মেয়েরাও যে আছে...
Literature

স্বপ্ন ও কল্পনার জাদু বোনা শিশুসাহিত্যে ছোট মেয়েদের পৃথিবী

বাল্য-কৈশোরের জন্য লেখায় মেয়েরা আছে, তাদের রকমফেরও আছে। এখানে রইল তার কয়েকটিমাত্র নমুনা।

Advertisement

রুশতী সেন

শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৭:১২
Share:

গাঁয়ের নদীকে যদি কেউ নোংরা করে কারখানা বসিয়ে ময়লা জল ফেলে, তো সেই সোনার গাঁয়ের চাষি মেয়ে সোনা ছুটে আসে বাঘিনির মতো, “নদী যে মা, সত্যিকারের মা… মায়ের গায়ে কাদা ছোড়ো, তোমরা কী? মানুষ না পিশাচ?” গৌরী ধর্মপালের ছোট্ট গল্প ‘সোনা’ কি ব্যতিক্রম বাংলার শিশু-কিশোরসাহিত্যের অলিন্দে? এই যে শুনি, ছোটদের জন্য বাংলা লেখালিখিতে মেয়েরা নাকি তেমন চোখে পড়ে না? প্রবক্তার জায়াগাটা নাকি মোটামুটি বাঁধাই থাকে ছেলেদের জন্য? লেখকের আশ্চর্য কৌটো সঙ্কলনের ‘ময়নামতী’, ‘গাগুনির চরকা’, ‘ফুল্লরার পুতুল’, ‘রাজকন্যা ও কইমাছ’ মনে পড়ে? কাকে রেখে কাকে পড়ি? যে নাকি যা চায় তাই পায়, না-চাইতেও পায়, সেই রাজকন্যাকেই লেখক পৌঁছে দেন মাছ খাওয়ার বায়না থেকে মাছ পোষার আনন্দে। ফুল্লরা-গাগুনি-ময়নামতীরা অনটনের সংসারে দিন কাটায়। মা-বাবার হাতে তৈরি পোশাকে মানানসই বাহারি বোতাম লাগানো, নামমাত্র তুলো নিয়ে চরকায় বসে রাশি রাশি সুতো তৈরি করা, মায়ের কাঁথা সেলাইয়ের ছুঁচে সুতো পরানো বা শাড়ির পাড় থেকে তুলে আনা কাঁথার জন্য হরেক রঙের সুতো; কাজ কি কম? তবে কাজকে ডরায় না ওরা। ওই কাজই হয়ে ওঠে তাদের খেলার পৃথিবীর উপকরণ। এরা আদৌ ডানপিটে নয়, অবাধ্য নয়, হুট বলতে কাজকর্ম ফেলে সুখলতা রাওয়ের ননুর মতো আলি-ভুলির দেশে পাড়ি জমাবার খামখেয়াল তাদের উপর ভর করে না ।

Advertisement

মায়ের হাত থেকে পড়ে সুচ ভাঙলে ময়নাকেই ছুটতে হয় কামারবাড়ি। বিনা দামে সুচ দেবে না কামার। কামারের চাহিদার সুতো ধরে জোলা-কুমোর-শাঁখারি— সক্কলে হরেক জিনিস চাইতে থাকে ময়নার কাছে। ময়নার কান্না শুনে গাঁয়ের মানুষ ছুটে আসে। শাঁখারি-বৌ, কুমোর-বৌ, জোলার মা নিজের নিজের ঘরের পুরুষগুলোকে দায়ী করে ময়নার চোখের জলের জন্য। বড়াইবুড়ি বলে, “…ময়নার মা-র তৈরি কাঁথা গায়ে দিয়ে তোমরা গাঁ-সুদ্দু সবাই শীত কাটাও, বাদলা হাওয়ায় গা বাঁচাও, আর তার মেয়ে কিনা সারা গাঁ ঘুরে একটা ছুঁচ পায় না? তোমরা কি মানুষ, না আর কিছু?” এর পর থেকে কামার-কুমোর-জোলাদের আনুকূল্যে ময়নার মায়ের সংসার আগের তুলনায় ঢের সহজে চলে। তবে কি ময়নাদের গ্রামই হয়ে উঠল নতুন আলি-ভুলির দেশ, যেখানে উকুনে বুড়ির বিয়ের বাদ্যি নেই, আছে স্পষ্টবক্তা বড়াইবুড়ির আন্তরিক উষ্ণতা?

হাতে পতাকা, গলায় স্লোগান না-থাকলে কি প্রবক্তা হওয়া যায় না? যদি তিনি দুই শতকের নিষ্ফলা আমগাছে মুকুল ধরাতে পারেন? যদি তাঁর লালনে উপশম পায় দু’শো বছরের উপোসি বাল্য? যদি তাঁর নিঝুম রান্নাঘরে সংস্থান পায় দুই শতকের না-মেটা খিদে? লীলা মজুমদারের সব ভূতুড়ে সঙ্কলনে আছে ‘অহিদিদির বন্ধুরা’। যত না ভূতের গল্প, তার থেকে ঢের বেশি তো সে অহিদিদির মায়া-মমতা, সাহস, কথকতা আর নৈপুণ্যের কাহিনি! দু’শো বছর আগে ধনী সদাগরবাড়িতে ভোরবেলা পৌষপার্বণের বাসি পিঠে খেতে এসে হট্টগোলের অপরাধে গয়লাপাড়ার যে ছেলেমেয়েদের জিভ কাটা গিয়েছিল সদাগরের হুকুমে, তারা অহিদিদির সযত্ননির্মিত পিঠে-পুলি খেল বলেই না গয়লাপাড়ার বনে দুই শতকের বন্ধ্যা গাছে গাছে আমের বোল ধরল। কত উপমাই না গড়ে উঠতে পারে আলি-ভুলির নতুন দেশের! অহিদিদিও কি তাঁর বাল্যে সব ভূতুড়ে-র ডানপিটে অবাধ্য মেয়ে লক্ষ্মীর (সে গল্পের নামও ‘লক্ষ্মী’) মতো মণি-ঝোরার জল চেখেছিলেন? যা নেই তা দেখার দিব্যদৃষ্টি পেয়েছিলেন? স্বপ্ন-জাগরণের ভেদরেখা লোপাট করা ‘লক্ষ্মী’কে পড়ি, একই বইতে পাই অহিদিদিকে, তবু নাকি ছোটদের জন্য লেখায় মেয়েরা তেমন নজরে আসে না! কেমন পাঠক আমরা?

Advertisement

মস্ত দিদি সোনা ছোট্ট বোন টিয়াকে নিয়ে গৃহত্যাগ করেছিল, সাবালক সংসারের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে; আবার সেই সংসারেরই আদরে-আহ্লাদে তাদের প্রত্যাবর্তন। এর মাঝখানে লীলা মজুমদারের মাকু উপন্যাসের লা জবাব ঘটনা আর ঘটনাহীনতা। গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ববির বন্ধুতে কিশোরী মিনি যদি বাদ পড়ত মিমুনের জঙ্গলে শিকারযাত্রা থেকে, তবে মা-মরা ভালুকছানার নাম কে রাখত ববি? কে-ই বা সেই বুনো ছানাকে প্রথম দিন থেকে পোষ মানানোর চেষ্টা করত? ববি যখন কিছুতেই মানুষের সংসারের মানানসই হচ্ছে না, তাকে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যখন প্রায় স্থির, তখন ববিকে নিয়ে মিনির হারিয়ে যাওয়া। পরতে পরতে রোমাঞ্চের সঙ্গে মেশে উষ্ণতা, সংবেদন, মায়া-মমতা। সে ১৯৫৭ সালের কথা; আজকাল কি রোমাঞ্চের সঙ্গে পরের বালাইগুলো অচল? এগারো বছর পর হাওয়াগাড়ি গাড়ি হাওয়া। মিনির বদলে কিশোরী মিতুলের বয়ানে দেখি ওদের অসামান্য মামুর গাড়ি অথবা ছেলে বিজলীকে (ডাকনাম বিজু), যাকে চলতে দেখলে পথচারীরা বলে, “দ্যাখ দ্যাখ, ইতিহাসের একটা পাতা উড়ে যাচ্ছে।” বিজুর তালে তাল মিলিয়ে ওদের বাবা বেছেছেন ঐতিহাসিক বাসস্থান ‘পারিজাত’, যেখানে বিদ্যুতের বদলে গ্যাসের আলো সুবিধাজনক, বৃষ্টি পড়লে ভিজবার জন্য বাড়ির বাইরে যেতে হয় না, প্রথম রাতেই আবিষ্কৃত হয় বাড়ির বহু পুরনো বাসিন্দা এক কেউটে সাপ। মিতুল ছাড়া কে-ই বা পারত মামু আর বাবার কাহিনির এমন আশ্চর্য চলন বানাতে!

মিতুলকে আজকের দিনে বেশি পাঠক চেনেন না। তার কারণও আছে। মিতুল যতই বলে তাদের গল্পহীন গল্প, আজকের সাবালক পাঠক ততই ভাবেন, সব্বোনাশের মাথায় বাড়ি! কোথায় লুকাই এমন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থীকে, যাতে বাড়ির নাবালক-নাবালিকা পরীক্ষার্থীদের চোখে না পড়ে! চোখে পড়লে আর মনে ধরলে যে ভাবীকালের ‘কেরিয়ার’-এর দফারফা!

লীলা মজুমদার আর গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দু’জনেই বাল্যে ডানপিটেমির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। কিন্তু সেই যে মিনু প্রজাপতি ধরতে বড়দার টেবিলে উঠে পায়ের ধাক্কায় দোয়াত উল্টে কালিতে মাখামাখি করেছিল দরকারি বই, বড়দার শখের ডায়েরি থেকে ছিঁড়েছিল সাত-সাতটা পাতা নৌকো বানাবে বলে, কঞ্চির তিরধনুক নিয়ে যে পানিপথের যুদ্ধ লড়ত, সঙ্গীকে রানা প্রতাপ সাজিয়ে, তার স্রষ্টা তেমন ডানপিটে ছিলেন বলে শুনিনি। কিন্তু খাতার শখ ছিল বেজায়। হাতে দু’-চার পয়সা জমলে বোনেরা যখন ভাবত কী কেনা হবে, আশাপূর্ণাকে তার দিদি বলত, “…তুই তো সেই রুল টানা খাতা কিনে পয়সাটা খরচ করে ফেলবি।” মিনুর গল্পের নামও ‘খাতা’ (অবশ্য রবি ঠাকুরের ‘খাতা’র মতো অত নির্মম নয় এ গল্প), যাতে সে লিখেছিল, “…ঠামা বলেন, ভাল বিয়ে হবে… আমি বিয়ে চাই না— বিয়ে ভাল নয়।” কিন্তু খাতা পড়ে রইল বাপের বাড়িতে, বিয়ের পর এমনই ‘সাবালিকা’ হয়ে গেল মিনু, যে ও খাতার জন্য কোনও মনকেমন নেই তার। বড়দা তো অনেক দিন পরে দেখে বোনকে চিনতেই পারেন না। মিনু কি দাঁড়িয়ে সত্যবতী-সুবর্ণলতার উল্টো বাঁকে? এক জন সত্যবতীর লড়াইয়ের পিছনে জমে থাকে কত বশ্যতা, কত নীরবতা! অথচ বাল্যের পরিসরে কত মিনুর চলনেবলনে পড়া যায় সত্যবতীর সম্ভাবনা!

বাল্য-কৈশোরের জন্য লেখায় মেয়েরা আছে, তাদের রকমফেরও আছে। এখানে রইল তার কয়েকটিমাত্র নমুনা, যা নাকি কোনও না কোনও নারী-কথোয়ালের বিন্যাসেই এসেছিল পাঠকের কাছে। পরিপূরকের উপক্রমণিকা কত ভাবেই না শুরু হতে পারে। ধরা যাক রবি ঠাকুরের পুপেদিদির কথাই। সত্যযুগে দেখার জানা বা ছোঁয়ার জানা জানত না মানুষ, জানত একেবারে হওয়ার জানা— এমন কথায় পুপেদিদি আমল দেবে না, এই ছিল দাদামশায়ের ধারণা। কারণ, মেয়েদের মন নাকি প্রত্যক্ষকে আঁকড়ে থাকে। কিন্তু পুপেদিদি উৎসুক হল। সুকুমারের শালগাছ হওয়ার স্বপ্নে পুপে হাসলেও দাদামশায় নিশ্চিত যে সুকুমারের আঁকা ছেলেমানুষি ছবি পুপের কাছেই সযত্নে রাখা আছে। এই অভিনব বর্ণ-গন্ধের ফুল-ফোটানো এক বালিকাকে তৈরি করে দিলেন রবীন্দ্রনাথ।

কিংবা বিভূতিভূষণের কথকতায় চলে আসেন সেই দয়াময়ী সাহসী পল্লীবধূ বামা, নিজের বিপদ তুচ্ছ করে যিনি ফাঁসুড়ে-ডাকাত-স্বামী-শ্বশুরের হাত থেকে বাঁচিয়ে দেন এক অপরিচিতকে। আজ কে বা মনে রাখে ‘বামা’র মতো স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিদের?

ভুলতে চাইলে পাঠককে ঠেকায় কার সাধ্যি! তাই বলে এত সব বিচিত্র ‘আছে’র প্রবাহ তো ‘নেই’ হয়ে যেতে পারে না!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement