Abhishek Banerjee

ক্ষমতা যে ভাষায় কথা বলে

বিজেপির ‘নবান্ন অভিযান’-এর পরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, তাঁর সামনে অগ্নিসংযোগ, আক্রমণের ঘটনা ঘটলে তিনি ‘মাথার উপরে’ গুলি করতেন।

Advertisement

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:২৮
Share:

তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।

মস্ত একটা কাজ করলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। জনতা জনার্দনের কথা তো অনেক হ‌য়েছে। তাদের উপকারের কথা, উত্তরণের কথা, কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা তো অভিষেক ও তাঁর দলীয় নেতৃত্ব বলেই থাকেন। কিন্তু মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি যা বলেছেন, তাতে একটা ব্যাপার অন্তত বুঝে নেওয়া গেল— ক্ষমতা ও দম্ভের কথা রাষ্ট্রশক্তি চোখে চোখ রেখেই বলেছে।

Advertisement

অভিষেককে রাষ্ট্রশক্তির প্রতিনিধি হিসাবেই দেখা বিধেয়। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তিনি— রাজ্যে পুলিশ-প্রশাসনের উপরে তাঁর যথেষ্ট প্রভাব থাকাই স্বাভাবিক। তিনি এক জন সাংসদও বটে। তাই সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার দায় অন্য অনেকের থেকেও তাঁর অনেক বেশি। বিজেপির ‘নবান্ন অভিযান’-এর পরে সেই তিনি বললেন, তাঁর সামনে অগ্নিসংযোগ, আক্রমণের ঘটনা ঘটলে তিনি ‘মাথার উপরে’ গুলি করতেন। ‘মাথার উপরে’ মানে কিন্তু মাথার উপর দিয়ে চলে যাওয়া বুলেট নয়। আঙুল দিয়ে কপালের মাঝ বরাবর দেখিয়ে পুলিশি বুলেটের লক্ষ্যস্থল একেবারে স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, হিংসাত্মক ঘটনার সময় অবাধ্য জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কী কী ব্যবস্থা করে, তা অভিষেকের অজানা। লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, জলকামান, রবার বুলেট— পুলিশের হাতে অস্ত্র কিন্তু কম নয়। তার পরেও পরিস্থিতি আয়ত্তে না এলে কী করার থাকে? পুলিশ রেগুলেশনেই আছে, সে ক্ষেত্রে একেবারে শেষ আশ্রয় হিসেবে ‘ন্যূনতম শক্তি’ (মিনিমাম ফোর্স) প্রয়োগ করে হাঁটুর নীচে গুলি করতে পারে পুলিশ। এমনকি, ‘আত্মরক্ষার্থে’ পুলিশ যদি কাউকে গুলি করে মারে, সে ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট পুলিশকর্মী বা নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানের বিরুদ্ধে আগে খুনের মামলা দায়ের করতে হবে। তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে, আত্মরক্ষার্থেই তিনি গুলি চালিয়েছিলেন। এই মর্মে সুপ্রিম কোর্টের রায় আছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নির্দেশিকাও তেমনই।

Advertisement

‘নবান্ন অভিযান’-এর দিন বিজেপি গণতান্ত্রিক ভাবে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে, এমন দাবি করা কঠিন। সংঘর্ষে বেশ কয়েক জন পুলিশকর্মীও আহত হয়েছেন। ভিডিয়ো ক্লিপিং-এও দেখা গিয়েছে, কী ভাবে পুলিশকে লাঠি, বাঁশ নিয়ে তাড়া করে মারা হচ্ছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশকে কড়া ব্যবস্থা করতেই হত।

হামলায় আহত পুলিশকর্মীদের এক জন, কলকাতা পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার দেবজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন অভিষেক। বেরিয়ে বললেন: “আমি দেবজিৎবাবুকে বললাম, আমি আপনাকে স্যালুট জানাই যে, আপনি কিছু করেননি। আপনার জায়গায় যদি আমি থাকতাম আর আমার সামনে যদি পুলিশের গাড়িতে আগুন জ্বলত বা পুলিশের উপরে এই ভাবে হামলা হত, তা হলে আমি এইখানে শুট করতাম (কপালের মাঝ বরাবর দেখিয়ে), মাথার উপরে।”

মনে পড়ল প্রয়াত জ্যোতি বসুর কথা। তরুণ বামপন্থীদের অনেকের হয়তো সে ইতিহাস অজানা। রাজ্যে বাস-ট্রামের ভাড়া বাড়া ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৯৯০-এর ৩১ অগস্ট পথে নামেন এসইউসিআই এবং আরও ১১টি বামপন্থী দলের সদস্যরা। গন্ডগোল বাধে। রানি রাসমণি রোডে তাঁদের মিছিলে পুলিশের গুলি চলে। মারা যান মাধাই হালদার নামে এক যুবক। জখম হন বেশ কয়েক জন। সে দিনই এসপ্ল্যানেড ইস্টে এক জনসভায় জ্যোতিবাবু বলেন, “কংগ্রেস, এসইউসিআই এবং নকশালপন্থীরা আন্দোলনের নামে পুলিশের উপর আক্রমণ শুরু করার পরেই পুলিশ গুলি চালিয়েছে। গুলিতে এক জন মারা গিয়েছেন। এ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন নয়। কোনও সরকার ও সব বরদাস্ত করবে না। ...ওরা হয়তো ভাবল, পুলিশ তো কিছুই করছে না, তা হলে তো আন্দোলন নিরামিষ হয়ে যাবে। একটু আমিষ করা দরকার।” সে দিন ক্ষমতার ভাষা ব্যবহার করেছিলেন জ্যোতিবাবু।

১৯৫৯ সালের ৩১ অগস্ট শুরু হয়েছিল ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন। সে দিনের আন্দোলন রুখতে নির্বিচারে লাঠি-গুলি চালিয়েছিল কংগ্রেস সরকার। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ওই আন্দোলনকে উড়িয়ে দেন ‘নিছক গুন্ডামি’ বলে। ক্ষমতার ভাষা প্রয়োগ করেছিলে‌ন বিধানবাবুও। আর আজ, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সেই ক্ষমতার ভাষার প্রয়োগই কি দেখা যাচ্ছে না? অবশ্য অনেক বেশি পরিণত মননের পরিচয় দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, “পুলিশ ইচ্ছা করলে গুলি চালাতে পারত। সেটা কাম্য নয়। পুলিশ সংযত থেকে শান্তিপূর্ণ ভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছে।”

‘সংযম’ দেখানোর জন্য অবশ্য পুলিশকে ‘কুর্নিশ জানিয়েছেন’ অভিষেকও। তবে, তার আগে যে বার্তা তিনি দিয়ে দিয়েছে‌ন, বর্ষে বর্ষে দলে দলে ক্ষমতার মুখ থেকে সেই বার্তাই পেয়ে এসেছে পুলিশ। এই ধরনের বার্তাই তাদের করে তোলে ‘ট্রিগার হ্যাপি’।

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চয়ই জানেন যে, পুলিশ ও আমলাতন্ত্র আসলে কারও ‘নিজের’ হয় না। বিক্ষুব্ধ, বা আন্দোলনকারী নাগরিকের উপর পুলিশ গুলি চালালে যে শাসকরা তার ন্যায্যতার পক্ষে সওয়াল করেছেন, ইতিহাস সাক্ষী যে, পুলিশ তাদেরও আপন হয়নি। হতে পারে না, কারণ দিনের শেষে পুলিশ আসলে ক্ষমতাসীনের। ফলে, পুলিশকে দেওয়া কোনও বার্তা ভবিষ্যতে যাতে বুমেরাং না হয়, তা দেখাটাও কিন্তু জরুরি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement