দিন কয়েক আগে বাজারে এল বুল্লিবাই অ্যাপ, যেখানে কেউ চাইলেই নাম করা সমাজকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিবিদদের ‘নিলাম’ করতে পারবে। যাঁরা ‘নিলামে উঠবেন’, তাঁরা সকলেই সংখ্যালঘু, এবং প্রতিষ্ঠিত মহিলা। সত্যিকারের নিলামে তাঁরা উঠছেন না, কিন্তু অ্যাপ ইউজ়াররা ‘নিলামসুখ’ পাবেন ষোলো আনা। ভিডিয়ো গেম খেলার মতোই। এমন অ্যাপ প্রথম তৈরি হল, তা নয়। ঠিক এক বছর আগে এ ভাবেই তৈরি হয়েছিল সুল্লিডিলস নামক আর একটি অ্যাপ, সেখানেও ঠিক এমন ভার্চুয়াল কেনাবেচার একটা কল্পরাজ্য ছিল। বাজারচাহিদা রয়েছে বলেই এই ধরনের অ্যাপ বার বার বাজারে আসছে। কিন্তু এই বাজারের খদ্দের কারা?
তাঁরাই, যাঁরা সংখ্যালঘু, মুক্তমনা, নিজ ক্ষমতায় বলীয়ান মহিলা, বুদ্ধিজীবী— এই তিন বর্গকেই ঘৃণা করেন। এই ঘৃণা যে ভাবে বাজারের পণ্যে পরিণত হয়েছে, তা উল্লেখযোগ্য। ফেসবুকে কী ভাবে এই ঘৃণার বেসাতি হয়, সে কথা জানা। বুল্লিবাইয়ের মতো অ্যাপ আরও মারাত্মক। সেখানে ঘৃণা বই আর কোনও পণ্য নেই। এই অবস্থা এক দিনে তৈরি হয়নি। কী ভাবে ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে ঘৃণার বাজার গড়ে উঠেছে, সেই খোঁজ করতে হবে বাস্তব দক্ষিণপন্থী রাজনীতির জমিতে।
আইটি সেলের কর্মীরা স্রেফ বিজেপির গুণগান করে থেমে থাকেননি। ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ-সহ অন্যান্য মাধ্যমকে হাতিয়ার করে বছরের পর বছর বিরোধী দলের নেতাদের কালিমালিপ্ত করেছেন। মিথ্যে খবর ছড়িয়েছেন। সংখ্যালঘু, বুদ্ধিজীবী এবং প্রগতিশীল মহিলাদের ভিলেন বানিয়েছেন। অনেকই কাজটি করেন স্রেফ অৰ্থের জন্য। অনেকে আবার আদর্শগত ভাবেই এই বিদ্বেষের প্রতি বিশ্বস্ত।
সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ স্বাভাবিক ভাবেই এঁদের চিহ্নিত করার মতো প্রশিক্ষিত নন। বিশ্বাসের গভীরে ঢুকতে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে তাঁরা টুইট করেন, একটি ট্রেন্ডিং হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে সমবেত ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কখনওই নিজস্ব পরিচয় সামনে আনেন না। পুরোটাই ঘটে একটা কর্পোরেট নিয়মের ঘেরাটোপে।
এবং, ঘৃণা আর অবিশ্বাসের বৃত্তের পরিধি বেড়ে চলেছে। আমরা এটাকেই কাস্টমার বেস বা গ্রাহকের মনোভূমি তৈরি বলে ধরে নিতে পারি। যে গ্রাহক অসহিষ্ণু, বহুস্বরে স্বততই অবিশ্বাসী, বিরুদ্ধস্বরকে ভার্চুয়াল পৃথিবীতে ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে চান পল অনুপল— বাজার তৈরি হয়েছে এই গ্রাহকের হৃদয়কে ঘিরেই। এই পথেই সিদ কেঁটে মনে মনে ঢুকে যাচ্ছে ঘৃণার এমন নিষিদ্ধ ইস্তাহার। ঘৃণার ক্ষতে হাত বুলিয়ে আরাম পাবে কত হাজার মানুষ-এমনটাই নিশ্চয়ই ভেবেছেন বুল্লিবাই, সুল্লিডিলসের স্রষ্টারা। দিনেদুপুরে এক জন অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকা মুসলিম মহিলাকে ভার্চুয়াল যৌনকর্মী বানিয়ে তোলা তো সেই কারণেই। ঘৃণা করতে হবে। যৌনকর্মীকে যেমন ঘৃণা করতে হয়। মুসলমানকে যেমন ঘৃণা করতে শেখানো হচ্ছে, সে ভাবে একটা ঘৃণার তরঙ্গকে জীবিত রাখতে হবে— এটাই এই ধরনের পৃথিবীটার মূলমন্ত্র।
স্বাতী চতুর্বেদী তাঁর আই অ্যাম আ ট্রোল: ইনসাইড দ্য সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অব বিজেপি’স ট্রোল আর্মি-তে লিখেছেন, ট্রোল করাকে যাঁরা পেশা হিসাবে বেছে নেন, তাঁরা সাধারণত ক্ষয়িষ্ণু জায়গা থেকেই উঠে আসেন। ইংরেজি ভাষায় বলিয়ে কইয়ে না হতে পারা, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নিজেকে খুঁজে না পাওয়া তাঁদের হীনম্মন্যতার কারণ হয়। পেশাবাছাইয়ের সময়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিক আবহে বেড়ে ওঠা এবং দারিদ্র। বুল্লিবাই অ্যাপে যাঁদের টার্গেট বানানো হচ্ছে, তাঁরা সকলেই সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির অংশ, স্ব-স্ব ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। পর্দার আড়াল থেকে আমিও যে তাঁকে এক ঘা মারতে পারছি এটা শ্রেণির ধারণা ভেঙে বেড়িয়ে আসার ‘সুখ’ কি না তা ভেবে দেখতে হবে।
অ্যাপটি নিষিদ্ধ হলেও সম্পৃক্ত বেশির ভাগ বিষয়ই অমীমাংসিত রয়ে গিয়েছে। উত্তর আসেনি কোনও পক্ষ থেকে। যেমন জানা যায়নি সুল্লিডিলসের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই অ্যাপগুলিতে যাঁদের হেনস্থা করা হয়, তাঁদের নিগ্রহ শুধু সেই অ্যাপের পরিসরেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তার রেশ অন্যান্য সমাজমাধ্যমেও জারি থাকবে— দেখিয়ে দিয়েছে সুল্লিডিলস। আজ যা ভার্চুয়াল, কাল হয়তো তা রাজপথে ঘটবে।
২০২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শতবর্ষ পূর্ণ হবে। হিন্দুর বিপদ প্রমাণ করতে হলে সব সময়ই কল্পিত শত্রুপক্ষ চাই। শিক্ষিত, ক্ষমতায়িত সংখ্যালঘু নারী— অশিক্ষিত খাপ পঞ্চায়েত মানসিকতার কাছে যাঁরা স্বভাব-শত্রু, তাঁদেরই হিন্দুত্বের শত্রুর আসনে বসিয়ে দিলে কাজটা সহজ হয় বটে। ফেসবুক তো ছিলই, বুল্লিবাইয়ের মতো অ্যাপ ফের যদি ফাঁক গলে ঢুকে যেতে পারে, তাতে খুব সুবিধা। বুল্লিবাইয়ের মতো অ্যাপকে যদি বুঝতে হয়, তা হলে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে ঘৃণার অপরিহার্যতার পরিপ্রেক্ষিতেই বুঝতে হবে।