সাত মন তেল পুড়িয়ে সর্ষের মধ্যেই ভূত খুঁজে পেয়েছে সিপিএম। ক্রমাগত রক্তক্ষরণের দায় বর্তেছে বাহাত্তুরে নেতাদের উপর। বঙ্গদেশের পথে-প্রান্তরে পক্বকেশ বৃদ্ধদলকে নিয়ে যৎপরোনাস্তি বিরক্তি, এবং নবীনতর প্রার্থী-দলকে নিয়ে কিঞ্চিদধিক উৎসাহবাণীই হয়তো তাঁদের এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য করেছে। তার পরেও প্রশ্ন উঠছে, নৈতিক ও সাংগঠনিক আসল ফাঁকফোকর না খুঁজে এক দলকে সহজে বলির পাঁঠা করে দেওয়া হল কি না, মন-মাথায় বার্ধক্য ত্যাগ করতে না পারলে বয়স্কদের সরিয়ে লাভ হবে কি না প্রভৃতি। কিন্তু তারও আগে প্রশ্ন হল, দলটা বুড়ো হয়ে গেল কেন? এর জবাব যেমন ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট দল খুঁড়ে বার করতে হবে, তেমনই বিশ্ব জুড়ে কমিউনিস্ট রাজনীতিতেও চোখ রাখতে হবে।
১৯১৭ সালে, সোভিয়েট প্রতিষ্ঠার কালে বলশেভিক পলিটবুরোর সকলেই অনূর্ধ্ব ৪০, শুধু লেনিন ৪৭। ১৯৬৫-তে পলিটবুরোর প্রবেশদ্বার ৫০-এর নিম্নসীমায় বেঁধে দেওয়া হয়। বেড়ে যায় গড় বয়স, ন’বছরের মধ্যে পৌঁছয় ৬৫-তে— চাকরিক্ষেত্রে অবসরের বয়স। অতএব, স্তালিনের পলিটবুরো রুজ়ভেল্টের ক্যাবিনেটের চেয়ে গড়ে দশ বছর কনিষ্ঠ, ক্রুশ্চভ এবং আইজ়েনহাওয়ারের আমলে সমান সমান, ব্রেজ়নেভের গোষ্ঠী নিক্সনের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। বিশ শতকের শেষে চিনে পার্টি চালাতেন ‘এইট এল্ডার্স’ বা আট জ্যেষ্ঠ নেতা— সবাই সত্তরোর্ধ্ব। বলা হত, “৮০ বছরের নেতারা ৭০ বছর বয়সি অধস্তনদের নিয়ে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, জনগণ ৬০ বছরে অবসর নেবে!”
কমিউনিস্টরা কান দিলেও সমস্যা রয়েই যায়। গড় মানুষের মতো রাজনীতিকদেরও বয়সের সঙ্গে কমে সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী শক্তি ও প্রতিক্রিয়ার দ্রুততা। সিদ্ধান্তগ্রহণের গুণমানের উপর এর প্রভাব আছে কি না, তা তর্কসাপেক্ষ ও ব্যক্তিনির্ভর। কিন্তু এটা সত্যি, ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে দীর্ঘদিন ক্ষমতাশীর্ষে বসিয়ে রাখার কারণ তাঁদের চূড়ান্ত কর্মক্ষমতা নয়, রাজনৈতিক মর্যাদা ও হাতযশ। প্রাচীন গ্রিসে ক্ষমতাতন্ত্রের ব্যাখ্যায় প্লেটো বলেছিলেন, “জ্যেষ্ঠবর্গ শাসন করবে, আর কনিষ্ঠবর্গ সমর্পণ।” জীবনের শেষ দু’বছর কাজই করতে পারতেন না সত্তরোর্ধ্ব ব্রেজ়নেভ। তৎসত্ত্বেও, দীর্ঘ নিষ্প্রশ্ন ক্ষমতাভোগীকে সরে যেতে বলার মতো নেতা সে দেশে ছিলেন না। তরুণ গর্বাচভ যত দিনে ক্ষমতায় এসে সংস্কার শুরু করেন, তত দিনে সোভিয়েট ব্যবস্থার ক্ষয়রোগ বহু দূর চারিয়ে গিয়েছে, আর মেরামতির জায়গা নেই। জীবনের শেষ পর্যায়ে লেখার ক্ষমতা হারান পার্কিনসন্সে আক্রান্ত মাও ৎসে তুং, কথাও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু ৮২ বছরে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পদে ছিলেন তিনি। যেমন ছিলেন উত্তর কোরিয়ার কিম ইল-সুং (৮২) বা যুগোস্লাভিয়ার টিটো (৮৭)।
এখানেই কমিউনিজ়মের মূল শত্রু— আমলাতন্ত্র। স্বৈরাচারী শক্তি, যা অর্থনীতি ও সমাজের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ চায়, আমলাতন্ত্রে তার বড় প্রয়োজন। যাঁরা সরকারের হয়ে কাজ করেন, উপরতলার নির্দেশের প্রশ্নহীন বাস্তবায়নই তাঁদের দায়িত্ব, স্বেচ্ছায় বা বাধ্যতায়। শাসকের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার প্রধান ভিত্তি হতে পারেন তাঁরাই। রাজনৈতিক শ্রেণির সিদ্ধান্ত কার্যকর করার এর চেয়ে সহজ পথ আর আছে কি? সর্বহারার একনায়কত্বের আধিপত্যে বহুসংখ্যক অনুগামী প্রয়োজন, যাঁরা নেতাদের কথামতো কাজ করে চলেন। সংসদীয় ক্ষমতালাভেও তা-ই। কমিউনিস্ট জমানায় তাই পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করলে মোটের উপর উন্নতি বাঁধা, বিপ্লবের শৃঙ্খলাবদ্ধ সৈনিক হিসেবে সে রাষ্ট্রের কাজে লাগবেই। বেশি ভাবনাচিন্তা বাঞ্ছনীয় নয়, নেতৃত্বের আজ্ঞা পালন এবং যথাযথ কার্য সম্পাদনই মুখ্য। এবং, এতেই পার্টির ক্ষতি। যে রাষ্ট্রে শুধু কিছু আজ্ঞাবহ দাস গুচ্ছবৎ জেগে থাকে, সেখানে সমাজ বলেই কার্যত কিছু থাকে না, স্বাধীন প্রতিষ্ঠান বা মুক্ত চিন্তা বিরাজ করে না। এটাই সামগ্রিক আমলাতন্ত্র। দক্ষিণপন্থায় তা পরিচিত, উপরের নেতারাই যা করার করেন, তৃণমূল স্তর মন্ত্রমুগ্ধ ও স্বরহীন। ক্ষমতার এই চরিত্রের বিরোধিতা বামপন্থীদের ঐতিহাসিক কর্তব্য, কিন্তু দেশে-দেশে তাঁরা সেই ভাষাতেই চালিত হন। পড়ে থাকে সংগঠনসর্বস্বতা— জনতার সঙ্গে রচিত হয় দূরত্ব। ইতিহাসবিদ অরল্যান্ডো ফাইজিস একে বলেন ‘ডিক্টেটরশিপ অব দ্য বুরোক্র্যাসি’। আর, এই স্থিতাবস্থাতেই উৎপত্তি বৃদ্ধতন্ত্রের— যুগ-যুগ ধরে যে মাথারা চলতি নিয়ম টেনে নিয়ে যাবেন, পাল্টাতে চাইবেন না। বৃদ্ধতন্ত্র বস্তুত রাজতন্ত্রের চরিত্র। কেননা, সে সমাজে বয়োজ্যেষ্ঠকে সম্মান করাই প্রথা, বয়স ও ক্ষমতা সমার্থক। কিন্তু যে রাজনীতি প্রশ্ন করার অধিকার শেখায় গোটা পৃথিবীকে, তারাও এই সর্বগ্রাসী স্থবিরতায় ডুবে যাবে কেন?
ছোটবেলায় দেখতাম, দুই কমরেডের কাঁধে ভর দিয়ে কায়ক্লেশে পলিটবুরো বৈঠকে ঢুকছেন হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ। তাঁর পরে, প্রকাশ কারাট দৃশ্যত তরতাজা হলেও পরিভাষায় কণ্টকিত বক্তৃতা বুঝতাম না। এই অনমনীয় মনোভাব, যা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এবং নিয়মতান্ত্রিক স্থিতাবস্থায় বিশ্বাস করে, তিলে তিলে মৃত্যুই তার ভবিতব্য।