উল্লসিত: বিধানসভা নির্বাচনে বিরাট জয় লাভের পর বিজেপি সমর্থকরা, মুম্বই, ২৩ নভেম্বর। ছবি: পিটিআই।
পুণে শহরের মাঝখানে ব্রিটিশ জমানার স্কুল সে-দিন প্রদীপ, ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছিল। স্কুলের উঠোনে ভারতমাতার ছবি। এক দিকে চা, সান্ধ্যকালীন জলখাবারের আয়োজন।‘দীপাবলি মিলন’ উপলক্ষে শহরের বিদ্বজ্জনদের একাংশ আমন্ত্রিত। খুব বেশি হলে ৩০-৪০ জন। আরএসএস ওরফে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচারকরা সকলের সঙ্গে কথা বলছেন। শুভেচ্ছা বিনিময় চলছে। স্বাভাবিক নিয়মেই ভোটের প্রসঙ্গ আলোচনায় আসছে। আরএসএস নেতারা লুকোছাপা না করেই বলছেন, লোকসভা ভোটে দলিত, মুসলিমদের ভোট পেয়ে বিজেপি বিরোধী ইন্ডিয়া জোট ভাল ফল করেছিল। বিরোধীরা সংরক্ষণ তুলে দেওয়া হবে, সংবিধান বদলে দেওয়া হবে বলে ‘মিথ্যে প্রচার’ চালিয়েছিলেন। এ বার সেই ভুল থেকে ‘শিক্ষা’ নিতে হবে।
শুধু পুণে নয়। মহারাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে আরএসএস গোটা রাজ্য জুড়ে এমন চল্লিশ হাজার অনুষ্ঠান করেছিল। সংখ্যাটা ভুল নয়। চল্লিশ হাজারই। সমাজের বিভিন্ন বর্গের কম-বেশি ২৫ থেকে ৩০ জনকে নিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন আরএসএস প্রচারকরা। বুঝিয়েছিলেন, ভোটের দিন কুঁড়েমি করে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। সবাইকে ভোট দিতে হবে। সরাসরি বিজেপিকে ভোট দিতে বলেননি। তবে স্থানীয় সমস্যাকে গুরুত্ব না দিয়ে সনাতন সংস্কৃতি, হিন্দু ধর্ম, রাষ্ট্রের স্বার্থ-এর মতো বৃহত্তর বিষয়ের কথা ভাবতে বলেছিলেন। মরাঠা, ওবিসি, দলিত, জনজাতি— এই সব পরিচিতির ঊর্ধ্বে উঠে ভারতীয় হিন্দু পরিচিতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। এই গোটা প্রচার কর্মসূচির দায়িত্বে ছিলেন আরএসএসের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, মহারাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত অতুল লিমায়ে। বহুজাতিক সংস্থার চাকরি ছেড়ে আরএসএসের প্রচারক হিসাবে নতুন জীবন শুরু করা নাশিকের ইঞ্জিনিয়ার।
২০ নভেম্বর মহারাষ্ট্রে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরে বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র ফডণবীস প্রথমেই চলে গিয়েছিলেন নাগপুরে আরএসএসের সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের কাছে। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। উত্তরাখণ্ডের কর্মসূচি স্থগিত রেখে মাঝপথে ভাগবত শুধু ভোট দিতে এক দিনের জন্য নাগপুরে ফিরেছিলেন। নাগপুরেরই বিজেপি সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী বিবৃতি দিয়ে ‘স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন’গুলিকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। তখনও তাঁরা মহারাষ্ট্রের ভোটের ফলের কথা জানেন না। তবে এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন, রাজ্যে ২০১৯-এর বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় এ বার অন্তত ৪ শতাংশ অঙ্ক বেশি ভোট পড়েছে। এর তিন দিন পরে মহারাষ্ট্র ভোটের ফল প্রকাশের পরে টের পাওয়া গেল, এই অতিরিক্ত ভোটের সিংহভাগই গিয়েছে বিজেপি তথা মহায্যুতি জোটের ঝুলিতে। আর তারই সুফল হিসাবে বিজেপি জোট মহারাষ্ট্রের ২৮৮টির মধ্যে ২৩০টি আসনে জিতে ক্ষমতায় ফিরছে।
আরএসএস নেতারা বলছেন, ‘ভুল থেকে শিক্ষা’ নেওয়া হয়েছে। কী সেই শিক্ষা? তা হল, বিজেপিকে নির্বাচনে জিততে হলে উন্নয়ন ও হিন্দুত্বের মিশেলেই ভরসা করতে হবে। বিজেপিকে তার ‘বিচার পরিবার’ বা মতাদর্শের আঁতুড়ঘর আরএসএসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় রেখে কাজ করতে হবে।
কাকে এই শিক্ষা দিল আরএসএস? নরেন্দ্র মোদীকে? জগৎপ্রকাশ নড্ডাকে? না কি বিজেপির তামাম ছোট-বড় নেতাদের, যাঁরা ভাবতে শুরু করেছিলেন, শুধু নরেন্দ্র মোদীর ভরসাতেই বছরের পর বছর নির্বাচনে জিতে যাওয়া যাবে?নরেন্দ্র মোদী যে বছর প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হন, সেই ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে আরএসএস সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের নির্দেশে ‘১০০ শতাংশ ভোটদান’-এর পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল। ভোটের হার বাড়ানো নয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল, বিজেপির পক্ষে ভোটের হার বাড়ানো। তার পরের দশ বছর সরকারের যাবতীয় ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর দফতরে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়ার পরে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে আরএসএস আর সে ভাবে ময়দানে নামেনি। কারণ মাঝারি মাপের বিজেপি নেতারা ধরে নিয়েছিলেন, আরএসএসের সাহায্য ছাড়াই তাঁরা নির্বাচনে জিতে যাবেন। কারণ নরেন্দ্র মোদী আছেন। বিজেপি জাতীয় সভাপতি জে পি নড্ডা নির্বাচনের মধ্যেই মন্তব্য করেন, বিজেপি এখন নিজেই নিজের মতো চলতে সক্ষম। আগের মতো আরএসএস-এর সাহায্য প্রয়োজন নেই। তাই পাড়ায় পাড়ায় বিজেপি নেতারা আরএসএসের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলার প্রয়োজনও বোধ করেননি। বিজেপি সমর্থকরা ধরে নিয়েছিলেন, নরেন্দ্র মোদী এমনিতেই জিতে আসবেন। আর কষ্ট করে ভোট দিতে গিয়ে কী হবে?
ভুল ভাঙে লোকসভার ফল প্রকাশের পরে। নরেন্দ্র মোদী তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বিজেপির আসন কমে গিয়ে লোকসভায় শরিকনির্ভর হয়ে পড়েছে। ‘মোদী সরকার’ এক লহমায় ‘এনডিএ সরকার’-এ রূপান্তরিত হয়। সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত তাঁর একের পর এক বক্তৃতায় বিজেপি নেতৃত্বকে ‘ঔদ্ধত্য’, ‘আচার-আচরণ’ নিয়ে সতর্ক করতে শুরু করেন।
বিজেপিকে সবচেয়ে বেশি খেসারত দিতে হয়েছিল দুই বড় রাজ্য, উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে। যোগী আদিত্যনাথ ও দেবেন্দ্র ফডণবীস আর দেরি করেননি। তাঁরা সরাসরি সরসঙ্ঘচালকের সঙ্গে দেখা করে আরএসএস-এর সহযোগিতা চেয়েছিলেন। আর যে জে পি নড্ডা বলেছিলেন, বিজেপি এখন নিজের পায়ে হাঁটতে সক্ষম, তিনি কেরলে গিয়ে আরএসএস-এর সমন্বয়ের বৈঠকে যোগ দেন। আরএসএস-এর সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবলে জানান, বিজেপি সভাপতির মন্তব্য তাঁরা ‘নোট’ করেছেন। তবে পরিবারের মধ্যে ফাটল থাকলে তা মেরামত করে নেওয়া হবে। তার পরেই প্রথমে হরিয়ানা, তার পরে মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে পূর্ণ শক্তি দিয়ে ময়দানে নামে আরএসএস। বিরোধী শিবির যখন মহারাষ্ট্রে মরাঠা ভোট, ওবিসি ভোটে ভাগ বসাতে চাইছে, তখন আরএসএস হিন্দু পরিচিতিকে তুলে ধরেছে। হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করতে যোগী আদিত্যনাথের ‘বাঁটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’ স্লোগানে সিলমোহর দিয়েছিল। মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে কোনও রাজ্যের সমস্যা প্রধান বিষয় হয়ে ওঠেনি। আরএসএস সেখানে সীমান্তের নিরাপত্তা, কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের মতো প্রসঙ্গ তুলে এনে ‘রাষ্ট্রহিত’-এর স্বার্থের কথা বলেছিল। যার ফল, হরিয়ানার পরে মহারাষ্ট্রে কার্যত হারা ম্যাচ জিতে বেরিয়ে গিয়েছে বিজেপি।
আরএসএস-এর শিক্ষাটা তা হলে কী? নরেন্দ্র মোদীর বিজেপিকে বার্তা দেওয়া যে, আরএসএস ছাড়া চলবে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে নরেন্দ্র মোদীকে ছাড়াও আরএসএস-এর চলবে। নরেন্দ্র মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই সংগঠনের থেকে তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিসত্তাকে বেশি গুরুত্ত্ব দিয়ে এসেছেন। আরএসএস-এর নীতির বিপরীত হলেও এই ব্যক্তিসত্তার প্রচার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে লক্ষ গুণ বেড়েছে। আবার মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে আরএসএস বিপুল লাভবান হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদে আরএসএস-এর প্রচারকদের নিয়োগ থেকে সমাজের গভীরে সঙ্ঘের শিকড় ছড়িয়ে দেওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। এই সুবিধা বাজপেয়ীর আমলে আরএসএস পায়নি। কিন্তু মোদী জমানায় আরএসএস চালকের আসন থেকে পিছনের আসনে চলে গিয়েছে, এটাও সত্যি।
গত লোকসভা নির্বাচন সেই অর্থে আরএসএস-এর সামনে থেকে সুযোগ করে দিয়েছিল নিজের অভাব বোঝানোর। হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোট আরএসএসকে নিজের প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর সুযোগ করে দিয়েছে। এ বার আরএসএস পিছনের আসন থেকে চালকের আসনে ফিরতে চাইবে। তা নিশ্চিত করতে আরএসএস নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে বিজেপির জাতীয় সভাপতির পদে বসানোর কৌশল নেবে। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ কি তা মেনে নেবেন?
আরএসএস শতবর্ষে পা দিচ্ছে। আগামী এক বছরের মধ্যে নরেন্দ্র মোদী পঁচাত্তর বছরে পা দেবেন। বিজেপির বানপ্রস্থে যাওয়ার বয়স। ডোনাল্ড ট্রাম্প বনাম চিনের সংঘাত নয়, নরেন্দ্র মোদী বনাম রাহুল গান্ধী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াই নয়, আগামী এক বছরে দেশের রাজনীতিতে সব থেকে চিত্তাকর্ষক বিষয় হয়ে উঠবে এই নরেন্দ্র মোদী বনাম আরএসএস-এর পাঞ্জার লড়াই।