জাল টিকাকাণ্ডের পান্ডা দেবাঞ্জন দেবকে নিয়ে চোখে পড়ল একটি শিরোনাম। মর্মার্থ, দেবাঞ্জন কি মনোরোগী? খটকা লাগার মতোই শিরোনাম। অথবা গভীরে ভাবার মতো! কাকে আমরা মনোরোগী বলে দেগে দিই? আলগা ভাবে বললে যা কিছু প্রচলিত ধারণা বা কার্যক্রমের বাইরে, তাকেই ‘পাগলামি’ তকমা দেওয়ার অপচেষ্টার শিকড় মনের গভীরে। ছাড় পান না সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সুপ্রতিষ্ঠিত সুশিক্ষিতেরাও। সে জন্যই সংবাদপত্রের শিরোনামের প্রতিধ্বনি কলকাতার পুলিশ কমিশনারের কণ্ঠে। তিনিও দেবাঞ্জনের কাজকে মানসিক বিকৃতি বলেই চিহ্নিত করলেন!
দেবাঞ্জন আইএএস অফিসার পরিচয়ে অন্তত দু’টি জাল টিকাকরণ শিবির থেকে হাজার জনকে ভুয়ো কোভিড টিকা দিয়েছেন। তাতে ওষুধের পরিবর্তে কী ছিল, তা নির্দিষ্ট বলা সম্ভব হয়নি আজও। গ্রহীতাদের শরীরে এখনও বিরূপ প্রভাব পড়েনি, সরকারি সূত্রে খবর এটুকুই।
দেবাঞ্জনকে পুলিশে ধরার পরই আশ্চর্য হয়ে দেখলাম একের পর এক প্রতারণার দৃষ্টান্ত। দিল্লির পাঁচতারা থেকে ধরা পড়লেন ভুয়ো সিবিআই অফিসার শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রেফতার হলেন সনাতন রায়চৌধুরী। তিনি সিবিআই বা কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ কৌঁসুলি, অথবা মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের উপদেষ্টা, এমন নানা জাল পরিচয় দিতেন। প্রত্যেকেই লক্ষ লক্ষ টাকার প্রতারক। অর্থাৎ, কাজ করেছেন সচেতন ভাবে। লোক ঠকিয়ে আর্থিক ও সামাজিক লাভ, সঙ্গে নানা সুযোগসুবিধে উপভোগই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য বলে মনে হয়। তা হলে কেন তাঁদের অপরাধ মনোরোগের বর্মের আড়ালে ঢাকার চেষ্টা হচ্ছে? তাতে কি অপরাধীর তালিকায় অচেতন ভাবে আমরাও শামিল হচ্ছি না?
বিপরীত উদাহরণও আছে। নীলরতন সরকার হাসপাতালে মোবাইল চুরির অভিযোগে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রহারে প্রাণ হারিয়েছিলেন কোরপান শাহ। পরে জানা যায় তিনি সত্যিই মানসিক রোগী এবং স্রেফ সন্দেহের বশে তাঁকে পিটিয়ে মারা হয়।
এক দিকে, নিরপরাধ কোরপানের মনোরোগ তাঁকে বাঁচাতে অপারগ। অন্য দিকে চলছে, মনোরোগীর তকমা দিয়ে দেবাঞ্জনের মতো অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা। দুই চরম বৈপরীত্যের মাঝে দাঁড়িয়ে এই সমাজ, যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে শ্রেণিচেতনা। দেবাঞ্জন, শুভদীপ বা সনাতন আসলে আমাদের শ্রেণির মানুষ— তাই কি এঁদের অপরাধী দাগাতে নিজেদেরই অস্বস্তি? মনোরোগের আড়াল খুঁজছি অজানতেই? আর শ্রেণির সুবাদেই বঞ্চিত কোরপানের মতো নিম্নবিত্ত সম্বলহীনেরা?
মানুষের স্বভাব নির্দিষ্ট পথ মেনে চলে। যখনই কোনও নিয়মের ব্যত্যয় হয়, তখনই তাকে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রবণতা মানুষের মধ্যে থাকে। দেবাঞ্জন, শুভদীপ, সনাতন যা করেছেন, তাকে সরাসরি প্রতারণা বলে। কেন তাঁদের কাজকে ‘ব্যতিক্রম’ বলে ধরা হবে, কেন মনোরোগের আড়ালে তা ঢাকার বা লঘু করে দেখানোর চেষ্টা চলবে? যা আমাদের বোধবুদ্ধির বাইরে, যে সব কাজ আমরা সচরাচর অভিজ্ঞতায় পাই না বা দেখি না, সে সব কাজকে মনস্তাত্ত্বিক মোড়কে দেখার প্রবণতা কেন গড়ে ওঠে?
এখানেই চোখে লাগে, দেগে দেওয়ার প্রবণতা। যেখানে আমরা সব ক্ষেত্রে যে কোনও রকম মার্কা বা ছাপ মেরে দেওয়ার বিরুদ্ধে কাজ করতে চাইছি, সেখানে এই প্রবণতা ভীষণ ক্ষতিকর। কিছু মনোচিকিৎসক টিভির প্যানেলে অনায়াসে ‘ডায়াগনসিস’ করে ফেলেন, ভাবেন না আসলে তাঁরা এ কাজের মধ্যে দিয়ে মনস্তত্ত্বকে কতটা নীচে নামাচ্ছেন! প্রথমত, মনোরোগ চিকিৎসা জাদুবিদ্যা বা অতিপ্রাকৃত বিদ্যা নয় যে, মুখ-চোখ দেখে বলা যায়! মনোচিকিৎসা বিজ্ঞান হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যমে এই ধরনের রোগের নাম বলা মনোচিকিৎসার নীতিবিরুদ্ধ। রোগীকে পরীক্ষা না করে রোগনির্ণয় মানবাধিকার লঙ্ঘন।
গণমাধ্যমে এ ভাবে অপরাধমূলক কাজকে মনোরোগ-প্রসূত হিসেবে ঢালাও তকমা দিলে আড়াল করা হয় প্রকৃত অপরাধীকেই। মনোরোগের নিরাপত্তায় তার হাত শক্ত হয়, সে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। আর অন্ধকারে তলিয়ে যাবেন প্রকৃত মনোরোগীরা।
দেবাঞ্জনের তরফে প্রচেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে। তাঁর উকিল আদালতকে জানিয়েছেন আগে নাকি কাউন্সেলিং করাতে হয়েছিল দেবাঞ্জনকে। পেশাদার মনোবিদ হিসেবে বলতে পারি, কাউকে কাউন্সেলিং করানোর প্রয়োজন হলেই, মনোবিদের কাছে যেতে হলেই, তিনি মনোরোগী হয়ে যান না। বরং, অপরাধ ঢাকতে মনোরোগের আড়াল খুঁজতে গিয়ে, আড়াল জোগাতে গিয়ে আমরা প্রকৃত মনোরোগীদের অসম্ভব ক্ষতি করে দিই। কারণ, আমরা বার বার প্রমাণ করি ‘ইনস্যানিটি’ এমন একটা বিষয়, যা বিলোপ হয় না। মনে রাখতে হবে ‘ইনস্যানিটি’ আইনি শব্দ। কিন্তু মানুষ ‘ইনস্যানিটি’কে মনোরোগ হিসেবেই পড়েন, বোঝেন।
দেবাঞ্জনেরা অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে অপরাধ করেছেন। এই চাতুর্যের মধ্যে বিশাল প্রশাসনিক ফাঁক রয়েছে। কী ভাবে সরকারি ব্যবস্থার দৃষ্টি এড়িয়ে দেবাঞ্জনেরা অপরাধ চালিয়ে গেলেন— তদন্ত চলুক। কিন্তু অপরাধের গায়ে মনোরোগের লেবেল সেঁটে সেই প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে আড়াল করার অপচেষ্টা ব্যক্তি ও সমাজের পক্ষে চরম ক্ষতিকর!