সাগরসঙ্গমে ভিড়সমাগমে
ganga sagar

সর্বভারতীয় লোকবিশ্বাস যখন মিশে যায় স্রোতে স্রোতে

মাঘমেলায় ভিড় হয় কেন? হিন্দু বিশ্বাস, আমরা নদীতে স্নান করে পাপমুক্ত হই। ফলে নদী আমাদের সঞ্চিত পাপে ভরে যায়।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২২ ০৯:৪৪
Share:

গত কয়েক দিন ধরে গঙ্গাসাগরে ভিড়ের খবর পড়তে পড়তে ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড উপন্যাসের লেখক অল্ডাস হাক্সলির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বেদান্ত ও ভারতীয় সংস্কৃতির ভক্ত হাক্সলি এক বার এ দেশে এসেছিলেন। সে যাত্রায় জেস্টিং পাইলেট: দ্য ডায়রি অব আ জার্নি নামে চমৎকার একটি ভ্রমণকাহিনিও লিখেছিলেন। ১৯২৬ সালে বারাণসীতে গিয়েছিলেন তিনি। ১৪ জানুয়ারি সে বার পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। পুণ্যতিথি উপলক্ষে ঘাটে লাখো জনতার ভিড়। হাক্সলি সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে জটিল প্রশ্ন তুলেছিলেন, রাহুর গ্রাস থেকে সূর্যকে বাঁচাতে হিন্দুদের এই যে তুমুল ভিড়, ভারতকে বাঁচাতে এঁদের কত জনের সাড়া পাওয়া যেত?

Advertisement

আজও মকরসংক্রান্তিতে গঙ্গাস্নানে ভিড় হবে, হবেই। অমন যে জয়দেব-কেঁদুলি, সেখানেও মিথ— গঙ্গা নাকি গীতগোবিন্দর কবি জয়দেবকে কথা দিয়েছিলেন, এ দিন তিনি ভক্তের জন্য অজয় নদের স্রোতে প্রবাহিত হবেন। আজ থেকেই অসমে বিহু, কেরলে পোঙ্গল এবং উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগে মাসব্যাপী মাঘমেলা শুরু। হাজার হাজার মানুষ এক মাস তাঁবুতে থাকবেন, কথক-পুরোহিতদের কাছে তুলসীদাস শুনবেন, স্বপাক খাবেন। ভিড় বা ভাইরাস তাঁদের আটকাতে পারবে না।

মাঘমেলায় ভিড় হয় কেন? হিন্দু বিশ্বাস, আমরা নদীতে স্নান করে পাপমুক্ত হই। ফলে নদী আমাদের সঞ্চিত পাপে ভরে যায়। নদীগুলি তাই মাঘ মাসে প্রয়াগের গঙ্গাযমুনা-সঙ্গমে স্নান করে পাপমুক্ত হতে যায়। পাপপুণ্যের ধারণাটি অদ্ভুত। রাজস্থানে গঙ্গা নেই। সেখানেও মা-বাবার মৃত্যুর পর অনেকে শ্রাদ্ধশান্তির জন্য শুধু পুষ্কর তীর্থে থেমে না থেকে হরিদ্বার, বারাণসীতে চলে আসেন, প্লাস্টিকের ক্যান বা জেরিকেনে সম্বচ্ছরের গঙ্গাজল নিয়ে দেশে ফিরে যান। এ দেশে গঙ্গা তো নিছক একটা নদী নয়। ধনী-নির্ধন, রাজা-উজির, সন্ন্যাসী-ফকির নির্বিশেষে সকলের লোকবিশ্বাস। মোগল সম্রাট আকবরের জন্য আগরার কাছে সারান থেকে গঙ্গাজল যেত, গঙ্গাজল ছাড়া অন্য জল খেতেন না বাদশাহ। তামিলনাড়ুতে গঙ্গা নেই, কিন্তু সেখানকার মমল্লাপুরমে আজও আছে পল্লব রাজাদের তৈরি পাথরে খোদাই ৯০ ফুট উঁচু গঙ্গাবতরণ দৃশ্য। কর্নাটকের চালুক্য রাজাদের বাদামি, আইহোল, পট্টডাকাল শহরের ধ্বংসাবশেষ আজও জনপ্রিয় টুরিস্ট সার্কিট। সেই বাদামির মন্দিরগাত্রেও আছে গঙ্গা-যমুনার মূর্তি। সোজা কথায় ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ, কচুবেড়িয়া পেরিয়ে যে নদীটা সাগরে গিয়ে মেশে, তার স্রোতে আসলে সর্বভারতীয় লোকবিশ্বাস।

Advertisement

লোকবিশ্বাস হোক আর যা-ই হোক, নদী শেষ অবধি সাগরে গিয়ে মিশবে, এটা জানতে সাহেবদের শেখানো মানচিত্রের দরকার পড়ে না। প্রশ্ন উপনিষদের ঋষি বলছেন, “যথেমা নদ্যঃ সন্দমানাঃ সমুদ্রায়ণাঃ সমুদ্রং প্রাপ্যান্তং গছতি।” মানে নদীগুলি যেমন সমুদ্রে প্রবেশ করে অদৃশ্য হয়ে যায়, নাম ও রূপের বিভিন্নতা লোপ পেয়ে সমুদ্র নামেই কথিত হয়, সে রকম পুরুষকে লাভ করার পর বাকি সবই অন্তর্হিত হয়। পুণ্যতোয়া গঙ্গা যেখানে সমুদ্রে পড়বে, সেখানে পৌষ-সংক্রান্তির মেলায় স্নান করলেই মুক্তি, ব্রহ্মবাদী ঋষিরা এমন নিদান হাঁকেননি।

দর্শনের পিছন পিছন গল্পের অনুপ্রবেশ। রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণের গল্প। জনজীবনে এগুলিই ছড়িয়ে থাকে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে কারও নামের নিজস্ব কপিরাইট নেই। মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্র নামে হস্তিনাপুরের অন্ধ রাজা আছেন। আবার একই নামের সাপ এবং গন্ধর্বও আছে। কপিলমুনির গল্পটাও সে রকম। কপিলমুনি প্রাচীন সাংখ্যদর্শনের প্রবক্তা। হাল আমলে যোগদিবস নিয়ে যতই মাতামাতি হোক, পতঞ্জলির যোগদর্শন এই সাংখ্যেরই অঙ্গ। সাংখ্য ঈশ্বরে নয়, শুধু পুরুষ ও প্রকৃতিতে বিশ্বাসী। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের যে বিশ্বরূপ, বিশাল পুরুষের মুখগহ্বরে সমস্ত প্রাণীর জন্ম ও মৃত্যু, ফের পুর্নজন্ম, ওটিই নাস্তিক্যবাদী সাংখ্যদর্শন। এই দার্শনিক ঋষিই সগর রাজার ষাট হাজার ছেলেকে ভস্ম করে দিয়েছিলেন?

শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ বলছে, কপিল ব্রহ্মার পুত্র কর্দমের ছেলে। মহাভারতেও দক্ষ, প্রচেতা, পুলহ ইত্যাদি প্রজাপতির সঙ্গে কর্দমের নাম আছে। কিন্তু সেখানে তাঁকে কপিলের বাবা বলা হয়নি। ভাগবত জানাচ্ছে, কর্দম ঋষির সঙ্গে মনুর মেয়ে দেবহুতির বিয়ে হয়। এঁদেরই পুত্র কপিল। এই ভাগবত না জানলে গঙ্গাসাগরের জনসংস্কৃতি বোঝা যাবে না। আজও সাগরে এক দিকে কপিলমন্দিরে স্তোত্রপাঠ, অন্য দিকে ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের মন্দিরে নামগান।

এখানেই গঙ্গাসাগর কুম্ভমেলা থেকে আলাদা। কুম্ভমেলায় দশনামী শৈব ও বৈরাগী আখড়া পাশাপাশি, আর গঙ্গাসাগরে বঙ্গীয় বৈষ্ণবদের একাধিপত্য। শুধু ভিড়ের কারণে গঙ্গাসাগরকে কুম্ভের সঙ্গে তুলনায় বঙ্গীয় আত্মতৃপ্তির রাজনীতি থাকতে পারে, ধর্ম নেই।

সবচেয়ে বড় কথা, দুটো ভিড়ের চরিত্র আলাদা। হরিদ্বার বা প্রয়াগে মেলাটাকে কুড়ি-বাইশটা সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতি সেক্টরে থানা, হাসপাতাল। হর-কি-পৌড়ী ছাড়াও যে কোনও ঘাটে স্নান করতে পারেন, অক্ষয়বট দেখতেও পারেন, নাও দেখতে পারেন। শাহি স্নানের পাঁচ-সাতটা দিন ভিড় ক্রমাগত এগোয়। কাউকেই পুলিশ কোথাও বসার অবসর দেয় না। দরকারে ব্যারিকেড বানিয়ে পাঁচ মিনিটের রাস্তাকে ঘুরপথে পঁচিশ মিনিট করে দেয়। কলকাতার পুজোর ভিড়ে যে ভাবে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হয়!

সাগরদ্বীপে এই পরিকাঠামোগত সুবিধা নেই। সেখানে স্নান সেরে, কর্পূর, নারকেল নিয়ে একটা জায়গাতে গিয়েই হোঁচট খেতে হবে। কপিলমুনির মন্দির। ফলে ভিড় থমকে যাবেই, খোলা আকাশের নীচে লোককে আরটিপিসিআর টেস্ট করতেই হবে।

বছর চারেক আগে ঢুকেছিলাম গঙ্গাসাগরের এই মন্দিরে। দেওয়ালে কালো পাথরের ফলকে ইংরেজিতে লেখা, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন সাজে এই মন্দির উদ্বোধন করেছেন। নতুন সাজ মানে, জয়পুরী পাথরে তৈরি বাসুকির ছাতার নীচে নৃসিংহ মূর্তি, পাশে রাধাকৃষ্ণ। পুরনো মূর্তি তিনটি। তাদের পাথর সিঁদুরলেপা লাল… ভগীরথকে কোলে নিয়ে মকরবাহিনী গঙ্গা, পাশে যোগাসনে-বসা পৈতেধারী শ্মশ্রুমণ্ডিত কপিলমুনি। আর এক পাশে প্রায় এক রকম দেখতে সগর রাজা।

লোকধর্মের চমৎকৃতি এখানেই। রামায়ণ, মহাভারত বা সাংখ্যদর্শনের যুগে গঙ্গা আদৌ মকরবাহনা মাতৃমূর্তি নন। মহাভারতের গঙ্গা প্রায় যৌবনমদে মত্তা। রাজা মহাভিষ স্বর্গে দেবতাদের সভায় গঙ্গাকে দেখেন। এলোমেলা বাতাসে তখন গঙ্গার শাড়ি উড়ে যাচ্ছে, রাজার চোরা চাহনি। নায়িকাও সেই দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন। ব্যাপারটা ব্রহ্মার নজর এড়াল না। তাঁর অভিশাপে মহাভিষ মর্তে প্রতীপ রাজার ছেলে শান্তনু হিসাবে জন্মালেন। অভিশপ্ত প্রেমিকের জন্য গঙ্গাও যখন মর্তে আসতে প্রস্তুত, আট বসু প্রায় বিরস বদনে ফিরছেন। বশিষ্ঠ ঋষির অভিশাপে তাঁদের মর্তে জন্মাতে হবে।

গল্পের বাকি অংশ সকলের জানা। রাজা প্রতীপ ধ্যান করছিলেন, গঙ্গা গিয়ে তাঁর ডান উরুতে বসলেন। প্রতীপ বললেন, ডান উরু পুত্রবধূর জন্য। ফলে তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব। অতঃপর শান্তনুর সঙ্গে গঙ্গার বিয়ে। এক-একটা পুত্র জন্মায়, আর মা জলে ফেলে আসেন। এই রকম উদ্ভিন্নযৌবনা নারী, যিনি নিজেই বুড়ো রাজার উরুতে বসেন, একের পর এক সন্তানকে জলে ফেলে দেন, তাঁকে মা বলে ভাবতে যাব কোন দুঃখে? মহাদেবের জটা থেকে মর্তে নেমেও গঙ্গার ছলকানি স্বভাব বদলায়নি। ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত তাঁর প্রেমে পড়লেন। গঙ্গা বললেন, এই তো, দুটো তরঙ্গের আঘাত সামলাও। আমি এখনই আসব। হাবুডুবু খেতে খেতে ঐরাবত কোনও ক্রমে বাঁচলেন।

এ সবের পাশে কর্দম ঋষির গল্পটা একরৈখিক, মজা নেই। স্ত্রী দেবহুতিকে কর্দম দিব্য বিমান দিলেন, দিব্য আবরণ ও আভরণ। অতঃপর সম্ভোগ। প্রথমে নয়টি মেয়ে, তার পর কপিলের জন্ম। বাবা তাঁকে স্বয়ং বিষ্ণুরূপে আরাধনা করলেন। ঠমকছমক নেই, শুধু বিষ্ণুভক্তি। অথচ মহাকাব্যিক উপাখ্যানের পরতে পরতে অন্য স্রোত। ভগীরথ কেন গঙ্গাকে মর্তে আনতে পারলেন? বাবার বীর্যে তাঁর জন্ম নয়, তাই পিতৃপুরুষের পাপ অর্শায়নি। কৃত্তিবাসের ভাষায়, “ভগে ভগে জন্ম, ভগীরথ নাম।”

গঙ্গার কাহিনি এ রকমই। কখনও প্রবলযৌবনা, কখনও বিকল্প যৌনতার বয়ান। স্রোতধারার কি একটাই গল্প? সাগরে মিললেও গঙ্গার কাহিনি শেষ হয় না। মর্তধামের গঙ্গা নদীটাই স্বর্গে মন্দাকিনী, পাতালে ভোগবতী। শঙ্করাচার্যও এই নদী সম্বন্ধে লেখেন ত্রিভুবনতারিণী তরলতরঙ্গে। জাহ্নবী কি শুধু শিবের জটায় থাকেন? তিনি দ্রবীভূত বিষ্ণুশরীর, বিষ্ণুস্রোতস্বরূপিণী। মিথিলার বাচস্পতি মিশ্রের মতে, কলিযুগে গঙ্গার মাহাত্ম্য পুষ্কর বা কুরুক্ষেত্র তীর্থকেও ছাপিয়ে যায়।

যে নদী নিজেই তীর্থ, তাকে পাওয়ার জন্য সাগরসঙ্গমে হেথা হোথা ছোটার দরকার কী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement