নিজস্ব চিত্র।
রাজ্য জুড়ে এখন চলছে মাধ্যমিক পরীক্ষা। কবীর সুমন গেয়েছিলেন, ‘হাতে বন্দুক পায়ে বন্দুক দেহরক্ষী, দেহরক্ষী/নেতা বাঁচবেন নেতা বাঁচবেন বড় ঝক্কি, বড় ঝক্কি’। তা, নেতাকে বাঁচাবার দায় তো রাষ্ট্রকে নিতে হবেই, তাঁর উপর বিরোধী পক্ষ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী পর্যন্ত অনেকেই প্রাণঘাতী হামলা চালাতে পারে। কিন্তু মাধ্যমিকের মতো পরীক্ষার আয়োজনে যখন সেই রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বজ্র আঁটুনি দেখতে পাই, তখন দুশ্চিন্তা না হয়ে যায় না।
মাধ্যমিকের প্রশ্নপত্র পরীক্ষার হলে পৌঁছনোর আগে কোন কোন সুরক্ষা-বলয়ের মধ্যে দিয়ে যায়, তা পাঠকের জানা আছে কি? মধ্যশিক্ষা পর্ষদ থেকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বাক্সবন্দি অবস্থায় প্রথমে পৌঁছয় স্থানীয় থানায়। সংশ্লিষ্ট পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে প্রধানশিক্ষক-সহ দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা গোটা দিন থানায় বসে সেই প্রশ্নপত্র গুনে-গেঁথে আলাদা আলাদা প্যাকেটে ভরে সিল করেন। অতঃপর প্যাকেটগুলো স্টিলের ট্রাঙ্কে তালাবন্দি হয়ে গাড়ি চড়ে নির্দিষ্ট পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছয়। সঙ্গে থাকে বন্দুকধারী পুলিশ। পরীক্ষাকেন্দ্র যে স্কুলে হয়, সেখানকার প্রধানশিক্ষকেরও সেই সিল করা প্যাকেট খোলার অনুমতি থাকে না। প্যাকেট খোলা হয় একেবারে পরীক্ষার হলে, পরীক্ষার্থীদের সামনে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর খাতাগুলিও একই ভাবে ‘প্যাকেটিং’ এবং ‘সিলিং’ অন্তে বাক্সবন্দি হয়ে কড়া প্রহরায় পুনরায় থানায় চালান হয়।
আর পরীক্ষা চলাকালীন সুরক্ষা-বলয়টিও প্রতি বছর নিশ্ছিদ্র থেকে নিশ্ছিদ্রতর হচ্ছে। একটি ভোটকেন্দ্রে যেমন, ঠিক তেমনই মাধ্যমিক পরীক্ষাকেন্দ্রের চার দিকে ১৪৪ ধারা জারি থাকে, স্কুলের গেটে অতন্দ্র প্রহরায় থাকেন রাইফেলধারী পুলিশকর্মী। ভিতরেও থাকে বেশ কয়েকটি ধাপের নিরাপত্তা বলয়। প্রতিটি ঘরে ৩০ জন পরীক্ষার্থী-পিছু থাকেন এক জন ইনিভিজিলেটর, সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় এক জন সেন্টার সুপারভাইজ়ার, পুরো ব্যবস্থাটির উপর নজরদারির জন্য পর্ষদ-প্রেরিত এক জন বিশেষ পর্যবেক্ষক আর তাঁর উপর থাকে একটি ভ্রাম্যমাণ পর্যবেক্ষক দল, যাঁরা এক-একটি কেন্দ্রে আচমকা হানা দিয়ে বেড়ান এবং প্রতি মুহূর্তে কন্ট্রোলরুমে খবর পাঠাতে থাকেন। এর উপর মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সাম্প্রতিকতম ঘোষণা— এ বছর কিছু স্পর্শকাতর পরীক্ষাকেন্দ্রের আশেপাশের সমস্ত এলাকায় পরীক্ষা চলাকালীন ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকবে। হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়া ঠেকাতেই নাকি এই ব্যবস্থা।
গণতন্ত্রে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ক্ষমতার অনেক গল্প জড়িয়ে থাকে, থাকে কোটি কোটি টাকার খেলা। কিন্তু একটি ১৬-১৭ বছরের ছেলে বা মেয়ে সারা বছর স্কুলে কী শিখল বা শিখল না— তার মূল্যায়নের প্রশ্নে এতটা অবিশ্বাসের বাতাবরণ লাগে? বিদ্যালয় স্তরে শিক্ষক-ছাত্রের শ্রদ্ধা-ভালবাসায় মাখামাখি সম্পর্কটা কবে এবং কী ভাবে এতখানি বিষাক্ত হয়ে গেল— বোধ হয় ভেবে দেখার সময় এসেছে।
এক দিকে নজরদারির বাঁধন যতই আঁট হয়ে চেপে বসছে ব্যবস্থাটির ঘাড়ের উপর, অন্য দিকে ততই বাড়ছে ‘ফস্কা গেরো’-র পরিমাণ। পরীক্ষাকেন্দ্রের সামনে পুলিশকর্মী বন্দুক হাতে প্রহরায় নিয়োজিত, পিছনে টিকটিকির মতো দেওয়াল বেয়ে উঠে জানলা গলিয়ে টুকলির জোগান দিচ্ছে স্থানীয় মস্তানের দল। ‘অসদুপায় অবলম্বন করলে পরীক্ষা বাতিল হতে পারে’— এ-হেন সতর্কবাণীতে আজকাল আর ভবি ভোলে না। সকলেই জানে, টুকলি করতে গিয়ে ধরা পড়লে কিস্যু হবে না। ইনভিজিলেটরদের প্রাণের ভয় আছে, আর পরীক্ষাকেন্দ্রের চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চের দামও নেহাত কম নয়।
এর নাম পরীক্ষা! যে শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘ ১০ বা ১২ বছরের শিক্ষাদানের পরও আমাদের ছাত্রছাত্রীদের সৎ, শ্রদ্ধাবান, সংযমী এবং বিনয়ী হতে শেখায় না, সেই শিক্ষার মূল্য কী? প্রতি বছর মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পাশের ১০-১২ লক্ষ সার্টিফিকেট তবে আমাদের জাতি হিসেবে কোন গৌরবোজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?
জানি, সমাজের বা রাষ্ট্রের অন্য দশটা ক্ষেত্রের মতো পরীক্ষাতেও নিয়ম বা অনুশাসন দরকার। পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়াটা কখনওই বাঞ্ছনীয় নয়। তার জন্য আগাম সতর্কতা প্রয়োজন। কেউ না কেউ পরীক্ষাকেন্দ্রে অসদুপায় অবলম্বন করবেই, তাই নজরদারিও চাই। কিন্তু পাশাপাশি এটাও ভেবে দেখা দরকার যে, একটি পরীক্ষা-ব্যবস্থাকে এই ভাবে ক্রমাগত আরও নিশ্ছিদ্র করে তোলার মাধ্যমে আসলে ব্যবস্থাটির অসারতাই প্রমাণিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’-এর দাদাঠাকুর বলেছিলেন, ‘যিনি তোমাকে মুক্তি দেবেন, তাঁকেই তুমি কেবল বাঁধার চেষ্টা করেছ’। যে শিক্ষা আমাদের আনন্দের আলোয়, অসীমের আকাশে মুক্তি দিতে পারত, আমরা এ ভাবে তাকেই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছি। সেই সঙ্গে নিয়মের জাল, আইনি সংস্কার আর ‘গভর্নমেন্ট অর্ডার’-এর আচারে-বিচারে আচ্ছন্ন করে ফেলছি নিজেদের বিচারবুদ্ধিকেও।
শিক্ষা নিয়ামকরা বরং অচলায়তনের পাথরের দেওয়ালগুলি প্রতিনিয়ত আরও উঁচু করার বদলে এ বার ভেঙে দেওয়ার কথাই ভাবুন। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাগুলো ঐচ্ছিক করে দেওয়া কি খুব অসম্ভব? পরবর্তী কালে উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলি না হয় প্রত্যেকে নিজেদের মতো করে আবেদনকারীর মেধা বা যোগ্যতা বিচার করে নেবে।
মার্কশিট কখনও ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাগত কিংবা অন্য কোনও রকম যোগ্যতার সামগ্রিক পরিচয় বহন করে না, করতে পারে না। তাই আর ‘পরীক্ষা’ নয়, বরং যথার্থ ‘মূল্যায়ন’-এর বিকল্প পরিসরগুলো নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হোক। আলো আসুক। মুক্ত হোক, স্বাধীন হোক শিক্ষার পরিসর।