সারা পৃথিবীতেই এখন সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ডিজিটাল কারেন্সি বা সিবিডিসি, অর্থাৎ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক কর্তৃক চালু করা ডিজিটাল মুদ্রা নিয়ে প্রবল আগ্রহ। ডিজিটাল অর্থব্যবস্থার চেহারা কেমন হবে, মুদ্রার চরিত্র কী হবে, তা নিয়ে বিস্তর তর্ক চলছে। এবং, বলা হচ্ছে, সিবিডিসি-ই হল মুদ্রার বিবর্তনের পরের ধাপ— কড়ি থেকে কয়েন, তা থেকে নোট; এ বার নোট থেকে ডিজিটাল মুদ্রা।
অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কই ডিজিটাল মুদ্রা বাজারে ছাড়ার যৌক্তিকতা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছে। কিছু দেশ বেশ খানিকটা এগিয়েছে। সুইডেন আর চিন— একটা উন্নত অর্থব্যবস্থা, অন্যটা উদীয়মান অর্থব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য— দেশে ডিজিটাল মুদ্রার পাইলট পরীক্ষানিরীক্ষা আরম্ভ করেছে। ২০২০ সালে বাহামাজ়-এর কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক চালু করে দিয়েছে তাদের ডিজিটাল মুদ্রা, ‘স্যান্ড ডলার’। দুনিয়ায় প্রথম। এই এপ্রিলে ইস্টার্ন ক্যারিবিয়ন কারেন্সি ইউনিয়নও চালু করল ডিক্যাশ— ইস্টার্ন ক্যারিবিয়ন ডলারের ব্লকচেন-নির্ভর ডিজিটাল সংস্করণ।
ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কও ইঙ্গিত দিয়েছে যে, অদূর ভবিষ্যতে এ দেশেও সিবিডিসি-র দেখা মিলতে পারে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর টি রবি শঙ্কর সম্প্রতি এক ভাষণে এই মুদ্রার সুবিধা এবং ঝুঁকির কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করলেন। সুইডেনের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বললেন, সে দেশে বেসরকারি ডিজিটাল পেমেন্টের দাপটে পেপার কারেন্সি, অর্থাৎ নোট নিতান্তই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল— ডিজিটাল ক্রোনা চালু হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ফের ক্রোনাকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাবে বলেই আশা। শ্রীশঙ্কর আরও বললেন যে, যে দেশে নগদ টাকার ব্যবহার বেশি, সেখানে ডিজিটাল মুদ্রা চালু করলে ব্যবস্থাটির কুশলতা বাড়ে।
সিবিডিসি ব্যবহারের আরও একটা সুবিধা হল, এই লেনদেনে কোনও তৃতীয় পক্ষ থাকে না— যিনি দিচ্ছেন, আর যিনি পাচ্ছেন, তাঁরা এক বারেই লেনদেন মিটিয়ে নিতে পারেন। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের মাধ্যমে লেনদেন করলে ইন্টারব্যাঙ্ক সেটলমেন্টে দেরি হওয়ার একটা ঝুঁকি থেকেই যায়। আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটি আরও বেশি। অন্য দিকে, বেসরকারি ভার্চুয়াল কারেন্সির তুলনায় সিবিডিসি অনেক বেশি নিরাপদ। বিটকয়েনের মতো বেসরকারি মুদ্রার সঙ্গে সিবিডিসি-র সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল, এখানে জানা থাকবে, এই মুদ্রার দায়িত্ব শেষ অবধি কার। দায়িত্বটি যে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক এই মুদ্রা বাজারে ছাড়ছে, তার। শ্রীশঙ্কর তাঁর বক্তৃতায় ইঙ্গিত করলেন, সিবিডিসি-র সুবিধাগুলি ভারতের ক্ষেত্রে বেশ প্রাসঙ্গিক। মনে করিয়ে দিলেন, ডিজিটাল কারেন্সি চালু হলে নোট ছাপার খরচও বাঁচবে।
তবে, সিবিডিসি-তে ঝুঁকিও আছে। ডেপুটি গভর্নর উল্লেখ করলেন, যদি সিবিডিসি সাধারণ মানুষের কাছে, ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যাঙ্কে টাকা জমা রাখার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, তা হলে মুশকিল— ব্যাঙ্কে আমানত কমলে তাদের পক্ষে ঋণ দেওয়ার জন্য নগদের জোগান কমবে; ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককে আলাদা করে নগদের জোগান দিতে হবে।
এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে সুদের হারকে শূন্যেরও নীচে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। সেখানে সিবিডিসি-তে ঋণাত্মক সুদ চালু করা যেতে পারে। শ্রীশঙ্কর বললেন যে, এমনটা হলে সিবিডিসি মুদ্রার বদলে আর্থিক সম্পদ হয়ে উঠতে পারে— অর্থাৎ, লেনদেনের মাধ্যম নয়, বরং টাকা জমা রাখার মাধ্যম। তা ছাড়াও, ডিজিটাল মুদ্রার ক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তার প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ।
সিবিডিসি চালু করার মতো ব্যবস্থাগত পরিবর্তন কতখানি লাভজনক, তা বিচার করার শ্রেষ্ঠ পন্থা হল, দেশের বৃহত্তর উন্নয়ন-লক্ষ্যগুলির উপর এই পরিবর্তনের কী প্রভাব পড়বে, তা দেখা। ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের ক্ষেত্রে ভারত ইতিমধ্যেই গোটা দুনিয়ায় অগ্রগণ্য। সফল ভাবে ইউনিভার্সাল পেমেন্ট ইন্টারফেস বা ইউপিআই চালু করার পর ভারত এখন বেসরকারি কনসর্টিয়াম-ভিত্তিক নিউ আমব্রেলা এনটিটিজ় বা এনইউই নামক ব্যবস্থার পথে হাঁটার জন্য তৈরি হচ্ছে। ডিজিটাল লেনদেনের ক্ষেত্রে যখন এত রকম ব্যবস্থা আছেই, তখন কি সিবিডিসি-র আদৌ কোনও প্রয়োজন আছে— এই প্রশ্নটা করা দরকার।
সিবিডিসি-র পক্ষে যে যুক্তি, সেগুলো মূলত আসে আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষিতের বাইরে থেকে। প্রথমত, ভারতের জাতীয় স্বার্থেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও লগ্নির ক্ষেত্রে আরও বিশ্বায়িত হয়ে ওঠা প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই পঞ্চাশটিরও বেশি দেশ সিবিডিসি-র সম্ভাব্যতা বিচার করে দেখছে— ফলে বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ সিবিডিসি-কেন্দ্রিক। এখন আন্তর্জাতিক লেনদেন যে সুইফ্ট পদ্ধতির ভিত্তিতে চলে, তা রীতিমতো খরচসাপেক্ষ— টাকা এবং সময়, উভয় দিক থেকেই। কাজেই, এটা নিশ্চিত যে, অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, লগ্নি, এমনকি বাইরে থেকে টাকা পাঠানো, প্রতিটি ব্যাপারই বহুজাতিক সিবিডিসি নেটওয়ার্কের উপর নির্ভরশীল হবে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে ভারতেরও সিবিডিসি থাকা প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, অন্য কোনও দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ডিজিটাল মুদ্রা আন্তর্জাতিক লেনদেনের মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে, এই আশঙ্কা আছেই। তেমন হলে, দেশের বাজারেও সেই ডিজিটাল মুদ্রার চাহিদা বাড়বে। চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে আন্তঃসীমান্ত ডিজিটাল ইউয়ানের ব্যবহার বাড়লে ভারতে তথ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিও বাড়তে পারে, কারণ ডিজিটাল লেনদেনের ক্ষেত্রে লেনদেনকারীর তথ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছেই। এই জাতীয় বিপদ ঠেকানোর সেরা উপায় হল, আন্তঃসীমান্ত সিবিডিসি লেনদেনের জন্য আন্তর্জাতিক প্রোটোকল তৈরি করা। সেই প্রক্রিয়ায় যদি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়, তা হলে ভারতের নিজস্ব ভরসাযোগ্য ও কার্যকর সিবিডিসি থাকা দরকার।
দেশে অভ্যন্তরীণ ডিজিটালাইজ়েশনের ক্ষেত্রেও সিবিডিসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ইউপিআই-নির্ভর ডিজিটাল লেনদেন বহুলাংশে সফল ঠিকই, কিন্তু তা ডিজিটাল ডিভাইড দূর করতে পারেনি। দেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়ায় বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির যোগদান এখনও অকিঞ্চিৎকর— সেই দায় মূলত সরকারি ব্যাঙ্কগুলিই পালন করে, ভাল রকম আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে। যে হেতু লাভ-নির্ভর এনইউই ব্যবস্থাও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট-ভিত্তিক হবে, এর ফলে ডিজিটাল ডিভাইড আরও বাড়বে, সেই আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে ভারতে সর্বজনীন ডিজিটালাইজ়েশনের কাজটা রীতিমতো কঠিন। সেই ক্ষেত্রে সিবিডিসি এনইউই-র বিকল্প হতে পারে— ব্যাঙ্কের পরিসরের বাইরে, ডাকঘরের মতো অন্যান্য পরিকাঠামো ব্যবহার করে, তা কাজ করবে।
তবে, সিবিডিসি-র বিরুদ্ধে যুক্তিগুলোও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। ব্যাঙ্কে নগদের অভাব ঘটার সম্ভাবনাটি তো আছেই। তার পাশাপাশি, ভারতের ব্যাঙ্কগুলোয় অনাদায়ি ঋণের সমস্যাও বেশ প্রকট। এই দুটো সমস্যা চরিত্রগত ভাবে আলাদা ঠিকই, কিন্তু এটাও প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, নগদের অভাব, আর ব্যাঙ্কের সচ্ছলতার অভাব পরস্পরকে বাড়িয়ে তোলে। ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা যে হেতু এখনও মূলত সরকারি ব্যাঙ্কনির্ভর, তাই এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই দেশে সিবিডিসি চালু করতে হলে অন্য দেশের তুলনায় সরকার ও রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে অনেক বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বারে বারেই বলা হচ্ছে যে, বেসরকারি ভার্চুয়াল মুদ্রার তুলনায় সিবিডিসি অনেক বেশি নিরাপদ বিকল্প। কিন্তু, ঠিক কী ভাবে সেই নিরাপত্তা বজায় রাখা হবে, তা এখনও অস্পষ্ট। বেসরকারি ডিজিটাল মুদ্রা কি নিষিদ্ধ হবে, না কি দু’ধরনের মুদ্রাই পাশাপাশি থাকবে? নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তাকে সফল ভাবে প্রয়োগ করা দুষ্কর কাজ— বিশেষত, এই গোত্রের বেসরকারি ডিজিটাল মুদ্রা চরিত্রে বিকেন্দ্রিত, এবং তার কোনও ভৌগোলিক গণ্ডি নেই। এই নিষেধাজ্ঞা প্রকৃত প্রস্তাবে বিপরীত ফলদায়ীও হতে পারে— পুরো লেনদেনই সরকারি নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের অন্তরালে চলে যেতে পারে।
সিবিডিসি চালু করা মানে দেশের আর্থিক পরিকাঠামোয় এক মস্ত পরিবর্তন করা। বস্তুত, গোটা দুনিয়ায় এটাই একমাত্র আর্থিক ঘটনা, যেটা কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই ঘটে চলেছে। ঠিক সেই কারণেই এই মুদ্রা চালু করার ক্ষেত্রে প্রতিটি ধাপকে সব দিক থেকে খুঁটিয়ে দেখা জরুরি। টাকার চরিত্রে এমন গুরুতর পরিবর্তন আনার আগে আরও বেশি আলোচনা, তর্ক চাই। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর তাঁর বক্তৃতায় যে কথাগুলো বলেছেন, সেখান থেকেই এই আলোচনার সূচনা হতে পারে।
ইনস্টিটিউট অব ইকনমিক গ্রোথ, নয়া দিল্লি