ছিন্নমূল: শিয়ালদহে বাংলাদেশি শরণার্থীরা। সেপ্টেম্বর, ১৯৯২
উদ্বাস্তু কথাটা পশ্চিমবঙ্গে খুব পরিচিত শব্দ। উদ্বাস্তু, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান থেকে একতরফা চলে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে, শিল্প সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে স্বাধীনতা পরবর্তী দু’টি দশক জুড়ে খুবই দৃশ্যমান ছিলেন। মনে করা হয়, বাম রাজনীতির পশ্চিমবঙ্গ জয় এই উদ্বাস্তু রাজনীতির হাত ধরেই। আজকের পশ্চিমবঙ্গেও উদ্বাস্তু বলতে সেই ছবিটাই বার বার দেখানো হয়, উঠে আসে কলকাতার আশপাশের কলোনিগুলির নাম, শোনা যায় উদ্বাস্তুদের পাট্টা দেওয়ার ঘোষণা। এঁরা পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু, ১৯৭১-এর আগে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন।
১৯৭২ সালে জন্ম নিল বাংলাদেশ। পূর্ব পাকিস্তান অতীত। তার পর কি উদ্বাস্তু কথাটাই অতীত হয়ে গেল? সত্যটা তাই, এর পর সরকারি ভাবে বাংলাদেশ থেকে আর কোনও উদ্বাস্তু ভারতে বা পশ্চিমবঙ্গে আসেননি, কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের ১৯৭২-পরবর্তী উদ্বাস্তুদের জন্য কোনও সাহায্যের প্রকল্প নেই। আমাদের শিল্প সাহিত্য সিনেমায় বাংলাদেশের উদ্বাস্তুরা নেই। অথচ, বাংলাদেশের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বরকত বিস্তৃত গবেষণা করে জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশ থেকে ১ কোটির বেশি হিন্দু ভারতে চলে গিয়েছেন। বাংলাদেশের বিখ্যাত মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব ও লেখক শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিনের (২০০১-২০০৫) শ্বেতপত্র জানিয়ে দেয়, কেন বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু আসার স্রোত থামছে না। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ পশ্চিমবঙ্গে, ভারতে দিন কাটাচ্ছেন আতঙ্কে মিথ্যা পরিচয় নিয়ে। ফলে এঁরা আগেকার উদ্বাস্তুদের মতো কোনও সাহায্য পাওয়ার যোগ্যই বিবেচিত হননি। এত বড় মানবাধিকারের সমস্যা নিয়ে গত চল্লিশ বছরে কোনও সম্পাদকীয় লেখা হয়নি, টিভিতে আলোচনা হয়নি, পেশাদার মানবাধিকার হইচইওয়ালারা কথাটি বলেননি। সেই অদৃশ্য মানুষদের পাদপ্রদীপের সামনে তুলে এনেছে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, ২০১৯। এই আইনে বলা হল ২০১৪-র ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় অত্যাচারে বা তার ভয়ে ভারতে চলে আসা উদ্বাস্তুরা সবাই ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন।
পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুরা কি আগেও ভারতের নাগরিক হতে পারতেন? হ্যাঁ, পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুরা সব সময়েই নাগরিক হওয়ার অধিকারী। এর ব্যবস্থা হয়েছে প্রথমে আমাদের সংবিধানে। সেখানে ৬ নং ধারায় বলা আছে যে, যাঁরা অবিভক্ত ভারত থেকে বর্তমান ভারতে ১৯ জুলাই ১৯৪৮-এর মধ্যে এসেছেন, তাঁরা ভারতের নাগরিক। আর যাঁরা তার পর এসেছেন, তাঁদের নাগরিক হিসেবে নাম নথিবদ্ধ করাতে হবে। আর সংবিধানের ১১ নং ধারায় নাগরিকত্ব নিয়ে আইন তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হল সংসদকে। সংসদে অনুমোদিত হল নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫। এই আইনেও উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য বলে ঘোষণা করা হল। এর ৫ নং ধারায় বলা হল, যে ব্যক্তির মা বা বাবা অবিভক্ত ভারতে জন্মেছিলেন, যাকে বলা হয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি, তিনি উপযুক্ত ফর্মে আবেদন করে নাম নিবদ্ধীকরণ করলে ভারতীয় নাগরিক বলে গণ্য হবেন। এক কথায় পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাঁরা উদ্বাস্তু হয়ে এসেছিলেন, তাঁদের নাগরিকত্বের কোনও সাধারণ সমস্যা নেই। ফলে ১৯৭১-এর আগে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের আন্দোলনে নাগরিকত্বের কোনও দাবি ছিল না। ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁদের ভারতের নাগরিক বলেই স্বীকার করেছিল এবং সেই জন্য তাঁদের পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক সাহায্যের যথেষ্ট না হলেও কিছু ব্যবস্থা করেছিল।
পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় পর্বের উদ্বাস্তুরা এসেছেন পাকিস্তান থেকে নয়, বাংলাদেশ থেকে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের সহোদর স্থানীয় রাজাকার আলবদররা যে হিন্দু নিপীড়ন ও হিন্দু গণহত্যা শুরু করে, তার ফলে প্রায় ১ কোটি উদ্বাস্তু ভারতে মূলত পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। এই পরিস্থিতিতে ভারত সরকার সব প্রদেশের মুখ্যসচিবকে ২৯ নভেম্বর ১৯৭১-এ একটি চিঠিতে জানায়, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পর পূর্ববঙ্গ থেকে আসা অধিবাসীদের নাগরিকত্ব আইনের ৫ নং ধারায় আবেদন গৃহীত হবে না। যুদ্ধশেষে এই উদ্বাস্তুরা প্রায় সকলেই ফেরত গেলেও এই আদেশ বহাল রইল। বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পর ৫ জুলাই ১৯৭৫-এ ভারত সরকার আর একটি চিঠিতে জানায় যে, ৯ মে ১৯৭৫-এ সংসদে গৃহীত নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে কোনও অভিবাসন সরকার গ্রাহ্য করবে না এবং এই বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়িত করবে। সুতরাং, গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে আসা লক্ষ লক্ষ হিন্দু উদ্বাস্তুর নাগরিক হওয়ার কোনও অধিকার ছিল না। নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, ২০১৯, তাঁদের সেই অধিকার দিল।
১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সংগঠনগুলি দীর্ঘ দিন ধরেই নাগরিকত্বের দাবি তুলে আসছে। মাঝে মাঝে বামপন্থীরাও এ সব কথা বলেছেন। ২৮ ডিসেম্বর কলকাতায় ২০১০-এ মতুয়া মহাসঙ্ঘের এক জনসভায় সিপিএমের গৌতম দেব গরম গরম ভাষণ দিয়েছিলেন এই নাগরিকত্বের দাবিতে। ছিলেন কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়া। তৃণমূল কংগ্রেস মতুয়া ভোটের জন্য এই দাবির সমর্থক সব সময়ই। সংসদে ২০১২-র এপ্রিলে সিপিএমের বাসুদেব আচারিয়া, প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় এই দাবির কথা বলেছেন। সিপিএম সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট ২২ মে ২০১২ সালে চিঠি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে ‘বাংলাদেশে নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের’ নাগরিকত্বের দাবির কথা বলেছেন, সিপিএমের ২০তম পার্টি কংগ্রেসে এ নিয়ে প্রস্তাব পাশ হয়েছে।
নাগরিকত্ব সংশোধন আইন ২০১৯ পাশ হওয়ার পর শুরু হল বিভিন্ন রকমের বিরোধিতা। এক, কেন মুসলমান অনুপ্রবেশকারীরাও নাগরিকত্ব পাবে না, তার জন্য কান্নাকাটি। বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু (৯০%) মুসলমানরা ধর্মীয় কারণে নির্যাতিত হয়ে দেশত্যাগ করছেন না, ফলে তাঁরা রাষ্ট্রপুঞ্জের সংজ্ঞা অনুযায়ী উদ্বাস্তু হতে পারেন না, এই সরল সত্যটি মৌলবাদের দীর্ঘ দিনের সহচর বামপন্থীরা এবং নতুন সহচর তৃণমূল কংগ্রেস মেনে নিতে পারে না।
দুই, এই নাগরিকত্ব পেতে গেলে অনেক কাগজপত্র দেখাতে হবে। এটিও অসত্য প্রচার। এই আইনে বলা আছে যে, পাসপোর্ট আইন ও বিদেশি আইনে যাঁদের ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫-র সংশোধনে ছাড় দেওয়া হয়েছে, তাঁরাই এই আইনে গণ্য হবেন। সেই সংশোধনে বলা আছে এই উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে তাঁদের কাগজপত্র না থাকলেও চলবে। ভয় দেখানো হচ্ছে যে, উদ্বাস্তুরা নিজেদের পরিচয় দিলে তাঁরা বিদেশি বলে গণ্য হবেন এবং তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত থেকে ডিটেনশন ক্যাম্পে চালান, সব কিছু ঘটতে পারে। এটিও মিথ্যা প্রচার, কারণ এই আইনে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, যাঁরা নাগরিকত্বের আবেদন করবেন তাঁদের বর্তমান সব অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকবে।
তিন, সরকারি পদ থেকে অনেকে বলে আসছেন, আপনারা সবাই নাগরিক কারণ আপনাদের বিভিন্ন কার্ড রয়েছে। নাগরিকত্ব প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর কথায় ঠিক হয় না, হয় নাগরিকত্ব আইনের বলে। এত সব কার্ড থাকা সত্ত্বেও অনেক উদ্বাস্তুকে গ্রেফতার করা হয়েছে, জেল খাটতে হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুরা গত চার দশক ধরে নাগরিকত্ব সার্টিফিকেটের জন্য লড়ে এসে আজ সাফল্য পেয়েছেন।
চার, বিরোধিতার শেষ অস্ত্র, রাস্তায় নেমে হিংসাত্মক অরাজকতা তৈরি করা। গত ১৩-১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে সেই প্রতিবাদ হয়েছে। আগামী দিনেও তা হওয়ার আশঙ্কা রয়েই গিয়েছে। কথা হল, বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের ভালমন্দ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাকি মানুষদের কী আসে যায়? ১৯৭৫-পরবর্তী
বাংলাদেশ থেকে হিন্দু উদ্বাস্তুর পাশাপাশি আরও অধিক সংখ্যায় বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশ করেছেন। ফলে শঙ্কিত ও আক্রান্ত বোধ করছেন পশ্চিমবঙ্গের সব ভারতীয় নাগরিক। নাগরিকত্ব সংশোধন আইন ২০১৯ বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের চিহ্নিত করবে, ফলে অনাগরিক অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা সহজ হবে। একমাত্র অনুপ্রবেশকারীমুক্ত পশ্চিমবঙ্গ হলেই পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব রক্ষা পাবে। নাগরিকত্ব সংশোধন আইন তাই একটি রক্ষাকবচ।