এক গলতিয়া হ্যায়, কিসিকে ভি, মাং লেতি হ্যায়, মাফিইয়া দো”: তরুণীর কাতর কণ্ঠস্বর, আকুতিতে আর্দ্র। সাম্প্রতিক পাকিস্তানি ফিল্ম খেল খেল মে-এর শেষ লাইন এটি। কিন্তু এই বিধুরতা আসলে ব্রেখটীয়— নাটক কিন্তু নাটক নয়। গপ্পোটা এই রকম: পাকিস্তানে এক কলেজের ছাত্রছাত্রীর থিয়েটারের দল ঠিক করেছে, এ বার তারা যে নাটক মঞ্চস্থ করবে তা হবে পাঁচ দশক আগে ঢাকা শহরের পতনের উপর। অর্থাৎ, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ঘটনাটি ঘটল কী করে? দায়ী কে? এ সব প্রত্যক্ষত বুঝতে দলটি হাজির হল বাংলাদেশে। ছবিটির রাজনৈতিক বক্তব্য: অতীতকে ভুলে যাও। নব সংসার পাতি গে আবার, চলো।
যুদ্ধবিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহীরা বুঝবেন, এটি এক মনোবৈজ্ঞানিক যুদ্ধের প্রস্তুতি। দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের আখ্যান মোটামুটি সর্বজনস্বীকৃত। প্রসঙ্গত বলি, আখ্যান বা ‘ন্যারেটিভ’ বিষয়টি কিন্তু সব সময়েই জরুরি— আমরা সাধারণত যতটা ভাবি, তার থেকে অনেকটাই েবশি। শুধু খেল খেল মে ছবিই নয়, আরও অনেক উপায়ে পাকিস্তান চেষ্টা করছে বাংলাদেশ জন্মের ন্যারেটিভ পরিবর্তন করতে। প্রচলিত ন্যারেটিভ-টি কী, সেটা আগে মনে করে নিই। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মোটামুটি অহিংস গণ-আন্দোলন গড়ে উঠেছিল পাকিস্তানি সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে, কারণ মুজিবের আওয়ামী লীগ ১৯৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তান সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।
এর পরই পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু করে দেয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’। আওয়ামী-সমর্থক নির্বিশেষে সন্দেহভাজনদের বাড়ি বাড়ি চড়াও হয়ে পুরুষদের গণহত্যা এবং নারীদের ধর্ষণ ও হত্যা। মুজিবকে গ্রেফতার করে সেনারা নিয়ে যায় পাকিস্তান। ও দিকে পূর্ব পাকিস্তানে এই হত্যালীলা চলতে থাকে নয় মাস। সেই সঙ্গে শুরু হয় এক ঐতিহাসিক সশস্ত্র প্রতিরোধ, যা মুক্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত। এ দিকে কোটিরও অধিক নিরাশ্রয় ও বিপন্ন মানুষ তখন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে শরণার্থী। তাই পাকিস্তানের এই অভ্যন্তরীণ গন্ডগোলে ভারতের জড়িয়ে পড়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে চোদ্দো দিনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আরম্ভ হল, যার পরিণতি ৯৩০০০ সেনা সমেত ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে পাক সেনা প্রধান এ এ কে নিয়াজ়ির আত্মসমর্পণ। এর পর মুজিবের মুক্তি, এবং ১৯৭২ সালে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বে বাংলাদেশ সরকার গঠন।
দেশেবিদেশে বাংলাদেশের ‘মুক্তিযুদ্ধ’ সম্পর্কে এত দিন যত লেখাপত্র হয়েছে, সেখানে এই আখ্যানের মূল কাঠামোর খুব একটা নড়চড় হয়নি। তিন দেশের জাতীয়তাবাদী স্মৃতিচারণের কথা নিশ্চয়ই আলাদা। পাকিস্তানের ইতিহাসে থাকবেই যথেষ্ট আত্মপক্ষ সমর্থন। বাংলাদেশি ইতিহাস হবে চড়া রঙের বীরত্বগাথা। এবং ভারতীয় বর্ণনাতে পাকিস্তান তো সব সময়ই খলনায়ক, শোলে-র গব্বর সিংহের মতো।
ইতিমধ্যে একাধিক ভারত-বিরোধী রাষ্ট্রনায়ক এসেছেন ঢাকায়। শেখ মুজিবকে যখন বাংলাদশ সেনাবাহিনীর এক দল ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট হত্যা করে, তার সুযোগ গ্রহণ করেন ভারতবিরোধীরা। অবশ্য বেশি দিন তাঁরা টিকতে পারেননি ক্ষমতায়। ২০০৯ সালে মুজিবের কন্যা দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর (প্রথম বার ১৯৯৬ থেকে ২০০১) তিনি শক্ত হাতে সংযত করেছেন সমাজের একটি প্রতিবাদী অংশকে, যারা শুধু শেখ মুজিবের হত্যা ষড়যন্ত্রতেই জড়িত ছিল না, অনেকেই সার্বভৌম বাংলাদেশেরও বিরোধী ছিল। যেমন জামাত-এ ইসলামি প্রধান মতিউর রহমান ইসলামি। ২০১৬ সালে শেখ হাসিনা গঠিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের আদেশে তার ফাঁসির প্রতিবাদে সরব হয়েছিল পাকিস্তান, এমনকি তুরস্কও। কিন্তু এত সব সত্ত্বেও কোনও ভাবেই এ দিক-ও দিক হয়নি সেই প্রতিষ্ঠিত ন্যারেটিভটির, যেখানে বলা হত পশ্চিম পাকিস্তানের পঞ্জাবিরা তাদের পূর্ব প্রদেশের বাঙালি মুসলমানদের প্রতি জাতিঘৃণা পোষণ করত, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানের সঙ্গে তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা ভাগ করতে প্রস্তুত ছিল না, ইত্যাদি।
ন্যারেটিভ বদলানোর চেষ্টাটা পাকিস্তানে টের পাওয়া যাচ্ছে িকছু কাল হল। গত জুলাই মাসে পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ফোনে কথা বলেন বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। হাসিনাকে তিনি পাকিস্তানে নিমন্ত্রণ জানালেন, যদিও এখনও কোনও সাড়া পাননি। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পাকিস্তানের এক গোপন বাসনা— কোনও না কোনও ভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করা, যাতে তাদের মূল শত্রু ভারতকে যথেষ্ট চিন্তায় ফেলা যায়। শেখ হাসিনার আগে খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানের ফাইটার জেটের একটি স্কোয়াড্রন পার্ক করার লক্ষ্যে কথাবার্তা শুরু হয়েছিল। পরবর্তী কালে, সরকার বদল হলে সেই প্রস্তাব ভেস্তে যায়।
তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, পাকিস্তান তার ‘ঢাকা প্রজেক্ট’ থেকে কোনও ভাবে সরে এসেছে। প্রজেক্ট-এর মূল উদ্দেশ্য— ১৯৭১ সালের পুরনো ন্যারেটিভটিকে পাল্টানো। কেন নির্বাচনে জেতা সত্ত্বেও মুজিবকে পাকিস্তান সরকার গড়তে দেয়নি সে দিন? তার কারণ— এখন এই ভাবেই বোঝানো হচ্ছে— দুই পক্ষে পারস্পরিক আলোচনার অভাব। অন্য কোনও জাতিবৈর বা শত্রুতা নয়। বোঝানো হচ্ছে যে, পুরো মুক্তিযুদ্ধটাই আসলে ভারতীয় সেনা ও গোয়েন্দা বাহিনীর সৃষ্ট। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রাক্তন অফিসার সুলতান হালি, যাঁর পিতা ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন, সম্প্রতি লিখেছেন টরমেন্টেড ট্রুথ: ১৯৭১ অ্যান্ড বিয়ন্ড নামে একটি বই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের এই বিনির্মিত ইতিহাস অনুযায়ী— ২৬ মার্চ কোনও উল্লেখযোগ্য নরহত্যার ঘটনাই ঘটেনি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বর্তমানে ১৯৭১ ঘটনাবলির যে মনগড়া বিবরণ তৈরি হচ্ছে পাকিস্তানে, তার রসদের এক বড় সূত্র দশ বছর আগে প্রকাশিত একটি বই ডেড রেকনিং, লেখিকা শর্মিলা বসু। এই সম্পূর্ণ একপেশে ইন্টারভিউ-ভিত্তিক বিবরণের মধ্যে দু’টি উপাদান আছে, যা বিশেষ ভাবে আগ্রহী করেছে ইসলামাবাদকে। প্রথমত, সন্দেহ করা হয়েছে ১৯৭১ গণহত্যার অভিযোগকে। বলা হয়েছে, পরবর্তী কালে নিহতের সংখ্যা নাকি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বইটির আর একটি বক্তব্য, পাক সেনা ও রাজাকার বাহিনী নাকি সংখ্যালঘুদেরই বেশি খুন করেছে। অর্থাৎ ঠারেঠোরে বোঝানো হয়েছে যে, ১৯৭১-এ পাক সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানের ‘এথনিক ক্লেন্সিং’ চেয়েছিল, বাঙালি মুসলমানের প্রতি পাকিস্তানিদের জাতিবিদ্বেষের গল্পটা নাকি স্রেফ বানানো।
স্বভাবতই, ওই বক্তব্য লুফে নিয়েছে পাক বিদেশনীতির প্রচারকেরা। নানা সূত্র মারফত বাংলাদেশ যখন ইসলামাবাদকে বলছে, ক্ষমা চাইতে হবে, পাকিস্তানের কট্টর ইসলামপন্থীরা তাতে বাদ সাধছে। পরিস্থিতি যে রকম, তাতে মধ্যস্থের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেই পারে পাকিস্তানের ‘স্থানীয় অভিভাবক’ চিন। প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে, কেবল পাকিস্তানে নয়, চিনের সাহায্যের হাত এখন বাংলাদেশেরও অনেক গভীরে প্রসারিত— সামরিক ক্ষেত্রে তো বটেই।
দেখেশুনে মনে হয়, পাকিস্তানকে নতুন করে ‘বাংলাদেশ ন্যারেটিভ’ পরিবর্তনে উদ্দীপ্ত করার পিছনে একটা বড় কারণ, দিল্লিতে বিজেপি সরকারের সাম্প্রতিক এক ভুল সিদ্ধান্ত। ২০১৯ সালে নির্বাচনের পূর্বাহ্ণে তাঁরা এই বিশ্বাসে ভর করেছিলেন যে, সীমান্ত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় বিভাজন তীব্র। তার ফয়দা তুলতে তাঁরা এনেছিলেন নাগরিক-পঞ্জির প্রস্তাব, সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে পাশ করিয়েছিলেন নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তথাকথিত বাংলাদেশি ‘অনুপ্রবেশকারী’-দের অপমান করেছিলেন। বলেছিলেন, তাঁদের যথাসত্বর বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলার ব্যবস্থা হচ্ছে।
অধুনা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দুলতে থাকে নিস্পৃহতা ও বিরাগের মধ্যে। সাম্প্রতিক এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে সেই কাঁটা এখন পৌঁছেছে এমন প্রান্তে যে, প্রতিবাদের চোটে প্রধানমন্ত্রী মোদীর পক্ষে ঢাকা যাওয়াই আজ অসম্ভব। স্বাধীনতার পর থেকে যে দ্বিজাতিতত্ত্বকে খণ্ডন করে এসেছে ভারত, সেই প্রয়াসেই এখন জল ঢালছে শাসক বিজেপি।
ফল? ভারতের বিদেশনীতি এখন গভীর সঙ্কটে।