কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দিতে কি রাজ্য সরকারগুলি বাধ্য? একেবারেই নয়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রথমেই একটা বিষয় স্পষ্ট করে বলি। নৈতিকতা এবং আইন— এই দুটো জিনিস বেশির ভাগ সময়েই একসঙ্গে চলে না। চলতে পারে না। দৈনন্দিন জীবনে যে বিষয়কে নৈতিক বলে মনে হয়, আইন দ্বারা স্বীকৃত না হলে কোর্ট-কাছারিতে তা সিদ্ধ বলে গণ্য করা হয় না। আবার অনেক সময়ে দেখা যায়, সাধারণ জীবনে যে বিষয়টি অনৈতিক, তাকে আইনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ফলে মহামান্য আদালত সেই আইনকে অনুসরণ করে। এবং বিষয়টিকে আইনি মান্যতা দেয়। কাজেই নৈতিকতা এবং আইন সব সময় একসঙ্গে চলতে পারে না। আইনি স্বীকৃতি না থাকলে কোনও নৈতিকতাই আদালতে ‘মান্যতা’ পাবে না।
যেমন এই মহার্ঘ ভাতা (ডিএ)-র বিষয়টি। আপাত ভাবে এই ভাতা সংক্রান্ত দাবিকে অনেকেই নৈতিক বিষয় বলে মনে করছেন। কিন্তু এর আইনি স্বীকৃতি আছে কি? কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দিতে কি রাজ্য সরকারগুলি বাধ্য? মহার্ঘ ভাতা কি সরকারি কর্মচারীদের অধিকার? আইন বলছে, মোটেও নয়!
সরকার যখন কর্মচারী নিয়োগ করে, সেই সময় চাকরির একটি শর্তাবলি দেওয়া হয় কর্মীদের। চাকরির সেই শর্তাবলিতে প্রতি বছর বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট)-র কথা উল্লেখ থাকে। যা সরকার তার কর্মীদের দিতে বাধ্য। কিন্তু ওই শর্তাবলিতে মহার্ঘ ভাতা সংক্রান্ত কোনও উল্লেখ থাকে না। কারণ, এক এক বছর এক এক রকম হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। আগে থেকে সেটা ঠিক করা যায় না। এমনকি, পাওয়া যায় না তার কোনও স্পষ্ট আভাসও। তাই চাকরির শর্তাবলিতে ওই হারের উল্লেখ থাকে না। সে কারণেই মহার্ঘ ভাতার কথা চাকরির শর্তাবলির পাশাপাশি সরকারি চাকরি সংক্রান্ত আইনেও থাকে না। তাই চাকরি জীবনে মহার্ঘ ভাতা পাওয়ার অধিকার থাকে না কর্মচারীদের।
কয়েকটি ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, চাকরির শর্তাবলিতে ডিএ-র উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু তার হার কোনও ভাবেই উল্লিখিত নেই। সেটা উল্লেখ করা কোনও সরকারের পক্ষে যদিও সম্ভবও নয়। তবে এ প্রসঙ্গে একটা বিষয় বলে রাখা ভাল, যদি কোনও সরকার পক্ষ ঘোষণা করে অথবা আইন প্রণয়ন করে যে, তারা ডিএ দেবে, তা হলে কিন্তু সেটা তারা দিতে বাধ্য। ‘ফান্ডামেন্টাল রুল্স’ (মৌলিক নিয়ম)-এও একই কথা বলা হয়েছে। সেখানে ৪৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ডিএ আসলে ‘সহানুভূতি ভাতা’। যা সরকার পক্ষই ঠিক করবে। এবং সেই অনুযায়ী মহার্ঘ ভাতার ঘোষণা করা হবে। তবে তা বেতনের কত শতাংশ, তা ঠিক করবে সরকারই।
এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের একটি মামলার রায়ের উল্লেখ করা যেতে পারে। মধ্যপ্রদেশ সরকার বনাম জিসি মান্দোয়ারা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মেহেরচাঁদ মহাজনের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ ১৯৫৪ সালের একটি রায়ে মহার্ঘ ভাতা সম্পর্কে বলেছিল, ডিএ দেওয়াটা আসলে সরকারের ‘মহানুভবতা’। কোনও ভাবেই সেটি কর্মচারীদের অধিকার নয়। তাই সরকারি কর্মচারীদের একটি নির্দিষ্ট হারে ডিএ দেওয়ার দাবি বিবেচনা করা আদালতের এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না। ডিএ দেওয়ার বিষয়ে রাজ্য সরকারের কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। সরকার যদি ডিএ দেয়-ও, তা হলে তা সহানুভূতি ভাতা হিসাবেই গণ্য হবে। এবং গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করবে সরকারের উপর। আদালতের যে এই বিষয়ে রায় দেওয়ার কোনও এক্তিয়ার নেই, সে কথাও স্মরণ করিয়ে দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। আদালতের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, মহার্ঘ ভাতা পাওয়ার কোনও অধিকার সরকারি কর্মচারীদের নেই। যদি না সরকারের তরফে তা স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়।
প্রায় ৬৫ বছর পর একই রকম একটি রায় দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই রায়ের উল্লেখও এই লেখায় করা যেতে পারে। তামিলনাড়ু বিদ্যুৎ পর্ষদ বনাম টিএনইবি-থোঝিলালার আইকিয়া সঙ্গম মামলায় ২০১৯ সালের সেই রায়ে বলা হয়, সরকার যদি মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার ঘোষণা করে থাকে, তা হলে তা দিতে হবে। তবে আদালত যখন বিষয়টি বিচার করবে, তখন সরকারের আর্থিক ক্ষমতার দিকে নজর রাখতে হবে। ওই মামলায় শীর্ষ আদালত আরও বলে যে, কেন্দ্রীয় সরকার যে হারে মহার্ঘ ভাতা দিচ্ছে তার কর্মচারীদের, রাজ্যগুলিকেও সেই হারে ডিএ দিতে হবে, এমন কোনও আদেশ কোর্ট দিতে পারে না। যত ক্ষণ না পর্যন্ত ওই পরিমাণ ডিএ দেওয়ার ক্ষমতা রাজ্যের হচ্ছে, তত ক্ষণ অবধি আদালত কোনও পদক্ষেপও করতে পারবে না।
অতি সম্প্রতি কলকাতা হাই কোর্টের দুই বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ একটি রায়ে বলেছে, সরকার যদি ঘোষণা করে দেয় যে তারা ডিএ দেবে, এবং কতটা দেবে সেটাও যদি ঘোষণা করে থাকে, তা হলে সেই ঘোষণাপত্রকে মান্যতা দিয়ে ওই পরিমাণ মহার্ঘ ভাতা কর্মচারীদের দেওয়া উচিত। সেই অনুযায়ী, ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, ঘোষিত ভাতা কর্মচারীদের দিয়ে দেওয়া হোক।
ডিএ মামলা এর আগে স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল (স্যাট) এবং হাই কোর্ট ঘুরে এখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। আমার জানা নেই, ডিএ মামলার শুনানিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের এই সব রায়ের কথা উল্লেখ করেছেন কি না! যদি তাঁরা তা করে থাকেন, তা হলে মামলা এত দূর গড়ানোর কথা নয়। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী এখন যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে মহার্ঘ ভাতার হার এবং পরিমাণ দুই-ই সরকার নির্ধারণ করবে। এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ডিএ পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনও বিশেষ অধিকার নেই। যদি না সরকার আগে থেকে কোনও ঘোষণা করে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকারের হারে ডিএ পাওয়ার কোনও আইনি স্বীকৃতিই নেই রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের। সবটাই রাজ্য সরকারের উপরে নির্ভর করবে। সরকারের চাওয়ার উপর নির্ভর করবে। এবং বিষয়টি সরকারের আর্থিক সক্ষমতার উপর নির্ভর করবে। আমার মতে, বিষয়টি ঠিক করে দেওয়াটা একেবারেই আদালতের এক্তিয়ারভুক্ত নয়।
(লেখক প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক তথা কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবী। মতামত নিজস্ব।)