এক আসরে উপস্থিত জ্যোতি বসু, ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ, হরকিষেন সিংহ সুরজিৎ এবং মাকিনেনি বাসবপুন্নাইয়া। উপস্থিত এক তরুণ নেতাও। কখনও সুরজিৎ, কখনও বাসবপুন্নাইয়া, কখনও আবার ইএমএস তাঁকে ডেকে টুকটাক নির্দেশ দিচ্ছেন। কিছু ক্ষণ চলার পরে জ্যোতিবাবু সুরজিতের উদ্দেশে বলে উঠলেন, “এ ছেলেটা তো ভয়ঙ্কর! এর থেকে সাবধানে থাকতে হবে!” সুরজিৎ কারণ জানতে চাইলে জ্যোতিবাবু বললেন, “আমরা কে কী বলছি, সবাই বুঝতে পারছি না। কিন্তু ও আমাদের সকলের কথা বুঝে যাচ্ছে!” সে দিন ইএমএসের সঙ্গে মালয়ালম, বাসবপুন্নাইয়ার সঙ্গে তেলুগু, সুরজিতের সঙ্গে পঞ্জাবি এবং জ্যোতিবাবুর সঙ্গে বাংলায় টুকরো টুকরো সংলাপ চালাচ্ছিলেন ওই তরুণ! সেটাই জ্যোতিবাবুর মন্তব্যের কারণ!
সেই ছেলেটি সীতারাম ইয়েচুরি। সে দিনের সেই তরুণ জাতীয় রাজনীতিতে নানা বিন্দুতে থাকা নানা চরিত্রের সঙ্গে সমন্বয় গড়ে তুলতে আজীবন ওস্তাদ। লেখাপড়ায় চৌকস, বক্তৃতায় যুক্তিবাদী। মিত এবং মিষ্টভাষী। রাজনীতিতে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে থাকা কারও সম্পর্কেও কটু ভাষা শোনা যায়নি তাঁর মুখে। শেষ পর্যন্ত মানুন বা না-মানুন, জাতীয় রাজনীতির সব গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে তাঁর বক্তব্য শুনে গিয়েছেন সবাই। বছরের পরে বছর।
আদি বাড়ি অন্ধ্রপ্রদেশে। বাবা ই়ঞ্জিনিয়ার, মা সরকারি চাকুরে। দশম শ্রেণির পরে চলে আসেন দিল্লিতে। সিবিএসই-র দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় সর্বভারতীয় স্তরে প্রথম। এর পরে সেন্ট স্টিফেন’স কলেজ থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক। জেএনইউ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর, সেখানেও প্রথম শ্রেণি। জেএনইউ-এই শুরু করেছিলেন পিএইচ ডি গবেষণা। জরুরি অবস্থার সময়ে গ্রেফতার হয়ে সে উদ্যোগ থমকে যায়।তবে সেই কলেজজীবন থেকে সতীর্থ প্রকাশ কারাটকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লির জেএনইউ-এ যে বাম ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলেন সীতারাম, সে পরম্পরা এখনও থমকে যায়নি।
এসএফআই-এর ইতিহাসে সীতারামই প্রথম বাংলা বা কেরলের বাইরে থেকে সর্বভারতীয় সভাপতি। একাধারে ঝকঝকে শিক্ষাজীবন এবং দিল্লির বুকে ছাত্র রাজনীতিতে আকর্ষক ব্যক্তিত্ব, সীতারাম নজর কেড়ে নিয়েছিলেন অল্প দিনেই। সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্তি মাত্র ৩২ বছর বয়সে। তার কয়েক বছর পরে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে তৈরি হয়েছিল কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলী, যে কমিটি কাজ করবে পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যবর্তী স্তর হিসাবে। সেখানেও শুরু থেকে সদস্য সীতারাম এবং প্রকাশ। পলিটব্যুরোর সদস্য ১৯৯২ সাল থেকে।
এই রাজ্য থেকে সীতারামকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছিলেন অনিল বিশ্বাস। সঙ্গে বৃন্দা কারাট। বাংলার সঙ্গে অবশ্য সীতারামের সম্পর্ক বরাবরই নিবিড়। ব্যক্তি জীবনে তাঁর প্রথম স্ত্রী বঙ্গতনয়া। সেই বিবাহের সূত্রে তাঁর এক পুত্র ও এক কন্যা। পুত্র আশিসকে হারাতে হয়েছিল কোভিডে। কন্যা অখিলা বিদেশে পড়ান। পরবর্তী কালে সাংবাদিক সীমা চিস্তিকে বিয়ে করেছিলেন সীতারাম। ঠাট্টা করে বলতেন, স্ত্রী তাঁকে পোষেন আর তিনি বিপ্লব করে বেড়ান! আর একটা মশকরাও শোনা যেত তাঁর মুখে। “নামে আমার সীতা আর রাম, দুটোই আছে। কিন্তু ভক্ত নই। অন্ধ্রের ছেলে, দিল্লিতে বড় হয়েছি, বাংলা থেকে সাংসদ হয়েছি। এটাই তো ভারত!”
সিপিএমের অন্দরে চর্চা আছে, দলের দুই প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ইএমএস এবং এইচকেএস (সুরজিৎ) তাঁদের প্রিয়তম শিষ্য হিসাবে বেছে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন যথাক্রমে প্রকাশ কারাট ও সীতারাম ইয়েচুরিকে। সুরজিৎ যেমন জাতীয় স্তরে জোট রাজনীতির কারিগর ছিলেন, তাঁর শিষ্যও তা-ই। নব্বইয়ের দশকে যুক্তফ্রন্ট বা মনমোহন সিংহের আমলে প্রথম ইউপিএ সরকার, অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি তৈরি করতে বরাবর সীতারামের হাত ছিল। একই ভূমিকা বিজেপির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ গঠনেও। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক হয়ে দলের সাবেক ‘সমদূরত্ব’-এর নীতি পিছনে ফেলে যেমন কংগ্রেসের সঙ্গে সমন্বয়ের রাস্তা খুলেছেন, তেমনই বাংলার রাজনীতিতে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল রয়েছে বলে জাতীয় স্তরে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ থেকে সরে দাঁড়াননি। রাহুল গান্ধীর সঙ্গে সীতারামের কেন এত দহরম-মহরম, সেই প্রশ্ন তুলে মমতা বিভিন্ন সময়ে কুপিত হয়েছেন। সীতারাম হেসে উড়িয়েছেন!
বিশ্বাস করেছেন, সংসদীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যখন দেশ চলছে, সেই ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েই নিজেদের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। হিংসায় কোনও কালে বিশ্বাসী নন, অহেতুক জঙ্গিপনাতেও। অস্ত্র ছেড়ে সংসদীয় রাজনীতিতে ফেরার সময়ে নেপালের মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনা করতে সীতারামকেই পাঠিয়েছিল ভারত সরকার। ইউপিএ আমলে আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি, বিচারপতি সৌমিত্র সেনের ইমপিচমেন্ট বা নরেন্দ্র মোদীর আমলে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ভাষণের উপরে সংশোধনী এনে বিতর্ক— রাজ্যসভায় অজস্র উপলক্ষে যুক্তি এবং বাগ্মিতায় প্রশংসা অর্জন করেছেন। তাঁকে তৃতীয় দফায় রাজ্যসভায় পাঠানোর জন্য সমর্থন জোগাতে এক বাক্যে রাজি ছিলেন সনিয়া ও রাহুল গান্ধী। কিন্তু তত দিনে সীতারাম সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক হয়ে গিয়েছেন। সম্পাদককে সংসদীয় পদে থাকতে দিতে দলে আপত্তি ছিল, সীতারামও পিছিয়ে এসেছিলেন। কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার রাজনৈতিক কৌশল দলে পাশকরানোর ‘কৃতিত্ব’ যেমন তাঁর নামের পাশে থাকবে, তেমনই তাঁর সাধারণ সম্পাদক থাকার সময়েই বাংলায় সিপিএমের শূন্য হওয়ার ‘ব্যর্থতা’ও খাতায় তোলা থাকবে।
শাসকের দাপট-লাঞ্ছিত এই অস্থির সময়ে একই সঙ্গে দৃঢ়তা ও সহিষ্ণুতার প্রতীক হয়ে থেকে যাবে একটি ছবি— জেএনইউ ক্যাম্পাসে আচার্য ইন্দিরা গান্ধীর পদত্যাগ দাবি করে চিঠি পড়ছেন ছাত্র সংসদের নেতা সীতারাম। পাশে দাঁড়িয়ে শুনছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা! ফিরে গিয়ে যিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেবেন।