদ্রাসায় ইতিমধ্যে প্রার্থনা সভায় ‘বন্দে মাতরম্’ ও সংস্কৃত পাঠ শুরু করেছে। এ কাজে জাতীয় শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনকে মাঠে নামানো হয়েছে। এই কমিশন মাদ্রাসার জন্য সরকারের সমস্ত রকম অনুদান অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়ার জোরালো সুপারিশ করেছে।
প্রায় দু’দশক আগে প্রকাশিত সাচার কমিটি রিপোর্টে মুসলমানদের সামগ্রিক পশ্চাৎপদতা, বিশেষ করে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে যোগদান বাড়ানোর জন্য ওবিসি সংরক্ষণের সুবিধা নেওয়ার ইঙ্গিত করা হয়। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুবিধা নিয়ে এ রাজ্যের মুসলমানরা খানিক আশার আলো দেখতে পেয়েছিলেন, যদিও সম্প্রতি ওবিসি সংরক্ষণের বিপক্ষে কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে সেই আশা অন্তর্হিত হতে বসেছে। প্রায় সাত মাস হয়ে গেলেও, এখনও পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হয়নি এ ব্যাপারে। এর মধ্যে হাজার হাজার পড়ুয়াকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্ছিত হতে হল।
এ ছাড়া নানা রাজ্যে পোশাক বা খাওয়াদাওয়াকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভিন্ন রাজ্যে পাড়ি দেওয়া পরিযায়ী শ্রমিকরা হেনস্থার শিকার হচ্ছেন, এমনকি খুনও হচ্ছেন। অথচ বৃহত্তর সমাজ, সমাজ ও সংবাদমাধ্যমে অদ্ভুত ভাবে নিশ্চুপ। যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি)-র বৈঠকে সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত কাটার দুর্ঘটনা না ঘটলে হয়তো দেশের এক বড় অংশ জানতেনও না, ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল নিয়ে সংসদে আলোচনা চলছে। একই ভাবে ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তর সমাজের নীরবতাও আশ্চর্য উদ্বেগজনক। অসাম্য এবং অন্যায়গুলিকে দূর করার কাজে ধৈর্যশীলতা সাহায্য করে না। অমর্ত্য সেনের কথা মনে করি, গণতন্ত্রের জন্য ধৈর্যের বাঁধ ভাঙাটা দরকার।