বিজেপির তীব্র মেরুকরণের রাজনীতির মধ্যেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী ভাবে এমন বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় ফিরলেন, সে বিষয়ে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন— যেমন, একগুচ্ছ জনমুখী কর্মসূচি, বিশেষ করে মেয়েদের উন্নয়নের নানা কর্মসূচির ফলে তৃণমূল কংগ্রেস জনসংখ্যার একটা বড় অংশের সমর্থন পেয়েছে। এই রাজনৈতিক সাফল্যের পিছনে আরও একটা কারণ সম্ভবত রয়েছে— এ বারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা তৃণমূল কংগ্রেসকে দু’হাত উজাড় করে ভোট দিয়েছেন। তার একটা কারণ বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতি, এবং সেই দল ক্ষমতায় এলে মুসলমানদের আরও বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা। অনেক মুসলমানই হয়তো মনে করেছিলেন যে, বিজেপির বিরুদ্ধে সিপিএম-কংগ্রেস-আব্বাস সিদ্দিকির জোট তেমন শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না।
এর পাশাপাশি বলা দরকার যে, এক দিকে বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্পের কারণে গরিব মুসলমানরাও সুবিধা পেয়েছেন, অন্য দিকে গত দশ বছরে সংখ্যালঘুদের জন্য রাজ্য সরকারের কয়েকটা উদ্যোগ নজর কেড়েছে। যেমন, মুসলমানদের জন্য ওবিসি সার্টিফিকেট প্রদান— যদিও এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল বাম আমলে। এ ছাড়া বলতে হয় আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিপুল বরাদ্দ এবং সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষা বৃত্তির ব্যাপক প্রসারের কথা। চলতি বছরে রাজ্যে প্রায় ৩৭ লক্ষ সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রী এই শিক্ষা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন, জাতীয় স্তরে এই সংখ্যাই সর্বাধিক। রাজ্যে মুসলমান মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার বেড়েছে, তার একটা কারণ এই শিক্ষা বৃত্তি, এবং শিক্ষায় অন্যান্য সরকারি সাহায্য। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রদের মধ্যে মুসলমানের অনুপাত ২৫.৩৯ শতাংশ, ছাত্রীদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও মেয়েরা এগিয়ে— ছেলেরা ২০.৩৫ শতাংশ, মেয়েরা ২৭.০৯ শতাংশ।
রাজ্যে মুসলমানদের মধ্যে সংবিধানসম্মত সামাজিক ন্যায়ের দাবিদাওয়া নিয়ে বেশ কিছু আলোচনার আয়োজন হচ্ছে। রাজ্যের মুসলমানরা শিক্ষার দাবিতে সংগঠিত হচ্ছেন, আবাসিক মিশন স্কুল তৈরির প্রবল চেষ্টা করছেন। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সামাজিক বা আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য ‘আবাসিক বিদ্যালয়’ থেকে শিক্ষার সুযোগ পেয়ে অনেকেই দারিদ্রের চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন। সাঁতরাগাছিতে ‘দ্বিনীয়াত মুয়াল্লিমা কলেজ’ রাজ্যের উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ মেয়েদের নানা কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে বিভিন্ন কোর্সের ব্যবস্থা করেছে। এই মেয়েরা প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন।
রাজ্যের পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের জন্য ইংরেজি মাধ্যম আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে ইতিমধ্যে নাগারিক সমাজ ও শিক্ষাবিদরা সরকারের কাছে আবেদন করেছেন। রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়নের ৪৭৭৭ কোটি টাকা বাজেটের একটা বড় শতাংশ যদি শিক্ষার খাতে ব্যয়ের কথা ভাবা হয়, তা হলে ১৫১টি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ব্লকে— যার মধ্যে ৫৬টা ব্লকে অর্ধেকেরও বেশি মুসলমান— একটি করে আবাসিক স্কুল তৈরি করা কঠিন হবে না।
রাজ্যে ওবিসি সংরক্ষণের ফলে শিক্ষা ও সরকারি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে, অথচ দেখা যাচ্ছে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ওবিসি সংরক্ষণকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছে। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ওবিসি সংরক্ষণ মানা হচ্ছে, তার অনেকগুলিতেই আবার সব মুসলমানকে ওবিসির মধ্যে বেঁধে রাখার চেষ্টা চলছে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও ওবিসি সংরক্ষণ না-মানার নজির গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে। অন্য দিকে, জনসংখ্যার অনুপাতে মুসলমানের সরকারি চাকরিতে অংশগ্রহণ বাড়ছে কি না তা জানার সুযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে— সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর অংশগ্রহণের পরিসংখ্যান পাওয়া যেত ‘স্টাফ সেন্সাস’ থেকে, গত ২০১৬ থেকে এক অজানা কারণে এই পরিসংখ্যান দেওয়া বন্ধ হয়েছে।
ওবিসি সার্টিফিকেট পাওয়া এবং পড়াশোনা ও সরকারি কাজের সুযোগ পাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। ওবিসি সংরক্ষণের সুবিধা নিয়ে মুসলমান সমাজ ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে, এর জন্য সাচার কমিটির পরামর্শ অনুসারে ‘ইক্যুয়াল অপরচুনিটি কমিশন’-এর দাবি উঠছে, এই কমিশন শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ম মেনে হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখবে ও রাজ্য সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে বাধ্য করবে। এ ছাড়া মুসলমান মেয়েরা পড়াশোনায় এগোলেও কাজের জগতে যথাযথ ভাবে প্রবেশ করতে পারছে না। এমনকি আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রেও জনসংখ্যার নিরিখে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব কম।
বাম আমলে ‘এই রাজ্যে দাঙ্গা হয় না’ বলে মুসলমানদের সামাজিক ন্যায়ের অধিকারকে যথেষ্ট অবহেলা করা হয়েছিল। ‘বিজেপির জুজু’ দেখিয়ে বর্তমান শাসক কি সেই এক ভুল করবে?
প্রতীচী ইনস্টিটিউট