রিচার্ড ফাইনম্যানকে (ছবিতে) আমরা চিনি নোবেল পুরস্কারজয়ী বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে। কিন্তু ফাইনম্যান নিজেকে শিক্ষক ভাবতেই পছন্দ করতেন। “ইফ ইউ ওয়ান্ট টু মাস্টার সামথিং, টিচ ইট”— এ শুধুমাত্র তাঁর বিখ্যাত উক্তিই নয়, মনেপ্রাণে কথাটা বিশ্বাস করতেন। তাঁর মত ছিল, ছাত্রদের সঙ্গে অনবরত জ্ঞান আদানপ্রদানের মধ্য দিয়েই বিজ্ঞানী বেঁচে থাকেন।
ভাল শিক্ষক হতে গেলে যে আগে ভাল ছাত্র হতে হবে, অর্থাৎ বিষয়টা নিখুঁত ভাবে বুঝতে হবে— এ ব্যাপারে ফাইনম্যানের নির্দেশ অত্যন্ত পরিষ্কার। কোনও বিষয়ের নাম জানাটা আদৌ জ্ঞান নয়, স্রেফ একটা তথ্য। সেই তথ্য ব্যবহার করে যখন ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে কোনও ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যায়, তখনই তা জ্ঞানে উন্নীত হয়; বিষয়টাও ঠিকঠাক শেখা হয়ে ওঠে। কোনও বিষয় শেখানো মানেও শুধু কিছু তথ্য সরবরাহ করা নয়। বরং যাবতীয় কী, কেন, কী ভাবে-র উত্তর খুঁজে পেতে সাহায্য করা।
ফাইনম্যানের মতে, কোনও বিষয় এক জন ঠিকঠাক শিখেছেন কি না, সেটা বুঝে নেওয়ার উপায় হল বিষয়টা একেবারে সহজ করে কাউকে বোঝাতে পারা। বোঝানোর সময় কোনও প্রতিশব্দ ব্যবহার করা চলবে না। সমীকরণও নয়। কারণ প্রতিশব্দ হল স্রেফ নাম, জ্ঞান নয়। বিশেষ প্রতিশব্দ ছাড়া যদি বিষয়টার কোনও অংশ ব্যাখ্যা করতে অসুবিধে হয়, তা হলে বুঝতে হবে নিজের বোঝায় খামতি আছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। উনুনে বসানো হাঁড়ির জল কী ভাবে গরম হয়, সেটা বোঝাতে গিয়ে আমরা যদি বলি তাপের পরিচলন বা ‘কনভেকশন’ পদ্ধতি দায়ী, তা হলে শুধু পদ্ধতিটার নাম জানা হবে। প্রক্রিয়াটা কী? একটি ধাতব দণ্ড গরম হওয়ার পদ্ধতি (পরিবহণ বা ‘কন্ডাকশন’) থেকে তা আলাদা কেন? এগুলো বোঝা প্রয়োজন। তা না হলে কেউ প্রশ্ন করলেও আমরা বার বার ওই পরিচলন-পরিবহণই বলে যাব। কিন্তু প্রক্রিয়াটা বোঝা থাকলে বিভিন্ন ‘সাধারণ শব্দ’ ও উদাহরণের সাহায্যেই বিষয়টা সহজ করে বোঝানো যায়। ব্যাপারটা শুধু বিজ্ঞান নয়, যে কোনও বিষয়ের ক্ষেত্রেই সত্যি। যেমন, একটা ছবির বৈশিষ্ট্য বোঝাতে গিয়ে বিমূর্ত বা ‘অ্যাবস্ট্র্যাক্ট’ বললে চলবে না, কারণ সেটা শুধুমাত্র একটা বৈশিষ্ট্যের নাম। যে লক্ষণগুলো তাকে বিমূর্ত করে তুলছে, সেগুলো বুঝিয়ে বলতে হবে।
ক’দিন আগে টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এর প্রাক্তন অধিকর্তা সব্যসাচী ভট্টাচার্যের বক্তৃতা শুনছিলাম। বিষয়: ‘বিজ্ঞান কি সংস্কৃতি?’ তিনি বলছিলেন যে, গত এক-দেড় বছরে তথাকথিত বহু শিক্ষিত মানুষের মুখে এই কথা শুনেছেন, “করোনা এসে দেখিয়ে দিল বিজ্ঞান আসলে কিছুই পারে না।” এই কথা থেকেই বোঝা যায় বিজ্ঞান আদৌ আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে ওঠেনি, শুধুমাত্র আমাদের কিছু পারা-না-পারার হাতিয়ার হয়ে রয়ে গেছে। আসলে আমরা কোনও জ্ঞানকেই আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলতে পারিনি। কারণ আমাদের শেখা এবং পরবর্তী কালে শেখানো জুড়ে শুধুই একগুচ্ছ তথ্য। ফলে প্রথাগত লেখাপড়া শিখেও আমরা অনেক ক্ষেত্রেই গোঁড়ামি আঁকড়ে থাকি।
ফাইনম্যানের নির্দেশিত পদ্ধতি আসলে ভাবনার স্বচ্ছতায় পৌঁছনো। এই পদ্ধতি যে আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে ওঠেনি তা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। কোনও বিষয় বুঝে প্রশ্ন তোলার মধ্যে দিয়ে পড়া ও পড়ানোর পদ্ধতি আমাদের একেবারে অচেনা নয়। তবে পড়ানোর ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি তখনই সফল হয়, যখন এই ভাবে পড়ার অবকাশ থাকে এবং কোনও ‘শর্ট-কাট’ রাস্তা খোলা থাকে না। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ্যসূচি এমন ভাবে তৈরি, যাতে খুব কম সময়ে অনেক তথ্য জানতে হয়। ফলে পাঠ্যবইয়ের তুলনায় নোটবই, সাজেশন, কোর্স মেটিরিয়াল ইত্যাদির কদর এখন বেশি। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষণ পদ্ধতিতেও পড়ানোকে প্রয়োগমুখী করে তোলার দিকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, গভীর করে তোলার দিকে ততটা নয়। অর্থাৎ, ছাত্রদের প্রশ্ন করার কোনও অবকাশ বা প্রয়োজন থাকছে না। পথের শেষে থাকছে ‘সহজে’ সাফল্য লাভ। এখানে সাফল্য মানে পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়া, যার জন্য অসংখ্য প্রাইভেট টিউশন, টিউটোরিয়াল হোম, আরও রহস্যময় কিছু সমান্তরাল ব্যবস্থা রয়েছে। ছাত্ররা এই শর্ট-কাটকেই ‘রাস্তা’ বলে চিনছে। যে শিক্ষকেরা এখনও ফাইনম্যানের পদ্ধতি মেনে পড়ান, ছাত্ররা তাঁদের ভালবাসে, কিন্তু তাঁদের পদ্ধতিটা অনুসরণ করে না। কারণ ওই শর্ট-কাট। এটাই সবচেয়ে বড় ক্ষতি , যার ফল দেখা যাচ্ছে পরবর্তী কালে। বেশি নম্বর পাওয়া ছাত্ররা গবেষণা বা উদ্ভাবনার ক্ষেত্রে অনেক সময়ই ব্যর্থ হচ্ছে। যার ফল “আমাদের দেশে কেন নোবেল প্রাইজ় আসে না?”-র মতো নিষ্ফল আক্ষেপ। এই আক্ষেপকে উদ্দীপনায় বদলে দেওয়ার উপায়ই হল প্রশ্ন করতে শেখা ও শেখানো, পাশাপাশি কোনও বিষয়কে গভীরে গিয়ে শেখা ও সহজ করে শেখানোর সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি