হয় ‘আমার’, নয় শত্রু!
Mamata Banerjee

হেরে গিয়ে লুডোর বোর্ড উল্টে দেওয়া ছোটদের সাজে

বাংলায় পরাজয়ের বাস্তবতাকে মানতে না-পেরে বিজেপি দৃশ্যত দিশাহারা।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২১ ০৪:৫২
Share:

এ বার আমলা-পালা! মুখ্যসচিব হিসেবে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে জটিলতা যে ভাবে পাকিয়ে উঠেছে, এক জন উচ্চপদস্থ আমলার পক্ষে তা অবশ্যই বিড়ম্বনার। বিশেষ করে চাকরির শেষ ধাপে এসে আচমকা এমন পরিস্থিতি কেউই চাইবেন না। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর আইএএস-এর চাকরি করে আসা আলাপন তো নয়ই।

Advertisement

এক সময়ের সাংবাদিক, অনুজপ্রতিম আলাপনকে চল্লিশ বছর ধরে চিনি, এবং কাজের মধ্যেও দেখেছি। সে বরাবরই পদক্ষেপে সতর্ক। কেতাবের বাইরে পা ফেলার নজির গড়া ওর ধাতে নেই। নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে ‘খবর’ হয়ে ওঠার মতো বর্ণময়তাও সে আয়ত্ত করতে পারেনি। এখন এসে পড়ল শিরোনামে!

সরকারি চাকরির গোড়ায় আলাপন মহাকরণে আন্ডার সেক্রেটারি পদে কাজ করেছেন। আইএএস-দের জন্য নির্ধারিত এই পদটিকে বলা হয়, ‘স্টেট প্রোটোকল অফিসার’। সহজ কথায়, সরকারি প্রোটোকলের খুঁটিনাটি ঠিক ভাবে বজায় রাখা ওই পদের একটি বড় দায়িত্ব। তাই মুখ্যসচিব হয়ে সেই আলাপন প্রোটোকল মানবেন না, এটাই বা সহসা ধরে নিতে হবে কেন?

Advertisement

আসলে সবাই বুঝছেন, সমগ্র কাহিনিতে রাজনীতির গন্ধ খুবই উগ্র। আলাপন এখানে আলাদা কোনও বিষয়ই নয়। তাঁকে ‘বিষয়’ করে তোলার কারণ, রাজ্যটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবং আলাপন সেই সরকারের মুখ্যসচিব পদে ছিলেন।

লুডো খেলায় হেরে গেলে ছোটরা কখনও রাগ দেখিয়ে বোর্ড উল্টে ঘুঁটি এলোমেলো করে দেয়। আসলে সেটা তো হতাশার প্রকাশ। দিল্লির বিজেপি-প্রভুদের হয়েছে সেই দশা। তাঁরা বাংলায় পরাজয়ের বাস্তবতাকে মানতে না-পেরে দৃশ্যত দিশাহারা।

হাল্লা-র রাজা ঘোরের বশে ক্ষমতার দাপট দেখাতেন। কারও পেটে বর্শার খোঁচা দিতেন। কারও মাথার উপর ঘোরাতেন উন্মুক্ত খাঁড়া। আর তাঁর কানের কাছে কু-মন্ত্রণা দিয়ে যেতেন ক্ষমতালোভী, স্থূলবপু এক ষড়যন্ত্রীমশাই! সত্যজিৎ রায় আমাদের জন্য সেই সব ছবি সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।

দোহাই, বাস্তবের কোনও কিছুর সঙ্গে কেউ গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর ওই সব দৃশ্যের তুলনা টানতে চাইলে সেটা নিজ দায়িত্বে! তবে কেন্দ্রীয় শাসকবর্গের কার্যকলাপ দেখে অনুকম্পা হয়। সত্যিই ওঁরা বেচারা! বাংলায় তাঁদের ‘গরু’ হারিয়েছে!

মুখ্যসচিব-পর্ব কেন্দ্র করে গণতন্ত্র, শিষ্টাচার, প্রোটোকল ইত্যাদি শব্দ ফুলঝুরির মতো ফুলকি ছড়াচ্ছে। কিন্তু একটি ছোট্ট জিজ্ঞাসা। এখনও জানি না, শুনিনিও। তাই খুব জানতে ইচ্ছে করে।

তৃণমূল ভোটে জেতার পরে বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অথবা তাঁর কোনও সহযোগী সেনাপতি কি বিজয়ীকে কোনও শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন? দিল্লির সাউথ ব্লক, নর্থ ব্লক থেকে কোনও চিঠি, কোনও ফোন, কোনও অভিনন্দনের বার্তা কি নবান্নে পৌঁছেছিল? এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার কী বলে?

যত দূর জেনেছি, মোদীর সঙ্গে ভোটের পরে মমতার প্রথম চাক্ষুষ মোলাকাতের ক্ষেত্র ছিল কোভিড নিয়ে কিছু দিন আগের ভার্চুয়াল বৈঠক। সেখানেও অবশ্য প্রায় জোর করে মুখ্যমন্ত্রীদের উপস্থিতির অধিকার আদায় করতে হয়েছিল মমতাকেই। কারণ, প্রধানমন্ত্রী সরাসরি জেলাশাসকদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। এই রাজ্য তাতে প্রতিবাদ জানায়। এ তো গেল বিতর্কের দিক। কিন্তু বৈঠকে কী হয়েছিল? মুখ্যমন্ত্রীদের ডেকে এবং বসিয়ে রেখে সামান্য সম্ভাষণ করার ‘সৌজন্য’ দেখানো হয়নি প্রধানমন্ত্রীর তরফে।

এ বার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে কোভিড সংক্রান্ত ক’টি চিঠি লিখেছেন মমতা? মোদী ক’টির জবাব দিয়েছেন বা প্রাপ্তিস্বীকারটুকু করেছেন? যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় মুখ্যমন্ত্রী যদি শিষ্টাচার এবং প্রোটোকলে আবদ্ধ হন, তা হলে প্রধানমন্ত্রীও তা-ই। এটা কোনও দয়া বা করুণা নয়। প্রোটোকল। মোদী বা মমতা যিনিই তা ভঙ্গ করুন, একই রকম দোষের।

মুখ্যসচিব পদ থেকে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরানোর জন্য দিল্লি যা যা করল, এবং বিষয়টি যে জটিলতায় নিয়ে যাওয়া হল, তার নেপথ্যেও প্রোটোকল ভাঙার যুক্তি তোলা হচ্ছে। সবাই জানেন, সাইক্লোন পরিস্থিতি পর্যালোচনায় প্রধানমন্ত্রীর কলাইকুন্ডা বৈঠকে না-থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জেলার বৈঠকে চলে যাওয়াকে মুখ্যসচিবের প্রোটোকল-বিরোধী কাজ বলে মনে করছে দিল্লি।

বড় বড় পদে কাজ করে যাওয়া আমলারা অনেকেই অবশ্য বলেছেন, মুখ্যসচিবের প্রথম দায়বদ্ধতা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে থাকলে, বা তিনি কোনও বৈঠকে ডাকলে মুখ্যসচিবের সেই নির্দেশ মানাই সাধারণ প্রোটোকল। অতএব প্রধানমন্ত্রী এসেছেন বলে সেই কাজ ফেলে মুখ্যসচিবকে গলাবন্ধ কোট পরে দাঁড়াতে হবে, সেটা বাধ্যতামূলক নয়।

কলাইকুন্ডায় প্রধানমন্ত্রীকে রাজ্যের তরফে কারা স্বাগত এবং বিদায় সম্ভাষণ জানাবেন, সেই তালিকাও দিল্লিতে আগাম পাঠিয়ে দিয়েছিল নবান্ন। সেই মতো এক মন্ত্রী, জেলাশাসক ও পুলিশ সুপার ছিলেন সেখানে। প্রোটোকল ভঙ্গ বলা যাবে কি?

শোনা যাচ্ছে, তৎকালীন মুখ্যসচিব আলাপন সে দিনের বৈঠকে থাকেননি বলে তাঁর বিরুদ্ধে বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হয়েছে কেন্দ্র। কিন্তু ওই বৈঠক কি আক্ষরিক অর্থে বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের আওতায় ডাকা হয়েছিল? সেই বৈঠকে উপস্থিতির কোনও ‘নির্দেশ’ কি এসেছিল?

ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ দক্ষিণবঙ্গে আছড়ে পড়ে ২৬ মে। পর দিন, ২৭ মে, প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে প্রথমে নবান্নকে জানানো হয়, নরেন্দ্র মোদী ২৮ মে ওড়িশা সফর সেরে কলাইকুন্ডায় নেমে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। মুখ্যমন্ত্রী যেন সেই মতো নিজের কর্মসূচি ঠিক করেন। নবান্ন তার প্রস্তুতি নেয়। মোদীর জন্য দ্রুত ‘পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজ়েন্টেশন’ তৈরি করা হয়। যে অফিসার সেটি দেখাবেন, তাঁকেও রাজ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এর পরেই বেশি রাতে দিল্লি থেকে কয়েকটি নাম সম্বলিত একটি ‘সংশোধিত’ (রিভাইজ়ড) তালিকা পাঠিয়ে জানানো হয় যে, প্রধানমন্ত্রীর ‘রিভিউ মিটিং’-এ রাজ্যপাল, দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বিধানসভার বিরোধী দলনেতা থাকবেন। সেখানেও কোথাও ‘বিপর্যয় মোকাবিলা আইন’ অনুসারে মিটিংয়ের উল্লেখ করা হয়নি।

সন্দেহ নেই, বিরোধী দলনেতা অর্থাৎ বিজেপির ওই বিধায়কের সঙ্গে একত্রে বৈঠকে না-থাকার যে সিদ্ধান্ত মমতা নিয়েছিলেন, সেটা একেবারেই রাজনৈতিক। তা ঠিক ছিল কি না, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু অধিক রাতে ‘সংশোধিত’ তালিকার পিছনে কী ভাবনা কাজ করেছে, সেটাও কি প্রশ্নের বাইরে রাখা যায়? বিশেষত, হাতের কাছেই রয়েছে গুজরাতের টাটকা উদাহরণ। বাংলায় ‘ইয়াস’-এর আগেই ‘টাউটে’র কবলে পড়ে গুজরাত। প্রধানমন্ত্রী সেখানেও মিটিং করতে যান। কিন্তু ডাক পাননি বিধানসভার বিরোধী নেতা, যিনি কংগ্রেসের!

কলাইকুন্ডার বৈঠকে যোগ না-দিলেও মুখ্যসচিবকে নিয়ে ঘরে ঢুকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে, হাতে কাগজপত্র দিয়ে, দিঘায় নিজের নির্ধারিত বৈঠকের কথা তাঁকে জানিয়ে বেরিয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে মুজফ্‌ফরনগরে সাম্প্রদায়িক হিংসায় ৪৩ জনের মৃত্যুর পরে মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের ডাকা ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন কাউন্সিলের বৈঠকে যাননি গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

যা হোক, কলাইকুন্ডা থেকে মুখ্যমন্ত্রীর হেলিকপ্টার ছাড়ার মুহূর্তে ফের বার্তা আসে আলাপনের কাছে। প্রধানমন্ত্রীর অফিসার জানতে চান, তিনি কোথায়। মুখ্যসচিব যে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে, সেটা আবার বলা হয়। রাতেই দিল্লির চিঠিতে আলাপনকে নিয়ে শুরু হয় টানাপড়েন।

এই ঘটনা ক্যাডার-অফিসারদের উপর কী ভাবে কী প্রভাব ফেলবে, সেটা দেখার। তবে মমতার বাংলা ‘শত্রু-রাজ্য’ এবং তাঁর অফিসারেরা কেন্দ্রের শত্রু— এই ধারণা পুষ্ট হতে থাকলে সেটা হবে অন্য এক ‘জাতীয় বিপর্যয়’। শাসকবর্গ যত দ্রুত তা বোঝেন, ততই মঙ্গল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement