Inequality

ভাইরাস ও অসাম্যের অসুখ

পুনরুত্থান হচ্ছে ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের মতো, যার নীচের দিকে নির্দেশিত বাহু ইঙ্গিত করে গরিবদের আরও তলিয়ে যাওয়া।

Advertisement

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২২ ০৭:৩৭
Share:

করোনাভাইরাসের প্রসঙ্গে একটা সত্য আবার সামনে আসছে। ঐতিহাসিক ভাবেই অতিমারি যে কেবল অসাম্যকে প্রকটতর করে তা-ই নয়, সমাজের অন্তর্নিহিত অসাম্যই অতিমারির সৃষ্টি এবং বিস্তারের একটা বড় কারণ। অপুষ্ট, দরিদ্র, ঘিঞ্জি অঞ্চলে বসবাসকারী এবং স্বাস্থ্যবিধি মানা আর স্বাস্থ্য-পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে থাকা জনগণের মধ্য দিয়ে বেড়ে যায় সংশ্লিষ্ট অসুখের ‘বেসিক রিপ্রোডাকশন নাম্বার’, যা অতিমারির সলতেতে আগুনের ফুলকি জোগায়। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ এবং শ্রমবাজারের প্রভাবের কারণে দরিদ্র তলিয়ে যায় আরও দারিদ্রের সীমাহীন অন্ধকারে। উল্টো দিকে ধনীদের সম্পদ ওঠে ফুলে-ফেঁপে।

Advertisement

কোভিড অতিমারির ছোবল-কালে পৃথিবীর ইতিহাসে অসাম্য এখন শীর্ষবিন্দুতে। দেশে দেশে ভ্যাকসিনের বণ্টন সেই বৈষম্যকে আরও প্রকট করেছে। আবার বিভিন্ন দেশেই অতিমারিতে সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়া অর্থনীতির পুনরুত্থান হচ্ছে ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের মতো, যার নীচের দিকে নির্দেশিত বাহু ইঙ্গিত করে গরিবদের আরও তলিয়ে যাওয়া।

অক্সফ্যামের এ বছরের রিপোর্টের শিরোনাম—‘ইনইকোয়ালিটি কিলস’। নজিরবিহীন অর্থনৈতিক অসাম্য কী ভাবে ডেকে আনে মৃত্যু, এই রিপোর্ট তার ধারাবিবরণী। অর্থনৈতিক বিভাজন বাড়িয়ে তোলে অনাহার, স্বাস্থ্য পরিচর্যার অভাব, জলবায়ু বিপর্যয়, আর্থিক কারণে লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা। ফলে বেড়ে চলে মৃত্যুর সংখ্যাও। পৃথিবীতে যদি আরও সমতা থাকত, তা হলে নাকি প্রতি দিন ২১ হাজারের বেশি সংখ্যক মানুষের কম মৃত্যু ঘটত।

Advertisement

এই রিপোর্টে ভারতের সম্পূরক অংশে প্রকাশ পেয়েছে, ২০২১-এ এ দেশের বিলিয়নেয়ারদের সম্পত্তি বেড়েছে ৩৯%, আর গরিবদের বাৎসরিক আয় কমেছে ৫৩%। ধনীতম ৯৮ জনের মোট সম্পত্তির পরিমাণ নীচের দিকের সাড়ে ৫৫ কোটি মানুষের সমান! আসলে অতিমারিতে বিশ্ব জুড়েই ধনীদের সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে অশালীন ভাবে। পৃথিবীর ধনীতম দশ জনের সম্পদের পরিমাণ হয়েছে দু’গুণেরও বেশি। কারণ অনেক। ধনীরা অতিমারি পরিস্থিতি অনুসারে ঠিক পথে টাকা বিনিয়োগ করে ফল পেয়েছেন। সেই সঙ্গে দেশ-বিদেশের সরকার ঝিমিয়ে-পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে যে ডলার ঢেলেছে অর্থনীতিতে, তা স্টক মার্কেটকে গরম করে সাহায্য করেছে ধনীদেরই। আবার এ সময়ে দেশ-বিদেশের ব্যাঙ্কের নীতি, যেমন শূন্য সুদে ঋণ, ইত্যাদিও ধনীদের সম্পদ ফুলে-ফেঁপে উঠতে সাহায্য করেছে নিশ্চয়ই। ধনীদের স্থাবর সম্পত্তির দামও বিপুল ভাবে বেড়েছে এই বাজারে। উল্টো দিকে রয়েছে বেড়ে চলা সীমাহীন দারিদ্র। ৯৯% মানুষের রোজগার কমেছে। রোজগার হারিয়েছেন অগণিত মানুষ। লকডাউন, অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের দফারফা, ছাঁটাই, এবং সেই সঙ্গে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার ফলে পর্যটনের সর্বনাশ হয়ে বিশ্ব জুড়ে অন্তত ১৬ কোটি মানুষ ঢুকেছেন দারিদ্রের কৃষ্ণগহ্বরে।

এই অসাম্যের জন্যে ধনীদেরই দায়ী করা মুশকিল। অস্বীকার করা যাবে না যে, ব্যবস্থাগত ব্যর্থতাতেই কিছু মানুষ অশ্লীল ভাবে ধনী হতে পারেন, যেখানে অনেকের কাছেই দিনযাপনের ন্যূনতম পণ্য থাকে না। ধনীদের উপর কর বাড়িয়ে অর্থ সংগ্রহ করে এই অসাম্য কমানোর প্রস্তাবও এসেছে। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর অনলাইন দাভোস কনফারেন্সের সময় যোগদানকারীদের একটি খোলা চিঠি দেন দেশ-বিদেশের ১০২ জন অতি-ধনী, যাঁদের মধ্যে আছেন আবিগেল ডিজ়নি-র মতো সেলেব্রিটি— “আমাদের মতো ধনীদের কাছ থেকে কর নেওয়া হোক, এখনই”, লিখেছেন তাঁরা।

বছরখানেক আগে এক গবেষণাপত্রে অর্থনীতিতে নোবেলবিজয়ী অ্যাঙ্গাস ডিটন দেখিয়েছেন, কোভিড-কালে গরিব দেশগুলোর তুলনায় ধনী দেশগুলোতে মাথাপিছু মৃত্যু বেশি হয়েছে; তাদের উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা, উচ্চ আয়, সক্ষম সরকার এবং ভাল প্রস্তুতি সত্ত্বেও। এই দেশগুলিতে মাথাপিছু আয় বেশি কমেছে। ডিসেম্বরে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ল্যাবের ওয়ার্ল্ড ইকনমিক রিপোর্ট ২০২২ মনে করিয়েছে, পৃথিবীর ধনীতম ১০%-এর হাতে রয়েছে ৫২% রোজগার, আর নীচের দিকের অর্ধেক মানুষ আয় করেন মাত্র ৮.৫%। ভারতকে বলা হয়েছে এক দরিদ্র অসম দেশ। এ দেশের উপরতলার ১%-এর হাতে রয়েছে ২১.৭% রোজগার, নীচের অর্ধাংশের রোজগার মাত্র ১৩.১%। যদিও এত নিখুঁত হিসাব নিয়ে সংশয় থাকে। বিশেষত ভারতের কোনও সরকারি আয়-সমীক্ষার তথ্য নেই, শেষ কনজিউমার এক্সপেন্ডিচার সার্ভের তথ্যও এক দশকের পুরনো। হিসাবগুলি অনেকটাই অনুমান-নির্ভর। কিন্তু ক্রমবর্ধমান অসাম্য নিয়ে দ্বিমত পোষণের জায়গা নেই। গোটা বিশ্বে। ভারতেও। বিশ্বে নারী-পুরুষের ক্ষমতায়নের যে পার্থক্য ছিল ৯৯ বছরের, অতিমারি নাকি তা এক ধাক্কায় প্রশস্ত করে দিয়েছে— ১৩৫ বছর। অর্থাৎ, নারী-পুরুষের কাঙ্ক্ষিত সমতা আসতে লাগবে আগের হিসাবের চেয়ে এক প্রজন্ম বেশি।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement