গত ১৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতা হাই কোর্ট রায় দিয়েছে যে, ৩৪ সপ্তাহ ৬ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও গর্ভস্থ শিশুকে বিনষ্ট করা যাবে। চিকিৎসা আইনের পরিপ্রেক্ষিত আলোচনা করে আদালতের পর্যবেক্ষণ, যে হেতু শিশুটি ওপেন স্পাইনা বাইফিডা নামক অবস্থায় আক্রান্ত হতে চলেছে, এই ‘অসুস্থ’ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত শিশুর জন্মগ্রহণ করার অধিকার থাকবে না।
কয়েকটি কথা প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর পক্ষ থেকে বলতে চাই। প্রথমত, এই রায়ের সঙ্গে মেডিক্যাল টারমিনেশন অ্যাক্ট অব প্রেগন্যান্সি, ১৯৭১ এবং ২০২১-এর সংশোধনীর কোনও সাযুজ্য এবং সঙ্গতি নেই। ২০২১-এর এই সংশোধিত আইন অনুযায়ী— ২৪ সপ্তাহের পরে কোনও ভাবেই গর্ভস্থ শিশুর অ্যাবরশন করার কোনও প্রতিবিধান নেই। যদিও বিশেষ ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে বিষয়টি সম্ভব।
এই প্রশ্নও ওঠে যে, প্রায় ৩৫ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করে একটি জীবন্ত শিশুর (হতে পারে সেই শিশুটি প্রতিবন্ধকতাযুক্ত) কী ভাবে প্রাণ নেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্র নিতে পারে! প্রশ্নটি মানবাধিকারের এবং সংবিধানের আর্টিকল ২১-এর বেঁচে থাকার অধিকারের ব্যাখ্যার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি? পরবর্তী প্রশ্ন, যেখানে মায়ের জীবন সংশয়ের সম্ভাবনা নেই, কেবল শিশুর প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রাণহানি কি সঙ্গত? প্রখ্যাত চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ বলছেন, “এক জন অন্তঃসত্ত্বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাঁর ভ্রূণের ত্রুটির কথা জানতে পারলেন না, এই না জানতে পারাটা আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রের অক্ষমতা। এমন শিশুকে তার মা-বাবা গ্রহণ করতে অপারগ হলে, সরকারের উচিত সেই শিশুর পাশে দাঁড়ানো।”
আইন ও আদালতের অধিকার সম্বন্ধে কোনও কূট প্রশ্ন তোলার অভিপ্রায় আমাদের নেই। তবু ‘প্লেটোনিক ইউজেনিক্স’-এর এই মানবতাবিরোধী ছায়া কোনও মতেই আধুনিক ঠেকে না। এমনও আশঙ্কা হয়, এই অজুহাতে আরও অনেক শিশুর গর্ভস্থ অবস্থায় প্রাণ হরণ করার মতো পরিবেশ তৈরি হবে না তো?
সন্দেহ নেই, এই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও প্যারামেডিক্যাল কর্মী-সহ সকলেই চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। অথচ, মহামান্য উচ্চ ন্যায়ালয় দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করল না। কারণ ২৪ মাস পূর্বেই যেখানে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব ছিল, সেটা ঠিক ভাবে না করার ফলে বর্তমানে যে অবস্থার সৃষ্টি হল, তা এক কথায় চরম হতাশাজনক।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি বিষয় একটু গভীরে গিয়ে আমাদের আলোচনা করা প্রয়োজন। মূল প্রশ্ন হচ্ছে, কেন ও কোন কারণে ওই আসন্নপ্রসবা মা প্রায় সাড়ে আট মাস শিশুটিকে গর্ভে ধারণ করার পরও আপন সৃষ্টিকে আইনি প্রাণ হরণের জন্য রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে চাইছেন! গর্ভস্থ সন্তানের ভবিষ্যৎ প্রতিবন্ধকতার জীবনের তীব্র যন্ত্রণার আশঙ্কায় তিনি এতটাই ভয়ার্ত যে, আপন সন্তান, হোক না সে প্রতিবন্ধী— তবু সেই অনাগত শিশুকে এই পৃথিবীর মাটি-জল-আবহাওয়ার মধ্যে আহ্বান করার সাহস যেমন তাঁর নেই, তেমনই রাষ্ট্র এবং ন্যায়ালয়েরও সেই পরিকল্পনা বা বাসনা নেই।
আসলে মুখে প্রতিবন্ধী অধিকারের আন্তর্জাতিক সনদের (ইউএনসিআরপিডি) কথা বললেও আমরা কার্যক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গকে সমাজের একেবারে প্রান্তে ঠেলে দিয়েছি। প্রসঙ্গত, দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলের সহমতের ভিত্তিতে সংসদে পাশ হয়েছে প্রতিবন্ধী অধিকার আইন ২০১৬। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, আজ পর্যন্ত রাজ্য সরকারি স্তরে, বিভিন্ন দফতরে এই আইনের রুলস রেগুলেশনস গঠন করা হয়নি। সরকারের সর্বস্তরে চিঠি, দাবিসনদ, ডেপুটেশন দিয়েও; এমনকি জেলায় জেলায় আইন অমান্য করেও কোনও বিহিত হয়নি। করোনা অতিমারির কবলে পড়ে প্রতিবন্ধী শিশুদের বিশেষ বিদ্যালয়ে যাওয়া প্রায় বন্ধ, কোনও অনলাইন ক্লাসেরও ব্যবস্থা নেই। মাত্র এক হাজার টাকা মাসিক ভাতায় দরিদ্র উপায়হীন প্রতিবন্ধী মানুষটি পরিবার নিয়ে কী ভাবেই বা বেঁচে থাকতে পারেন, আজকের এই চড়া মূল্যবৃদ্ধির যুগে। অসংখ্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কাজ হারিয়েছেন গত দু’বছরে। নতুন আইনের ২১টি বিভাগের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সিংহভাগই আজও পরিচয়পত্র পাননি।
রাজ্যের পঞ্চাশ লক্ষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এই প্রেক্ষিতে আজ সমাজ রাষ্ট্রের কাছে সুবিচার চান। মেডিকো-লিগাল প্রশ্নটি আইনজীবী ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের আলোচ্য। কিন্তু প্রতিবন্ধী অধিকার আইন ২০১৬ উপযুক্ত ভাবে সমস্ত রাজ্য সরকারি দফতরে কার্যকর হলে হয়তো আজকের এই অপরিণামদর্শী, অমর্যাদাকর, মর্মান্তিক পরিস্থিতির সম্মুখীন আমাদের হতে হত না।