অর্থমন্ত্রী কার কথা ভাবলেন
Budget 2022

বিপদ কেটে গিয়েছে, এই আত্মবিশ্বাস বিপজ্জনক হতে পারে

মূল্যস্ফীতির অঙ্কটি হিসাব থেকে বাদ দিলে গত বছরের তুলনায় এ বছর স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ কমবে, এমন সম্ভাবনা প্রকট।

Advertisement

বিশ্বজিৎ ধর

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:০৯
Share:

আশাভঙ্গ: সংসদে বাজেট পেশ করছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। পিটিআই

অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের চতুর্থ বাজেট অন্তত একটি কারণে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে— ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও অর্থমন্ত্রী পরবর্তী পঁচিশ বছর ধরে অর্থব্যবস্থাকে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর থেকে একশো বছরের মধ্যবর্তী পঁচিশ বছরের তাঁরা নাম দিয়েছেন ‘অমৃত কাল’। প্রধানমন্ত্রী গতিশক্তি প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন বড় মাপের সংযোগ প্রকল্প ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী। কয়েকটি নদীর সংযুক্তিকরণ; স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং আর্থিক ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের বর্ধিত ব্যবহার— এমন কিছু ঘোষণাও তাঁর বাজেটে আছে। পরিকাঠামো প্রকল্পগুলি যদি দক্ষ ভাবে রূপায়ণ করা যায়, তা হলে দীর্ঘমেয়াদে সেগুলি লাভজনক হতে পারে। কিন্তু, বিশেষত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ডিজিটাইজ়েশনের উপর অতিরিক্ত জোর দিলে এই ক্ষেত্রগুলিতে বৈষম্য আরও বাড়বে।

Advertisement

অতিমারির দাপটে অর্থব্যবস্থা যখন ধুঁকছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ‘অমৃত কাল’ উপলক্ষে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবগুলিকে কী ভাবে দেখা বিধেয়? একটা কথা স্পষ্ট— অর্থমন্ত্রী যখন সুদূর ভবিষ্যতের লক্ষ্যে নীতি স্থির করছেন, তখন তিনি মনে করেন যে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা কোভিডের সঙ্কট থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে পেরেছে। অর্থমন্ত্রীর এ-হেন আত্মবিশ্বাস যদি সত্যিই থাকে, তা হলে তাঁকে দুঃসাহসী বলতে হবে। কোভিডের তৃতীয় প্রবাহের হাত থেকে এখনও ভারত সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি পায়নি। এখনও প্রচুর অনিশ্চয়তা রয়েছে। আশ্চর্যের কথা হল, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা সম্বন্ধে অর্থমন্ত্রীর আশাবাদের সঙ্গে সোমবার তাঁরই মন্ত্রক থেকে প্রকাশিত অর্থনৈতিক সমীক্ষা-র মতামতের বেশ অমিল রয়েছে। সমীক্ষায় লেখা হয়েছে যে, মানুষের ভোগব্যয়ের হার এখনও কোভিড-পূর্ব স্তরে, অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের স্তরে, ফিরতে পারেনি। ভারতীয় অর্থব্যবস্থার প্রধান চালিকাশক্তি হল মানুষের ভোগব্যয়— অন্য ভাষায় বললে, দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা। গত দু’বছর ধরে এই চাহিদা সম্পূর্ণ তলানিতে ঠেকেছে— কারণ, চাকরির বাজারে মন্দা; মানুষের আয়ও কমেছে। এটা বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয় যে, দেশের বাজারে চাহিদা না ফিরলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারের পক্ষে একটা মোটামুটি স্তরে পৌঁছে যাওয়াও কঠিন।

এ কথাও মনে রাখা জরুরি, যে ২০১৯-২০ অর্থবর্ষকে কোভিড-পূর্ব আর্থিক অবস্থার মাপকাঠি হিসাবে মানছে কেন্দ্রীয় সরকার, সেই সময় ভারতীয় অর্থনীতিতে বৃদ্ধির হার দ্রুত কমছিল। ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্স অফিসের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে দেশের জিডিপি-র বৃদ্ধির হার যেখানে ৬.৫ শতাংশ ছিল, সেখানে ২০১৯-২০ সালে সেই হার দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৩.৭ শতাংশে। অতএব, এখন যদি সরকার ২০১৯-২০ সালকেই ‘অর্থনীতির স্বাভাবিক অবস্থা’ হিসাবে বিবেচনা করে, তা হলে বুঝে নেওয়া সম্ভব যে, বছরে অন্তত ৭ শতাংশ হারে আয়বৃদ্ধির উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সরকার যমুনার কালো জলে বিসর্জন দিয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে পাঁচ লক্ষ কোটি ডলার আয়তনের অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্নও তার সহযাত্রী হয়েছে।

Advertisement

নির্মলা সীতারামনের বর্তমান বাজেটে উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব দৃষ্টিকটু রকম প্রকট। দেশের অভ্যন্তরীণ শ্রমের বাজারে মর্মান্তিক পরিস্থিতি, এবং দেশের তরুণ প্রজন্মের আশাভঙ্গের সুরাহা করার কোনও ইঙ্গিত এই বাজেটে নেই। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম তার গ্লোবাল রিস্কস রিপোর্ট ২০২২-এ উল্লেখ করেছে যে, তরুণ প্রজন্মের আশাহীনতা ভারতের জন্য অন্যতম বড় ঝুঁকি। তা ছাড়াও, অতিমারি-জনিত আর্থিক সঙ্কট দেশের অতিক্ষুদ্র শিল্পগুলিকে যে ভাবে কাবু করেছে, তার থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনও পথও নির্মলা দেখাননি। আগেও যেমন করতেন, এই বাজেটেও নির্মলা তেমনই অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পগুলিকে একত্রে বিবেচনা করেছেন— এমএসএমই ক্ষেত্র হিসাবে। কিন্তু, এত দিনে অর্থমন্ত্রীর জানা উচিত ছিল যে, অতিক্ষুদ্র শিল্প প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের নাগাল পায় না। কাজেই, ২০২০ সালে লকডাউনের পর থেকেই অতিক্ষুদ্র শিল্পের জন্য আলাদা ভাবে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ছিল। দেশের নীতিনির্ধারকরা এত দিনেও এই কাজটি করে উঠতে পারলেন না।

২০২২-২৩ অর্থবর্ষের বাজেটের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা সম্ভবত লাগতে চলেছে গরিব, খেটে-খাওয়া মানুষের গায়ে। অর্থব্যবস্থার বিপদ কেটে গিয়েছে, এমন এক অলীক প্রত্যয়ে অর্থমন্ত্রী দু’টি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের ব্যয়বরাদ্দ প্রভূত পরিমাণে ছেঁটে দিয়েছেন। প্রকল্প দু’টি যথাক্রমে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প (এমএনআরইজিএ), এবং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের অধীনে গণবণ্টন ব্যবস্থা। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে, অতিমারির আবহে, গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনার ব্যয়বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল এক লক্ষ এগারো হাজার কোটি টাকায়। তার পরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী সেই বরাদ্দ ছেঁটে নামিয়ে আনেন ৭২,০৩৪ কোটি টাকায়। পরে, ডিসেম্বর মাসে, আরও ২৫,০০০ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ করায় ২০২১-২২ অর্থবর্ষে প্রকল্পটির সংশোধিত বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৭,০৩৪ কোটি টাকায়। অর্থমন্ত্রী এই বাজেটে কর্মসংস্থান যোজনার জন্য ফের বরাদ্দ করেছেন ৭২,০৩৪ কোটি টাকা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, আর্থিক ভাবে প্রান্তিকতম মানুষদের জন্য প্রকল্পে এই সরকারের আগ্রহ নেই।

গণবণ্টন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ছবিটি আরও ভয়ঙ্কর। ২০২১-২২ অর্থবর্ষের বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ হয়েছিল ২,৪২,০০০ কোটি টাকা। সংশোধিত হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বরাদ্দের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৮৬,০০০ কোটি টাকায়। অর্থমন্ত্রী এই বাজেটে গণবণ্টন ব্যবস্থার জন্য বরাদ্দ করেছেন ২,০৬,০০০ কোটি টাকা। মানুষ যখন মূল্যবৃদ্ধির চোটে নাজেহাল, তখন গণবণ্টন ব্যবস্থায় কাটছাঁট তাঁদের আরও বিপন্ন করবে।

কৃষকদের এক বছর ব্যাপী আন্দোলন ভারতীয় কৃষির সমস্যার দিকে গোটা দেশের নজর ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কৃষক সংগঠনগুলির মতে, কৃষি আর কোনও অর্থেই লাভজনক পেশা নেই। কৃষকরা হয়তো আশা করেছিলেন, এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী তাঁদের কথা ভাববেন, তাঁদের সমস্যার কোনও সুস্থায়ী সমাধানসূত্র বার করবেন। এই বাজেট তাঁদের বিলক্ষণ হতাশ করবে। কৃষি এবং তৎসংক্রান্ত ক্ষেত্র, অর্থাৎ মাছ চাষ ও পশু প্রতিপালনে বরাদ্দ ২০২১-২২ অর্থবর্ষের বাজেট বরাদ্দের চেয়ে দুই শতাংশও বাড়ল না। আরও উদ্বেগের কথা, সংশোধিত হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত বাজেটে এই ক্ষেত্রের জন্য যতটুকু টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, প্রকৃত খরচ তার চেয়েও কম।

মাঝারি মেয়াদে কৃষি যাতে লাভজনক হয়ে উঠতে পারে, তার জন্য সত্যি চেষ্টা করলে এই সমস্যাজর্জরিত ক্ষেত্রটির বিলক্ষণ উপকার হত। কৃষিক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ করা জরুরি ছিল। কৃষকরা যাতে তাঁদের ফসলের জন্য ন্যায্য মূল্য পান, তা নিশ্চিত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কৃষিক্ষেত্রে আয়বৃদ্ধি নিশ্চিত করা গেলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা বৃদ্ধির পথে অনেক দূর যাওয়া যেত। তাতে গোটা অর্থব্যবস্থারই লাভ হত। অর্থমন্ত্রী সুযোগটি হেলায় হারালেন।

শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য, এই দু’টি অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র অতিমারির ধাক্কায় বিপর্যস্ত হয়েছে। এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ালেন ১১ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হারের কথা মাথায় রাখলে এই বৃদ্ধি যৎসামান্য। কিন্তু, তার চেয়েও উদ্বেগের কথা হল, গত বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে যে টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, প্রকৃত খরচের পরিমাণ তার চেয়েও কম। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দের পরিমাণ গত বাজেটের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু, সংশোধিত হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ পাওয়া যাচ্ছে, এ বছরের বাজেট বরাদ্দ তার সমান। অর্থাৎ, মূল্যস্ফীতির অঙ্কটি হিসাব থেকে বাদ দিলে গত বছরের তুলনায় এ বছর স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ কমবে, এমন সম্ভাবনা প্রকট।

রাজ্য সরকারগুলি এই বাজেটে কী পেল? ২০২১-২২ অর্থবর্ষে রাজ্যগুলির জন্য বরাদ্দ হয়েছিল ১৬ লক্ষ কোটি টাকা। এই বাজেটে বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ লক্ষ ১১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, টাকার অঙ্কেই বরাদ্দ বেড়েছে এক শতাংশেরও কম। তার থেকে মূল্যস্ফীতির হার বাদ দিলে বরাদ্দ কমেছে। এবং, এই বরাদ্দের হিসাবের মধ্যেই ধরা রয়েছে মূলধনি খাতে ব্যয়ের জন্য রাজ্যগুলির জন্য বিশেষ সহায়ক ঋণবাবদ এক লক্ষ কোটি টাকাও— এই টাকা খরচ করতে হবে পিএম গতিশক্তি সংক্রান্ত, এবং অন্যান্য মূলধনি খাতে।

অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রত্যাশা ছিল, তিনি নাগরিকের বর্তমান সঙ্কট দূর করার জন্য যা করার, করবেন। তার বদলে তিনি ‘অমৃত কাল’-এর চিন্তায় মগ্ন হলেন। সেই দীর্ঘমেয়াদে কত জন বেঁচে থাকতে পারবেন, কে জানে!

সেন্টার ফর ইকনমিক স্টাডিজ় অ্যান্ড প্ল্যানিং, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement