২০২০ সালে তৈরি হয় পশ্চিমবঙ্গ দলিত সাহিত্য আকাদেমি। এর আগে মহারাষ্ট্র-সহ ভারতের একাধিক রাজ্যে অনুরূপ আকাদেমি গঠিত হয়েছে। এর কাজ হল পশ্চিমবঙ্গের দলিত সাহিত্যের ক্রমবিকাশ নিয়ে কাজ করা। বিভিন্ন জেলার দলিত লেখকদের লেখা জোগাড়, লাইব্রেরি তৈরি, প্রকাশনা বিভাগ খোলা, আগে প্রকাশিত যে সব বই এখন আর পাওয়া যায় না তার সঙ্কলন তৈরি, অনুবাদ প্রকাশ, গল্প-কবিতা পাঠ ও আলোচনার আসর, বইমেলা আর লিটল ম্যাগাজ়িন মেলায় দলিত সাহিত্যের স্টল করা ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে কিছু কাজ শুরু হয়ে গেছে। গত ১৪ থেকে ১৭ এপ্রিল, ২০২২ রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গ দলিত সাহিত্য আকাদেমি আয়োজিত ‘দলিত সাহিত্য উৎসব ও পশ্চিমবঙ্গ দলিত সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার প্রদান’। শুরু থেকেই এই আকাদেমির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। এই সাহিত্য উৎসবকে ঘিরে আরও এক বার এই বিতর্ক দানা বাঁধল। সাহিত্যে আবার দলিত-অদলিত বিভাজন কিসের? মূলত এই প্রশ্নই তুলেছেন অনেকে।
প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটা ছোট্ট সমীক্ষা দরকার বলে মনে হল। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি গত কয়েক দশক ধরে আয়োজন করছে একটা বার্ষিক উৎসব। ‘সাহিত্য উৎসব ও লিটল ম্যাগাজিন মেলা’। ২০২২ সালের ২৩ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি এই উৎসব রবীন্দ্রসদন চত্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর অনুষ্ঠানসূচিতে চোখ রাখলে দেখা যাবে প্রায় পাঁচশো জন লেখক-কবি এখানে অংশগ্রহণ করেছেন। এঁদের মধ্যে মাত্র কয়েক জনের পদবির উল্লেখ নেই। বাকিদের পদবিগুলোকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ: চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায়, চক্রবর্তী-সহ আর যে যে পদবি দেখে নিশ্চিত ভাবে বোঝা যায় যে এই সব ব্যক্তি ব্রাহ্মণ। দ্বিতীয় ভাগ: দাশগুপ্ত, সেনগুপ্ত, সেন ইত্যাদি, অর্থাৎ বৈদ্য বলে পরিচিত পদবি। তৃতীয় ভাগ: ঘোষ, বসু, দত্ত, মিত্র, গুহ, এই পাঁচ কুলীন কায়স্থ বলে পরিচিত পদবি। চতুর্থ ভাগ: রায়, রায়চৌধুরি, চৌধুরি, ঠাকুর, অধিকারী, মজুমদার ইত্যাদি উপাধিপ্রাপ্ত পদবি। পঞ্চম ভাগ: যা যা পদবি বাকি পড়ে রইল (সরকার, বিশ্বাস, সিংহ, পাল, দে, দাস, খাতুন, হোসেন, মণ্ডল ইত্যাদি)। যদি কেউ বসুরায় বা গুপ্তরায় হন, তাঁকেও চতুর্থ ভাগে রেখে সামগ্রিক হিসাব করে দেখা গেল, প্রথম চারটে ভাগেই পড়ে যাচ্ছেন ৫৭% লেখক-কবি। বাকি ৪৩% পড়লেন পঞ্চম ভাগে।
হিসাবটা পুরো শুদ্ধ কিংবা সম্পূর্ণ হওয়া মুশকিল। এই স্পষ্টাস্পষ্টি ভাগাভাগির মধ্যে ব্যতিক্রম বা বিশেষ কিছু উদাহরণ থাকবেই, তবে মনে হয় তাতে বড় কোনও তারতম্য হবে না। তা হলে আমরা ধরে নিতে পারি, ওই অনুষ্ঠানে যোগদানকারী কবি-লেখকদের বিরাট অংশই তা হলে সমাজের উচ্চবর্ণ গোষ্ঠীভুক্ত। পরিষ্কার করা দরকার যে, এখানে কিন্তু অন্য কোনও ধরনের পরিস্থিতির হিসাব নেওয়া হচ্ছে না, কেবল বর্ণ-পরিচয়ের কথাটাই ভাবা হচ্ছে, কেননা সেই বর্ণের ভিত্তিতেই সামাজিক বাস্তবে কোনও বৈষম্য থাকে কি না, এখানে মূল প্রশ্ন হওয়ার কথা এটাই।
২০০১ সালের সেনসাস রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে ২৩% এসসি, ৫.৫% এসটি। এর পরও বিপুলসংখ্যক ওবিসিরা আছেন। সম্প্রতি একটি ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ (‘বেঙ্গল হ্যাজ়ন’ট প্রোডিউসড আ জগজীবন রাম অর ইভন আ মায়াবতী’) এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গের ৬৮% মানুষ অনগ্রসর শ্রেণির। ২৩% এসসি, ৬% এসটি, ৩৯% ওবিসি। তা হলে এই ৬৮% অনগ্রসর মানুষদের থেকে কত জন আসার সুযোগ পেলেন ‘সাধারণের সাহিত্য উৎসব’-এ? না কি বাকি ৩২%-ই জায়গা দখল করে রাখলেন এই ‘সাধারণের সাহিত্য উৎসব’ প্রাঙ্গণে? নিশ্চয়ই উপরের ছোট সমীক্ষা থেকে অন্তত একটা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে। যাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন ‘সাহিত্যে আবার দলিত-অদলিত বিভাজন কিসের’, তাঁরা কি একটু দেখবেন সংখ্যাগুলি?
অনেকে বলতে পারেন, আমাদের সমাজে আজও অনগ্রসর গোষ্ঠীগুলির থেকে অগ্রসর বলে পরিচিত গোষ্ঠীর মানুষেরা ‘মেধা’য় এগিয়ে। আর ‘মেধা’ দিয়েই তো এই সংখ্যার তারতম্যের বিচার হওয়া উচিত। এই যুক্তিতে একটা বড় রকমের অস্বস্তি কিন্তু থেকেই যায়। বহু যুগ ধরে জাতিভেদ প্রথাকে কেন্দ্র করে সমাজে যাঁদের উপর শোষণ চলে আসছে, যাঁরা সমাজের বহু সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদের ‘মেধা’ বিকাশের সুযোগে যে কিছু অন্তরায় থাকবেই, এই কি স্বাভাবিক নয়? সে কি দু’-এক প্রজন্মেই কেটে যাওয়ার কথা? কিন্তু কবে সেই তারতম্য কাটবে, তার জন্য কি তাঁদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হবে? বিশেষত সাহিত্যক্ষেত্রে?
এই সব ভেবে মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গ দলিত সাহিত্য আকাদেমি গঠনের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে অজস্র সাধুবাদ জানানোই জরুরি। আকাদেমির কাজ ভাল ভাবে এগোক, এই শুভেচ্ছাই থাকুক, সমস্ত সমাজের পক্ষ থেকে।