(বাঁ দিকে) শিল্পী কে জি সুব্রহ্মণ্যন এবং সোমনাথ হোর।
শিল্পকলার ইতিহাসে অতুল তাৎপর্যবাহী একটি বছর পেরোচ্ছি আমরা। শিল্পী কে জি সুব্রহ্মণ্যনের (ছবিতে বাঁ দিকে) জন্মশতবর্ষ, সকলের প্রিয় ‘মানিদা’। এক দীর্ঘ কর্মময় জীবন, নিজস্ব এক শিল্পভাষার রচনাকার। বিভিন্ন শিল্প পরিসরে আয়োজিত হচ্ছে তাঁর প্রদর্শনী। তাঁর সূত্রেই মনে পড়ছে আর এক শিল্পীকেও, ২০২১-এ তিনি পেরিয়েছেন শতবর্ষ— সোমনাথ হোর (ডান দিকের ছবি)। বলা যেতে পারে একই সময়প্রবাহের শিল্পী তাঁরা। দু’জনের পথ ভিন্ন, তবু দু’জনেরই ভিতরে কোথাও অভিন্নতার সুর।
সেই সুর আসলে ওঁদের অনুভূতিপ্রদেশের। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে কাজের ছন্দ ছিল তাঁদের পাথেয়। ক্লান্তি নেই, শুধু অনুসন্ধান, চলার মধ্যেই আনন্দকে আহ্বান। দুই শিল্পীর কাজের পরিমাণের দিকে তাকালে অবাক হতে হয়, এত কাজ ওঁরা করলেন কখন! অথচ কোনও কাজেই অবহেলার চিহ্নমাত্র নেই, আছে যত্নের নরম আদর। বিস্ময় আরও বাড়ে তাঁদের কাজের বৈচিত্রের দিকে তাকালে। নিজস্ব স্বাক্ষর সঙ্গে নিয়েই ভিন্ন ভিন্ন পথে তাঁদের গতায়াত— আজকের শিল্প-পরিসরে দুর্লভ।
সোমনাথ হোর ভারতীয় ছাপচিত্রকে বিশ্বশিল্পযাত্রায় অন্বিত করেছেন। তাঁর ছাপচিত্রের কাজ দেখলে বোঝা যাবে, কী বিপুল বিভিন্নতা সেখানে। করণ-কৌশলের দক্ষতা ছাপিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় শিল্পকাজটির অন্তরাত্মা। তেভাগা তাঁর একটি পথ, তা বলে সোমনাথ হোর মানেই দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তরের ছবি নয়। তাঁর ষাটের দশকের লিথোগ্রাফে অন্য ভুবনের হদিস মেলে, তাঁর এরোটিক সিরিজ় খুলে দেয় অন্য দরজা। সারা জীবনের ক্ষত কেবল ‘ক্ষত’ সিরিজ়েই প্রকাশিত নয়, অন্তরের ক্ষত সংক্রমিত হয়েছিল তাঁর শিল্পের অন্দরে। কিন্তু সেই ক্ষতের সঙ্গে জীবনের প্রাপ্তি ও আনন্দও তাঁর কাজে রঙে রেখায় প্রবাহিত। ভাস্কর্যতেও যে অবদান রেখে গেলেন তিনি, সেখানেও কত না বৈচিত্র!
পর্বে পর্বে বদল চোখে পড়ে কে জি সুব্রহ্মণ্যনেরও। তাঁর প্রকাশিত স্কেচখাতাগুলি দেখলে বিস্ময় ফুরোয় না: একটি খাতায় নারী-অবয়বের নানা মুদ্রা, একটি খাতায় কালি-তুলির সমাহারে গাছে গাছে আনন্দ-উৎসব। দক্ষিণের সাংস্কৃতিক জলবায়ু সঙ্গে নিয়ে শান্তিনিকেতনের পথে তাঁর যাত্রা, তা বলে কোনও আঞ্চলিকতায় বাঁধা পড়েননি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সকল রসে, ঐতিহ্য ও নিজস্বতায় মেশা তাঁর পরিক্রমা বুঝিয়ে দেয়— শিল্পে অপাঙ্ক্তেয় কিছুই নয়, পথের সব রসদই শিল্পের রসদ। লোকশিল্প থেকে ডিজ়াইন, সবই হয়ে উঠতে পারে ছবির হৃদয়। শিল্পকলার প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধাবিত তাঁর আগ্রহ: রিভার্স পেন্টিংকে যেমন দেখেছেন নতুন নিরীক্ষায়, ভিত্তিচিত্রে তেমনই রচনা করছেন নতুন ইতিহাস। ছাপচিত্রে যেমন উৎসাহ, তেমনই অনাবিল আনন্দ খেলনা গড়ায়। সরাকেও তিনি করে তুলছেন চিত্রপট— মাধ্যমটির লোকজ চরিত্র অবলুপ্ত না করে বরং তার চরিত্রে মহিমা যোগ করছেন তিনি। তাঁর টেরাকোটার কাজ দেখলে বোঝা যায়, মাধ্যমে কী ভাবে প্রাণসঞ্চার করতে হয়।
শুধু শিল্পীই নন তাঁরা। তাঁদের ভূমিকা চিন্তকের, দার্শনিকের। শিল্পকলা বিষয়ক রচনাতেও তাঁদের সাবলীল যাতায়াত। তেভাগার ডায়েরি, চা বাগানের কড়চা-র মতো বইগুলি আমাদের সমাজ-ইতিহাসের দলিল, এ ছাড়াও সোমনাথ হোরের শিল্প বিষয়ক নানা গদ্যরচনা প্রকাশিত পত্রপত্রিকায়, পরে গ্রন্থাকারেও। অন্য দিকে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের পর কে জি সুব্রহ্মণ্যনই সেই শিল্পী যিনি শিল্পকলা বিষয়ে অজস্র লেখালিখির মধ্যে বুনে দিয়ে গিয়েছেন তাঁর তীব্র পর্যবেক্ষণ। ছবি ও লেখায় কাজ করেছেন ছোটদের জগৎ নিয়ে, সাঙ্কেতিক উচ্চারণে সময় ও রাজনীতিকে ক্ষুরধার দৃষ্টিতে লিপিবদ্ধ করেছেন, প্রকট করেননি কখনও। জীবনের সূচনাপর্বে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দু’জনেই কারাবরণ করেছেন। আদর্শে অবিচল থেকেও সক্রিয় রাজনীতি থেকে পরবর্তী কালে তৈরি করেছেন দূরত্ব। তাঁদের পথ ভিন্ন, কিন্তু মনন ও বোধ অভিন্ন।
দুই শিল্পীর পারস্পরিক শ্রদ্ধার অন্ত ছিল না। বিশ্বভারতী কলাভবন প্রকাশিত ১৯৯৯-এর নন্দন পত্রিকায় সুব্রহ্মণ্যনের পঁচাত্তর বছর উপলক্ষে সোমনাথ হোর লিখছেন, “মানিদার কর্মকাণ্ড বিচিত্র এবং বিস্তৃত। একাধারে শিল্পী লেখক বাগ্মী... খুব কাছ থেকে দেখেছি, যে মাধ্যমেই হাত দিয়েছেন, তার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য মুহূর্তেই তাঁর করায়ত্ত হয়েছে।” এই লেখাতেই চাতালের ধারে ‘চীনে বটগাছ’টির সঙ্গে তাঁর তুলনা টেনে লেখেন সোমনাথ হোর, “এখানে তাঁর ছায়ায় সমবেত হয় অগণিত ছাত্রছাত্রী এবং অপেক্ষাকৃত নবীন অধ্যাপকেরা।” লেখেন, “দুই-ই সবুজ, সম্বৎসর।”
অন্য দিকে, ২০১১ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় কে জি সুব্রহ্মণ্যনের ‘দ্য ভিশন অব সোমনাথ হোর’ শীর্ষক লেখাটির ভাষান্তরে পাই, “ছিপছিপে চেহারা, হালকা চলন, উজ্জ্বল দুটি চোখ সোমনাথকে শান্তিনিকেতন প্রাঙ্গণে সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায়... সর্বদাই যেন কোনো ব্রত নিয়ে কোথাও চলেছেন। এবং তাঁর কাজেও থাকে এক ধরনের ব্রতসাধনের একাগ্রতা।” লিখছেন, “সোমনাথের শিল্পশৈলী প্রতিটি শিল্পবস্তুর আবেদন অনন্য করে তোলে: ধারালো হাড়গোড়, টানটান চামড়া, মরা চোখ, ভাষাহারা সব মুখ, দোমড়ানো শরীরের অসাড় স্থবিরতা। তারা আমাদের দৃষ্টিকে ফুসলে আনে, তারপর ফালা ফালা করে।”
আজকের এই অ-শিক্ষিত, অ-শিল্পিত সময় কি শিক্ষা নিতে পারে না, ওঁদের আন্তরিক পর্যটন থেকে?