বেঙ্গালুরু গিয়ে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছি। বাড়িতে তিন জন ‘কাজের মাসি’, ঘর মোছা-বাসন মাজা, রান্না, আর কাপড় কাচা ঝাড়পোঁছের। এখানে রান্নার লোক ‘কুক’, বাকিরা ‘মেড’। এর বাইরে তাঁদের কোনও নাম নেই, ডাকও। একই রকম যদি আমাদের কাজের জায়গায় হত? “ওহে কেরানি, লেটারটা তাড়াতাড়ি টাইপ করে দিন,” বা, “অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ব্যালান্স শিটের একটা কপি দিয়ো”? শুনতে বেশ খারাপ, তার থেকেও ঢের খারাপ হবে তলে তলে, যা দেখা যাবে না, কিন্তু তার অন্ধকার ধরা পড়বে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে।
একটা সময় ছিল যখন মানুষের কাজের ভিত্তিতে তার বংশনাম বা পদবি স্থির হত। কর্মকার, মহাজন, ঘটক, পুরোহিত থেকে কারপেন্টার, কুক, ফিশার, হান্টার, টেলর, উদাহরণ ভূরি ভূরি। হয়তো সে পথেই আজকের ‘কুক-মেড’দের উৎপত্তি। মুশকিল হল, এর উল্টো পথে, মানুষের নামের ভিত্তিতে তার কাজের পরিধি সীমিত হয়ে গেলে বিপদ। ‘নমিনেটিভ ডিটারমিনিজ়ম’ তত্ত্ব বলছে, ব্যক্তির নামের সঙ্গে অনেক সময়ই তার কাজ বা পেশা নির্বাচনের বিশেষ সাদৃশ্য দেখা যায়। শুনতে অদ্ভুত হলেও, এই নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চলছে। ধরা যাক ফ্রয়েড-এর কথা। ‘ফ্রয়েড’ অর্থ আনন্দ, নমিনেটিভ ডিটারমিনিজ়ম তত্ত্বের উল্লেখযোগ্য প্রবক্তা কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং ফ্রয়েড সম্পর্কে বলছেন, মানবমনের সুখানুভব তৃপ্তি ও কামনা নিয়ে ফ্রয়েডের যে কাজ, তার পিছনে তার ‘ফ্রয়েড’ নামের ভূমিকা অপরিসীম। বিজ্ঞানীরা ‘স্যাম্পল সাইজ়’ নিয়ে গবেষণা করে বলছেন, ‘ফিশার’ পদবিধারী ব্যক্তির জেলে, বা ‘গ্রেস’ নামের মেয়েদের মধ্যে ভবিষ্যতে চার্চের সেবিকা হয়ে ওঠার বিশেষ সম্ভাবনা; এমনকি ‘ব্রেনম্যান’ পদবিধারীর মধ্যে নিউরোসার্জারি নিয়ে পড়াশোনায় বিশেষ আগ্রহ দেখা যায়।
মুশকিল হল, এই তত্ত্বানুসারে গৃহসহায়িকাদের শুধু কুক, মেড বা ‘কাজের লোক’ নামে ডাকলে, সেই নামের সঙ্গে একাত্মতা এক দিকে যেমন তাঁদের কাজের ক্ষেত্রকে সীমিত করতে পারে, অন্য দিকে তাঁদের অন্য পেশায় যুক্ত হওয়ার ইচ্ছাও সমূলে নাশ করতে পারে। সামাজিক পরিকাঠামো ও প্রচলিত ব্যবস্থা যদি ব্যক্তির পেশা নির্বাচনকে তার ইচ্ছা ও পছন্দভিত্তিক না করে, ব্যক্তিকে পেশার সঙ্গে এমন ভাবে আত্মস্থ করায় যে তার ধারাবাহিকতা হয়ে ওঠে বংশানুক্রমিক, তবে সেই শ্রেণির পেশায় শ্রমের জোগান সতত বর্তমান থাকে; অর্থনীতির সূত্র মেনেই তা সহজলভ্য ও সস্তা হয়ে পড়ে। আমাদের ‘কাজের মাসি’দের অবস্থাও তা-ই। এই শ্রমশ্রেণির বেতন তাই অন্যান্য পেশার মতো সময়ের সঙ্গে বাড়ে না। ধারাবাহিক শ্রমের জোগান কাজের বাজারে তাঁদের দর-কষাকষির সুযোগ দেয় না, উপরন্তু শ্রম জোগানের ধারাবাহিক নিশ্চয়তা যখন-তখন চাকরি ছাঁটাইকে প্রতিষ্ঠা দেয়। এর প্রমাণ কোভিডকাল, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য বলছে, কোভিড সংক্রমণের প্রথম পাঁচ মাসে বিশ্বের প্রায় চুয়াত্তর শতাংশ গৃহসহায়িকা কাজ হারান।
প্রতি বছর দুর্গাপুজো বা দেওয়ালির ঠিক আগেই বিপুল সংখ্যক গৃহকর্মী ছাঁটাই হন, পুজোর বোনাস ফাঁকি দেওয়ার জন্যই, সবাই জানলেও তার পরিসংখ্যান রাখা হয় না। সেই তথ্য জোগাড়ও সহজ নয়, কাজ হারানোর ভয়ে গৃহসহায়তা-কাজের সঙ্গে যুক্ত এক বড় শতাংশই এই ব্যাপারে সরব হন না।
বেঙ্গালুরুতে পুজোর দিন পাঁচেক আগে বন্ধুর বাড়ির কর্মীরা প্যাম্ফলেট নিয়ে হাজির, তাতে ছাপার হরফে পুজোর বোনাসের, আর তাঁদের ‘মেড’ বা ‘কুক’ নামে না ডেকে নাম ধরে ডাকার দাবি। ভাষার পেলবতার জন্য দাবি না বলে আবেদন বলাই সঙ্গত। দেখা গেল, ওঁদের মধ্যে কাজ হারানোর ভয় এত প্রবল যে প্যাম্ফলেটটি গৃহকর্ত্রীর দৃষ্টিগোচর করাটুকুই তাঁদের উদ্দেশ্য। তার পর যেচে জিজ্ঞেস না করলে, সে বিষয়ে তাঁরা কোনও কথা বলছেন না। এক জনের সঙ্গে খানিক আলাপে বুঝলাম, এঁরা প্রত্যেকেই ‘স্ত্রী জাগ্রুতি সমিতি’ নামের এক সংগঠনের সদস্য, সেটি গৃহসহায়িকাদের কল্যাণে ব্রতী। এই দাবি পেশ আসলে সংগঠনের কর্মকাণ্ড, এমনটা তারা গত চার-পাঁচ বছর করছে। গত বছর বোনাসের দাবিতে সংগঠনের পাঁচ হাজার সদস্যের সকলেই মাথায় কালো ফিতে বেঁধে কাজের বাড়ি গিয়েছিলেন।
এতে লাভ হয়? এখনও অবধি কিছু হয়নি। “কভি পুরানা কাপড়া তো কভি সাত দিন কা পুরানা মিঠাই মিলতা হ্যায় বকশিশ কে নাম পর।” অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রায় আট কোটি ‘কাজের লোক’-এর দেশ ভারত, তাঁদের জন্য বোনাসের বদলে বকশিশ। ‘বোনাস’ শব্দে কোথাও অধিকারের গন্ধ মিশে থাকে, আর ‘বকশিশ’-এ মহানুভবতার। তাই তা দিলেও হয়, না দিলেও ক্ষতি নেই। তথ্য বলছে, গৃহসহায়তার সঙ্গে যুক্ত এ দেশের সাকুল্যে মাত্র এক শতাংশ মহিলা দুর্গাপুজো, দেওয়ালি বা অন্য উৎসবের সময় পুজোর বোনাস বা নতুন জামাকাপড় পান। বছরভর সংসার গুছিয়ে দিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে পুজোয় অন্তত একটি নতুন জামা দেওয়া যায় না? উত্তর পেতে অবশ্য ‘মেড’ আর ‘কুক’-এর বাইরে ওঁদের খানিক মানুষ বলেও ভাবতে হবে বইকি।