নৃত্যের প্রাণবেদনায়
Dancer

প্রজাপতি ও সরস্বতীর কাটাকুটি খেলায় হয়রান শিল্পী তাঁরা

টাকুটি খেলা চলে জীবনভর নাচে আর সংসারে। কারও নাচের মাঝপথেই নেমে আসে কার্টেন— গ্রিনরুমের সাজ স্টেজের আলোয় ধরা পড়ে না।

Advertisement

ঐশিকা চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:৩৯
Share:

সেটা ১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রী সদ্যবিবাহিতা মমতা দাশগুপ্তকে চিঠিতে লেখেন, “খবর নিশ্চয় পেয়েছিস যে নটীর পূজার আয়োজন চলেছে। গৌরীদান সমাধান হবার পূর্বেই এইবার এই নাটকের পালা শেষ করে দিতে হবে। তারপরেই এই শুভ মাঘ মাসের শেষেই একেবারে উপসংহার। নটীর পূজা থামাবার জন্যে বুদ্ধশত্রু অজাতশত্রু যে চেষ্টা করেছিলেন, এবার প্রজাপতি দেবতার উদ্যোগে সে চেষ্টা সফল হল। সেইজন্যে ঐ দেবতাটির উপর আমার মন একটা দিন প্রসন্ন নেই, বয়স যদি অল্প হত তাহলে সাবধান হতুম, কিন্তু এখন ঐ দেবতা আমার নাগাল কিছুতে পাবেন না, তাই নির্ভয়ে আছি।”

Advertisement

বয়স অল্প হলেও রবি ঠাকুরদের সারস্বত সাধনার পথে প্রজাপতি মোটেও কোনও দিন উড়ে এসে জুড়ে বসে বাধা ঘটায় না। তবে গৌরীদানের পরে নটীদের পুজো বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে— নাচের মেয়েদের নিয়ে বৃদ্ধ কবির এই উদ্বেগ অমূলক ছিল না। ১৯২৬ সালে ইটালি থেকে ফেরার পর রবীন্দ্রনাথ হাত লাগিয়েছিলেন ‘নটীর পূজা’ নৃত্যনাট্য রচনায়। হিন্দু পুরাণের রাধা, সীতা বা শকুন্তলা নয়, অবদানশতকের বৌদ্ধ গাথার রাজনর্তকী শ্রীমতী-ই এই নৃত্যনাট্যের প্রধান চরিত্র। দেশের সাংস্কৃতিক পুনরুত্থানের কর্মসূচি যখন রক্তমাংসের নটী বা নর্তকীদের জাতির সংস্কৃতির চৌহদ্দি থেকে সরিয়ে সম্ভ্রান্ত নারীর শরীরে শাস্ত্রসম্মত নৃত্যভাষার পুনর্জন্ম দিতে ব্যস্ত, তখন রবীন্দ্রনাথের এই নৃত্যনাট্যে রাজনর্তকী শ্রীমতী-ই হয়ে ওঠে আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু, যাকে রাজদ্রোহিতার শাস্তিস্বরূপ বুদ্ধের স্তূপের সামনে নাচতে হয়। কিঙ্করীদের অভিশাপে, ‘দু খানা পা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলেও’ নাচতে হয়, “নরকে গিয়ে শতলক্ষ বছর ধরে জলন্ত অঙ্গারের উপর দিনরাত নাচতে হয়।”

নাটকীয়তা, মঞ্চসজ্জা ও শ্রীমতী-রূপী গৌরী বসুর নৃত্যশৈলীর (মণিপুরি এবং স্বতঃস্ফূর্ত শরীরী ভাষার মেলবন্ধনের প্রাথমিক প্রয়াস) গুণে ‘নটীর পূজা’ দর্শক টানে। শান্তিনিকেতন থেকে জোড়াসাঁকো প্রতিটি শো-ই হাউসফুল। তবু স্টেজের নটীদের পায়ের তাল বার বার কাটে— কোনও অজাতশত্রুর চক্রান্তে নয়— প্রজাপতির আশীর্বাদে। পূজা হয়তো বন্ধ হয়ে যায় না একেবারে, তবু নটী পাওয়াই দুষ্কর হয়ে ওঠে। ১৩৩৩ সালের ২৫ বৈশাখ প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে কোনার্কে ‘নটীর পূজা’ অনুষ্ঠিত হয়, তখন গৌরী, মালতী, লতিকা, অমিতার মতো এক ঝাঁক নতুন মেয়ের দল জানান দিয়ে যায় নতুন আধুনিক নৃত্যধারার। যতটা স্পর্ধা ছিল শ্রীমতীর, ততটা তো গৌরীরও। যে মেয়েরা সে দিন মুখে রং মেখে, ভিন্ন সাজে-পোশাকে, অনাত্মীয় পুরুষ দর্শকের সামনে মঞ্চে এসে দাঁড়ায়, তাদের ধৃষ্টতা তো কম ছিল না! সে বছরই মাঘ মাসে যখন কলকাতায় টানা তিন দিন ‘নটীর পূজা’ অনুষ্ঠিত হয় তখন বাংলার গভর্নরের পাশে দর্শকের সামনের সারিতে বসে ছিলেন গৌরী ও মালতীর ভাবী বর ও শ্বশুরবাড়ির লোকেরাও। অনুষ্ঠানশেষে ভূয়সী প্রশংসা, সংবাদমাধ্যম উচ্ছ্বসিত। তবুও বিয়ের পর স্টেজে উঠে আবার ‘নটী’ হয়ে ওঠা হয় না গৌরীদের। মাঘ মাস ফুরোতে না-ফুরোতেই নাচের মেয়েদের ওই আধখানা পথ চলার গল্পই রয়ে যায় ।

Advertisement

হয়তো এমন গল্প সকলের ক্ষেত্রে নয়। কাছাকাছি এমন একটা সময়েই তো বাঙালির ঘরের আর এক মেয়ে তার নিজেরই ভাষায় মঞ্চ থেকে চলচ্চিত্রে রাতারাতি ‘সেনসেশন’ হয়ে উঠেছিল নাচেরই দৌলতে। যে কেশবচন্দ্র সেন একটা সময় ‘নচ গার্লের’ কোমরের দোলায় দেশ ও জাতির সর্বনাশ দেখেছিলেন, তাঁরই পৌত্রী সাধনা সেনের (বসু) ফিল্ম-ব্যালে স্টেজ থেকে স্ক্রিন, কলকাতা থেকে বম্বে, ক্যালকাটা আর্ট প্লেয়ার্সের আলিবাবা থেকে কোর্ট ডান্সার বা রাজ নর্তকী জাতির ইতিহাসে বাম্পার হিট হয়। সাধনার রুপোলি সাফল্যের সিংহভাগের দাবিদার ছিলেন তাঁর স্বামী/নির্দেশক মধু বসু। সাধনার ভাষায় “মধুতে-আমাতে-সাক্ষাৎ” আর নিবিড় রোমান্সের আঁকেবাঁকে উঠে আসে একের পর এক মঞ্চ-সফল নৃত্যনাট্য আর সুপারহিট সিনেমা। তবে, সাধনার কাছে যখন ‘ছন্দকে বাদ দিলে জীবন নিরর্থক, জীবন রূপহীন’, তখন মধু বসুর জীবনকথায় ক্ষোভ ঝরে পড়ে, “অভিনয় আর সংসার দুটো দিক একসঙ্গে সামলানো যায় না তা সে যত জোর গলাতেই বলুক।” সত্যিই সামলানো যায়নি। শেষে সাধনার সংসার ‘মধু’ময় হয়নি। আবদাল্লা-মর্জিনার সংসারে জমে যায় ‘এত্তা জঞ্জাল’। সেই চিড়ধরা সংসারের বাইরে যদিও তারা সফল জুটি; শুধু পারফরম্যান্সের জোরেই একে অপরের পরিপূরক।

যশোরের বাটাযোঢ় গ্রামের বছর বারোর অমলা নন্দীর বাবার হাত ধরে প্যারিসের কলোনিয়াল এক্সপোজিশন যাত্রা যে জীবনের যাত্রাপথও এমন ভাবে ঘুরিয়ে দেবে, তা কি সে জানত! প্যারিসেই দেখা হয়ে যায় উদীয়মান ভারতীয় নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের সঙ্গে। একটুও নাচ না-জানা অমলাও ঢুকে পড়ে শঙ্করের নাচের দলে ‘অপরাজিতা’ নামে। তার পর কালীয় দমন থেকে আরও অসংখ্য পৌরাণিক মেলোড্রামায় তিনিই হয়ে ওঠেন শঙ্করের পার্টনার। জীবনের তালে তাল মিলিয়ে অমলা জোট বাঁধেন উদয়ের সঙ্গে। সাত সাগরের পার উজিয়ে এসে অমলা যখন আলমোড়াতে পা রাখেন তখন রামলীলার শ্যাডো প্লে-তে তিনি হন ‘রাম’। আলমোড়াতেই গাঁটছড়া বাঁধেন উদয়-অমলা। ঠিক মন্দিরের স্থাপত্য থেকে উঠে আসা শিব-পার্বতীর আদলে জাগ্রত ও জীবন্ত হয়ে দাম্পত্যের রসায়নাগারে চলে ইম্প্রোভাইজ়েশন আর ইমাজিনেশনের খেলা আর নৃত্য। দ্বন্দ্বের ঘাতপ্রতিঘাত চলে স্টেজের বাইরে ও ভিতরে।

শঙ্কর-ঘরানার প্রধান ধারক-বাহক অমলাশঙ্কর যখন ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’-এর কর্ণধার, তখন উদয়শঙ্কর তাঁর জীবনে এক মহতী ঐতিহ্যের রেফারেন্স পয়েন্ট মাত্র। শিল্পী-সত্তা থেকে স্ত্রী-সত্তার সুচারু ব্যবচ্ছেদে অমলা ‘শঙ্কর ঘরানা’ অঙ্গীভূত করেও রয়ে যান অন্য কক্ষপথে। তাঁর আত্মপ্রতিষ্ঠার গায়ে লেগে থাকে উদয়শঙ্কর-ছায়া, শ্যাডো প্লের মতো, তবু অমলা তাঁর ব্যক্তিগত সংসার জীবনে সমঝোতা করেন না। আমৃত্যু ভুলতে পারেন না ছায়ানৃত্যের ম্যাজিক ফর্মুলা, ভোলেন না কালীয় দমন-এ সাপের ফণা তৈরির রহস্য। কিন্তু ‘শঙ্করস্কোপের’ সাফল্য ভুলতে চান সচেতন প্রয়াসে। অমলাকে বাদ দিয়ে উদয়-ই বা সম্পূর্ণ হন কী করে?

স্বাধীনতা-উত্তর কলকাতায় মঞ্জুশ্রী চাকীর সাফল্যের সূত্রপাত জর্জ বিশ্বাসের গানের সঙ্গে হলেও তাঁর নিজের মতে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ এসেছিল বিয়ের পর। অধ্যাপক স্বামী পার্বতী কুমার সরকারের সঙ্গে আফ্রিকা থেকে আমেরিকা প্রবাস কালে রবীন্দ্রনৃত্যের গায়ে লাগে মার্থা গ্রেহাম, আলভিন আইলি বা মার্স ক্যানিংহামের ছাপ। স্টেজে পিতৃতান্ত্রিক আদর্শের বিরুদ্ধে পা তোলে তাঁর নারীবাদী নাচ, আর ব্যক্তিগত পরিসরে সুখী দাম্পত্যের পূর্ণতাকে স্বাগত জানান বার বার। চাকী আর সরকারের মাঝে ছোট্ট হাইফেনটা কখনও টেনে বড় করতে চাননি। বিশ্বাস করতেন নারী-পুরুষের সম-অধিকারে। তাই মেয়েকে স্বামীর কাছে রেখে সুটকেসে নাচের সরঞ্জাম ভরে মঞ্জুশ্রী বার বার পাড়ি দিয়েছেন আমেরিকার একক সফরে। আবার মণিপুরের ফিল্ড-ট্রিপে মেয়েকে কাছছাড়া করেননি। তাঁর রান্নাঘরের পাশেই ছিল নাচের স্টুডিয়ো, শোয়ার ঘরের গায়েই পড়ার ঘর: সর্বত্র তাঁর নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্বের প্রসারিত ছায়া। ভারসাম্য থাকত তখনই, যখন তিনি থাকতেন ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে।

এই সব দৃষ্টান্তের বাইরে এমন নিটোল পূর্ণতা নিয়ে সংসার-মাতৃত্ব-নৃত্যসৃজন-গবেষণা আসে ক’জনের জীবনে? প্রজাপতি রংবেরঙের পাখা মেললেও সরস্বতীর আসন টলে না— এমন ঘটে ক’জন নটীর ভাগ্যে? আর যদি নাচের সঙ্গে জুড়ে যায় জীবিকার প্রয়োজন, তখন কী হয়? যাদের নাচ শুধু পেটের তাগিদে, সারস্বত সমাজ তাদের কী চোখে দেখে? প্রজাপতির (বিষ) নজরও পড়ে কি তাদের উপর? কলকাতার একদা সাহেবপাড়ার নাইটক্লাবের ক্যাবারে ডান্সার মিস শেফালি কথার ফাঁকে জানিয়ে যেতে চান, “আমি ডান্সার, প্রস্টিটিউট নই।” অনেক খুচরো রোমান্স থাকলেও, তিনি জানতেন সংসার করলে ‘মিস’ শেফালি হওয়া হত না।

এমনই কাটাকুটি খেলা চলে জীবনভর নাচে আর সংসারে। কারও নাচের মাঝপথেই নেমে আসে কার্টেন— গ্রিনরুমের সাজ স্টেজের আলোয় ধরা পড়ে না। কারও আবার গল্প ফুরোয় একদম স্ক্রিপ্ট-মাফিক— ক্লাইম্যাক্স আর অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স পেরিয়ে আসে কাঙ্ক্ষিত ‘হ্যাপি এন্ডিং’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement