নৌবাহিনী গড়ে তুলতে বছরের পর বছর সময় লাগে। ফাইল ছবি।
গত দু’দশকে পুর্ব এশিয়ার নৌবলের উপর আধিপত্যের বদলকে সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ব্যাখ্যাটি এই রকম—এই ভূখণ্ডটিকে বেজিংয়ের হাতে নৈবেদ্য হিসেবে তুলে দেওয়া হয়েছে। ২০০০ সালে চিনের সঙ্গে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ব্যয়ের অনুপাত ছিল ১:১১। ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর দেওয়া হিসেব মোতাবেক গত বছর সেই অনুপাতটি দাঁড়িয়েছে ১:৩। চিনের প্রতিরক্ষা বাবদ ব্যয় ছয় গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তুলনায় জাপান যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আর তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বেড়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। চিনের সঙ্গে নয়, বরং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দক্ষিণ কোরিয়া গত দু’দশকের রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে এসে তার প্রতিরক্ষা ব্যয় দ্বিগুণ করেছে। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার ব্যয় দ্বিগুণের কম। দক্ষিণ চিন সমুদ্রের দ্বীপগুলির উপরে প্রভুত্ব বিস্তার নিয়ে যে সব ক্ষুদ্রতর দেশের সঙ্গে চিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে, তাদের সম্মিলিত প্রতিরক্ষা ব্যয় বেড়েছে তিন গুণ। কিন্তু এ সত্ত্বেও কেউ চিনের ধারেকাছে আসতে পারেনি। এর ফল যা দাঁড়িয়েছে তা হল এই— সব ক’টি দেশের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়কে একত্র করেও দেখা গিয়েছে তা শুধুমাত্র গত বছরে চিনের ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশ। কিন্তু ২০০০ সালে জাপানের ব্যয় ছিল চিনের থেকে বেশি।
নৌবাহিনী গড়ে তুলতে বছরের পর বছর সময় লাগে। তার নৌবহরের মানোন্নয়নে চিন প্রাথমিক ভাবে ৩০ বছর সময় নিয়েছিল। তার পরে সে বিস্তার শুরু করে। সেই সময় বাকি দেশগুলি নিছক দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। এ থেকে এখনও বহু কিছু শেখার রয়েছে। ইতিমধ্যে, যে সব ইওরোপীয় দেশ ভারত মহাসাগর-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের স্বার্থ জড়িত রয়েছে বলে জানায়, তারা গত ২০ বছরে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় ২০ শতাংশেরও কম বৃদ্ধি করেছে। এশিয়া এবং ইউরোপের এই সমস্ত দেশ আমেরিকার রক্ষাকবচের নীচে আশ্রয় খুঁজেছে। কিন্তু আমেরিকা তার বাহিনী পাঠাতে গররাজি হলে এই নির্ভরশীলতা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। তাইওয়ানকে রক্ষা করার সময়েই এমন ঘটনা ঘটেছিল।
অন্য দেশের তুলনায় ভারত প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে। কিন্তু এ দেশের অগ্রবর্তী জাহাজ (ফ্রন্টলাইন শিপ) এবং ডুবোজাহাজের মান খুব সামান্যই বদলেছে।
পাশাপাশি, এ-ও মনে রাখতে হবে যে, চিনের তুলনায় আমেরিকার অগ্রবর্তী যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা (ফ্রন্টলাইন শিপ। অনধিক ৩০০) চিনের থেকে কম। কিন্তু জাহাজের সামগ্রিক হিসেবে আমেরিকা এখনও এগিয়ে। ওদিকে চিনও বসে নেই। তারা আমেরিকার চাইতে দ্বিগুণ গতিতে যুদ্ধজাহাজের বরাত দিচ্ছে। এবং যেখানে বেজিং তার সামগ্রিক নৌশক্তিকে আঞ্চলিক জলরাশি এবং বৃহত্তর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে মোতায়েন রেখেছে, ওয়াশিংটন সেখানে তার সামগ্রিক নৌবহরের মাত্র একটি অংশকে ওই অঞ্চলে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, বাইডেনের হোয়াইট হাউসে বসে থাকা নীতি-নির্ধারকরা এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের ব্যাপারে হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। বদলে তাঁরা যা চাইছেন— কোনও মতে ওই অঞ্চলে চিনকে ঠেকিয়ে রাখতে হবে। এই উদ্দেশ্য যে আগামী দিনগুলিতে আমেরিকার মিত্র দেশগুলির সহায়তা ছাড়া সফল হবে, এমন নিশ্চয়তাও নেই। পরবর্তীকালে সুযোগ বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্ভাবনাও কম। চিনের আধিপত্য দিন দিন বেড়েই চলবে।
এই পরিস্থিতেই চলতি সপ্তাহে আমেরিকা ঘোষণা করেছে, তারা অস্ট্রেলীয় নৌবাহিনীকে পরমাণু শক্তিচালিত (পারমাণবিক অস্ত্র সমেত নয়) আক্রমণাত্মক ডুবোজাহাজ কিনতে সাহায্য করবে। পরমাণু শক্তি চালিত নয়, এমন ডুবোজাহাজের তুলনায় এগুলি অধিকতর দূর দরিয়ায় পাড়ি দিতে সমর্থ এবং সেখান থেকে হল্লা করা ছাড়া এদের দিয়ে কোনও কাজ হবে না। বরং এই কাজ খানিক শান্ত ভাবে, বেশি গোপনীয়তার সঙ্গে করলে ফল ভাল হত। প্রতিরক্ষার বিষয়টি অনেক বেশি টেকসই হত। এ ভাবে দুই দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পর পাশার দান কি উলটে দেওয়া যায়! এখন প্রশ্ন হল, জাপান কি এর পরে কোনও পদক্ষেপ করবে? এই দেশটি এখনও পর্যন্ত তার মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) এক শতাংশেরও কম প্রতিরক্ষায় ব্যয়ের সিদ্ধান্তে অটল। যদি ‘কোয়াড’ বা চতুঃশক্তি নিরাপত্তা সংলাপকে বৃহত্তর কোনও অর্থে প্রয়োগ করতে হয়, তা হলে জাপানের তরফে প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বাড়াতে হবে।
নৌবহরের মানোন্নয়নে চিন প্রাথমিক ভাবে ৩০ বছর সময় নিয়েছিল। তার পরে সে বিস্তার শুরু করে।
অন্য দেশের তুলনায় ভারত প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে। কিন্তু এ দেশের অগ্রবর্তী জাহাজ (ফ্রন্টলাইন শিপ) এবং ডুবোজাহাজের মান খুব সামান্যই বদলেছে। যদিও সার্বিক সামর্থ্যের উন্নতি বিপুল। অবশ্য জাহাজের সংখ্যাবৃদ্ধির সম্ভাবনা আগামী দশকে তেমন উজ্জ্বল নয়। তবু পুরনো জাহাজ ও ডুবোজাহাজ সরিয়ে তাদের জায়গায় নতুন জলযান আনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীর জলতলে ভাসমান জাহাজগুলির কাছে মূর্তিমান বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে চিনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলি। বিপরীতে ভারত ‘নির্ভয়’-এর মতো মাঝারি পাল্লার এবং শব্দের থেকে অপেক্ষাকৃত কম দ্রুতগামী জলক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের চেষ্টায় রত। ভারতের একমাত্র পরমাণু শক্তিচালিত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রবাহী ডুবোজাহাজটিতেও কে-৪-এর মতো মধ্যমপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত নয়। এমতাবস্থায় জলরাশিতে দাপট দেখানোর মতো কোনও অবস্থাতেই ভারত নেই। এই ধরনের প্রযুক্তিগত পশ্চাদপদতা এবং তুলনামূলক ভাবে নৌ সমরসজ্জায় পিছিয়ে থাকা কিন্তু ভারত মহাসাগরের আধিপত্যের রাজনীতিতেও ক্ষমতার সমীকরণের বদলের দিকেই ইঙ্গিত করে।
এমন অবস্থায় কোন পন্থা অবলম্বন জরুরি বলা দুরূহ। চিনের দ্রুতগতির নৌবাহিনীর সম্প্রসারণের সামনে প্রতিস্পর্ধা গড়ে তুলতে গেলে অন্য পক্ষকে দ্রুততর হতে হবে এবং / অথবা আমেরিকার সঙ্গে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হতে হবে। ঠিক যে ভাবে অস্ট্রেলিয়া তার নীতি ঘোষণা করেছে, তাকে অনুসরণ করতে হবে। সাধারণ ভাবে, তার কৌশলগত স্বাধীনতার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে বসে থাকলে ভারত কখনওই পশ্চিমী নৌশক্তির অংশীদার হয়ে উঠতে পারবে না। বরং সেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় দশার সুযোগ নিয়ে চিন আরও উন্নত, আরও শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তুলবে। পরিবর্ত রাস্তা হিসেবে কিছুই খোলা থাকবে না।