অমর্ত্য সেন লিখেছিলেন, আমরা সবাই তর্কনিষ্ঠ। আমরা আন্তরিক ভাবে এবং নিষ্ঠা-সহ তর্ক করি। এবং সেই কারণে আমরা সহজাত ভাবে হিংসাপ্রবণ নই। আমরা তর্ক করতে ভালবাসি, কথা বলতে ভালবাসি। তিনি রাজা রামমোহন রায়ের গান উদ্ধৃত করে বলেছেন: “মনে করো শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর, অন্যে বাক্য কবে কিন্তু তুমি রবে নিরুত্তর।” তর্কপ্রিয় ভারতীয়ের কাছে এ যেন মৃত্যুর সংজ্ঞা: সবাই কথা বলছেন, কিন্তু আপনার উত্তর দেওয়ার সাধ্য নেই। আপনি বাক্যহারা। কী ভয়ঙ্কর!
কিন্তু সত্যিই কি আমরা তার্কিক? আমরা কি অমর্ত্যবাবুর সঙ্গে একমত? শেক্সপিয়রের জুলিয়াস সিজ়ার নাটকের একটি অংশ মনে পড়ছে। সিজ়ারকে গুপ্তহত্যা করার পর ব্রুটাস এবং সহ-ষড়যন্ত্রকারীরা এসেছেন বক্তৃতা মঞ্চে। ব্রুটাস একটি চমৎকার ভাষণ দিলেন। বললেন, সিজ়ারকে আমি ভালবাসতাম কিন্তু রোমের প্রতি আমার ভালবাসা আরও গভীর, সিজ়ার রাজা হতে চেয়েছিল এবং সিজ়ার রাজা হলে আমাদের প্রজাতান্ত্রিক আদর্শ ধুলায় লুটিয়ে যেত! সেই দীর্ঘ ভাষণ শোনার পর তৃতীয় নাগরিক চিৎকার করে বললেন: ব্রুটাসকেই রাজা করা হোক (‘লেট হিম বি সিজ়ার’)। এই একটি সংলাপেই নাট্যকার পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন যে, ব্রুটাসের অত কঠিন তত্ত্বকথা সাধারণ জনগণ বোঝেনি। সাত কাণ্ড রামায়ণ শুনে বলেছে ব্রুটাসকেই সিজ়ার বানাও।
যখন অমর্ত্যবাবু কোনও বক্তব্য পেশ করেন, তখন তো আমরা তা বিশ্লেষণ করে দেখব? না কি তাঁর অন্ধ ভক্ত সেজে বলব: ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ঠিক!’ তিনি কিছু কাল আগে বলেছিলেন: “রাহুল গাঁধী এক দিন ভাল প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন।” সবিনয়ে বলছি, আমি তাঁর সঙ্গে এই বিষয়ে একমত নই। এবং তাঁর এক জন অনুরক্ত, তর্কনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে এটা আমার অধিকার।
ছেলেবেলায় যখন গড়িয়াহাট যেতাম, তখন একটি কেক-মিষ্টির দোকানে দেখতাম, রবীন্দ্রনাথের একটি বাণীসম্বলিত বিশাল চিত্র। সেই বাণীতে তিনি বলছেন সেই দোকানের পয়োধি তাঁর প্রিয়! কিন্তু পয়োধি আমার আদৌ পছন্দের ছিল না। আমার ভাল লাগত অন্য এক দোকানের ঘন মিষ্টি দই। তা হলে কি আমি কবিগুরুর অবমাননা করতাম? আমি ওই কোম্পানির চানাচুর খাব না সেই দোকানের ডালমুট, তা কি আমি নোবেলজয়ী কৈলাস সত্যার্থীর পরামর্শ নিয়ে ঠিক করব?
কিছু দিন আগে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, একটি বিশেষ জাতের গরুর দুধে সোনা থাকে। এই কথার বৈজ্ঞানিক কোনও ভিত্তি নেই! রাসায়নিক পরীক্ষা করলেই প্রমাণ হবে, এই উক্তির কোনও সারবত্তা নেই। হিন্দু ধর্মের কোনও শাস্ত্রে বা পুরাণে এই দাবি করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। অতএব বিতর্ক হবে, সত্যানুসন্ধান হবে এবং বিজ্ঞান নির্ণয় করবে এই দাবি ঠিক না বেঠিক। অন্ধ বিশ্বাস নয়।
অন্য দিকে, ডাক্তার জ়াকির নাইক বলেছেন, উটের দুধ এবং মূত্র মিশিয়ে সেবন করলে নাকি নানা প্রকার রোগ নিরাময় হয়। দিলীপবাবুর তত্ত্ব ভুল হলে সোনা নাগালের বাইরে চলে যাবে, বড় জোর মনস্তাপ হবে। কিন্তু এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার জ়াকির নাইকের কথামতো উটের দুধ/মূত্র সেবন করে রোগের নিরাময় না হলে প্রাণসংশয়।
অবশ্যই সকলে এক ভাবে বিচার্য নন। যাঁরা নোবেল পুরস্কারজয়ী, তাঁরা আমাদের প্রণম্য এবং শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু তাঁরা যা বলেন, তা সবই আপ্তবাক্য হতে পারে না। মিলটন ফ্রিডম্যান নোবেলজয়ী জগৎ-বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ছিলেন! নোবেলবিজয়ী পল ক্রুগম্যানও। তাঁদের মতপার্থক্য এবং বিতর্ক পড়ে দেখুন। ক্রুগম্যান ফ্রিডম্যানের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, কিন্তু রাজনীতি এবং অর্থনীতির প্রেক্ষিতে তাঁরা দুই ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা! ক্রুগম্যান স্বীকার করেছেন যে, ফ্রিডম্যান এক জন ডাকসাইটে অর্থনীতিবিদ। কিন্তু ‘পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’ হিসেবে ফ্রিডম্যানের উক্তিকে তিনি বলেছেন, অতি-দক্ষিণপন্থী, এবং পল তাঁর তীব্র বিরোধী। যখন বিখ্যাত নোবেলজয়ীরাই একমত হতে পারেন না, তখন কোনও নোবেলজয়ীর অন্ধ ভক্ত হওয়ার যুক্তি নেই।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ফ্রিডরিখ হায়েক পুরস্কার প্রাপ্তির নৈশভোজে একটি অপূর্ব নাতিদীর্ঘ ভাষণ দেন: মনে করার কোনও কারণ নেই যে, এক জন ব্যক্তি যদি অর্থনীতিতে স্বতন্ত্র এবং মূল্যবান অবদান রেখে থাকেন, তা হলেই তিনি সর্বজ্ঞানী হয়ে গিয়েছেন, এবং সমাজের সমস্ত সমস্যা সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। সংবাদমাধ্যম সেই রকমই ভাবতে শুরু করে এবং শেষে নোবেলজয়ী নিজেও তাই বিশ্বাস করতে শুরু করেন। হায়েক আরও পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, অর্থনীতির নোবেলজয়ীদের দিয়ে একটি বিনয়ের শপথবাক্য পাঠ করানো প্রয়োজন। তাঁরা শপথ নিয়ে বলবেন, তাঁরা কখনও তাঁদের নিজস্ব পারদর্শিতার বাইরে কোনও প্রকাশ্য ঘোষণা থেকে বিরত থাকবেন।
চিরায়ত সত্য বলে কি কিছু আছে? তিনশো বছর আগে যখন কার্ল মার্ক্স প্রাশিয়ায় জন্মেছিলেন, তখন পৃথিবী, সমাজ, অর্থব্যবস্থা, যোগাযোগ প্রযুক্তি একেবারে ভিন্ন ছিল। তাঁর মতামত আজকে ধ্রুব সত্য বলে গ্রহণ করা যায় না। গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাস বলেছিলেন, এক নদীতে দুই বার অবগাহন অসম্ভব। যেই আমি এক ডুব দিয়ে উঠলাম, নদী বয়ে গেল, পরের বার ডুব দিলাম এক নতুন নদীতে।
বৌদ্ধ ধর্মে তাই বিতর্কের একটা ঐতিহ্য আছে। তর্কের মাধ্যমে সত্য আবিষ্কার করা বৌদ্ধ ধর্মের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যদি নতুন তথ্য আসে, নতুন সত্যের উন্মেষ ঘটে, তা হলে বুদ্ধের বাণীও শেষ কথা নয়। বিতর্ক এবং সত্যানুসন্ধানের ঐতিহ্য গুরুত্বপূর্ণ। কোনও পুঁথি, কেতাব বা শ্লোক ধর্মের শেষ কথা বলে না, তাই পরিবর্তন বৌদ্ধ ধর্মে অন্তর্নির্মিত।
প্রশ্ন না করলে, বিতর্কে নিযুক্ত না হলে অন্ধ ভক্তি আসে। যুক্তি, বুদ্ধি, বৈজ্ঞানিক চিন্তা আর মুক্ত চেতনাবোধ লোপ পায়! গালিলেও গালিলেই এক জন অটল এবং একনিষ্ঠ রোমান ক্যাথলিক ছিলেন। পোপের এবং চার্চের প্রতি তাঁর আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু তিনি এক জন বিজ্ঞানসাধক ছিলেন। তিনি কোপারনিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্বের সমর্থন করেন। পৃথিবী সূর্যের চার দিকে ঘোরে, এই তত্ত্বে চার্চ রুষ্ট হয়েছিল। সান্তা মারিয়া নভেলার প্রচারবেদিতে দাঁড়িয়ে ফাদার টমাসো কাচ্চিনি ব্যাখ্যা-সহকারে পৃথিবীর গতি সম্পর্কে গালিলেও-র মতবাদ বর্ণনা করেন। এর পর সেই মতবাদের ভিত্তিতে তাঁর বিচার করেন এবং ঘোষণা করেন যে, এগুলো ভয়ঙ্কর এবং ধর্মদ্রোহিতার শামিল। গালিলেও-র ধর্মসঙ্কট তাঁকে বিপর্যস্ত করেছিল, চার্চ রাখি না বিজ্ঞান রাখি, আর এই সংঘাতের প্রেক্ষিতে উনি সেই বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন: “কিন্তু তবুও পৃথিবী ঘোরে!”
প্রবাদে বলে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর। কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস কি আলোর দিশা দেখায়? শর্ট-কাট পরিত্যাগ করে বিতর্কের দূরপথেই তাই হোক আমাদের সত্যানুসন্ধানের দুর্গম যাত্রা!