বিজেপির অন্দরমহলের প্রাচীন প্রবাদ, রাত যত গভীর হয়, অমিত শাহ ততই সক্রিয় হয়ে ওঠেন। দিল্লিতে থাকুন বা রাজ্য সফরে, সারা দিন জনসভা, রোড শো, প্রচারের কাজের পরেও, দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে অন্তত রাত দুটো-আড়াইটে পর্যন্ত বৈঠক করা তাঁর কাছে জলভাত। আড়ালে-আবডালে বিজেপি নেতারা নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের তুলনা টেনে বলেন, ‘এক জন বলেন, না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা! অন্য জনের মন্ত্র হল, না সোয়ুঙ্গা, না সোনে দুঙ্গা!’ অমিত শাহের জীবনের যেন একটাই ধ্যান-জ্ঞান, একটাই কাজ— বিজেপি নামক নির্বাচন জেতার বিরাট যন্ত্রটাকে সব সময় তেল দিয়ে মসৃণ করে রাখা।
অমিত শাহের নিজের অবশ্য এই কথায় প্রবল আপত্তি রয়েছে। ঠিক চার বছর আগে তিনি নিজেই ওড়িশায় বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আমরা কি বিজেপিকে শুধুমাত্র একটা নির্বাচন জেতার যন্ত্রে পরিণত করতে চাই?’ দিনটা ছিল ২০১৭-র ১৫ এপ্রিল। বিজেপির সভাপতির পদে তত দিনে অমিত শাহের তিন বছর হয়ে গিয়েছে। তিনি সে দিন বলেছিলেন, বিজেপিকে সরকার ও সমাজের মধ্যে একটা সেতু হিসেবে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবেও দায়িত্ব থাকবে। তার জন্য দলের প্রতিটি কর্মীকে সমাজের সব অংশের কাছে পৌঁছতে হবে।
বিজেপির নির্বাচনী যন্ত্র কী ভাবে কাজ করে, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে রাজ্যের মানুষ এখন তা রোজ চাক্ষুষ করছেন। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন একটি দল কী ভাবে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাতে পারে, তা দেখছেন। কী ভাবে প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে বিজেপির শীর্ষনেতারা দিনের পর দিন রাজ্যে এসে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে পারেন, তার সাক্ষী হচ্ছেন। ঠিক এই সময় চার বছর আগের অমিত শাহের কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখে। গত ৬ এপ্রিল বিজেপির প্রতিষ্ঠা দিবসে মোদীর দাবি, বিজেপি নিছক ভোট জয়ের যন্ত্র নয়। বিজেপি দেশ ও দেশের মানুষের হৃদয় জয়ের নিরবচ্ছিন্ন, নিরলস অভিযান।
নিন্দুকেরা প্রশ্ন তুলতে পারেন, বিজেপি কি তা হলে হৃদয় জয় না করেও ভোট জয়ের কৌশল রপ্ত করে ফেলেছে? না কি, ভোট জয়ের থেকেও সমাজে মতাদর্শের শিকড় গেড়ে ফেলাটাই বিজেপির আসল লক্ষ্য? বোধ হয় তা-ই। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিপুল জয় ও দিল্লির মসনদ দখলের পরেও অমিত শাহ দিল্লির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে বক্তৃতায় বলেছিলেন, “মতাদর্শগত লড়াই এখনও শেষ হয়নি।” নির্বাচনে হারজিত দিয়ে যে বিজেপিকে মাপা উচিত হবে না, সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন শাহ।
ঠিক এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন বিজেপির কাছে নিছক ভোটের লড়াই নয়। তার থেকেও বেশি মতাদর্শগত লড়াই। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্মভূমি থেকে বামপন্থার দিকে ঝুঁকে থাকা ধ্যানধারণা মুছে ফেলে হিন্দুত্ব ও জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটানোটা বিজেপি-আরএসএস’এর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও বটে। তাতে সফল হলে বিজেপি নিজের গেরুয়া ঝান্ডায় সেঁটে থাকা হিন্দি বলয়ের পার্টির তকমাটাও ঝেড়ে ফেলতে পারবে।
অমিত শাহকে যাঁরা ইদানীং বেশির ভাগ সময়টাই পশ্চিমবঙ্গে কাটাতে দেখে আশ্চর্য হচ্ছেন, তাঁদের ২০১৭-তে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক। ওড়িশায় বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির সেই বক্তৃতার ঠিক ১০ দিন পরে অমিত শাহ হাজির হয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়ির ৯৩ নম্বর বুথে। সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা দেশে বিজেপির ‘বিস্তারক অভিযান’। লক্ষ্য ছিল, বুথ ধরে ধরে প্রতিটি পরিবারের বাড়িতে বিজেপির শীর্ষনেতা থেকে নিচু তলার কর্মীরা পৌঁছে যাবেন। সভাপতি হিসেবে শাহ নিজে পশ্চিমবঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের কঠিনতম ঠাঁই বেছে নিয়েছিলেন। কথিত, কৈলাস বিজয়বর্গীয়কে তিনি বলেছিলেন, রাজ্যের যে এলাকা সবচেয়ে কঠিন, সেখান থেকে অভিযান শুরু করতে হবে। ২০১৭-র ২৫ এপ্রিল থেকে ২১ সেপ্টেম্বর, পাঁচ মাসে অমিত শাহ দেশ জুড়ে ৪১,৮৪৪ কিলোমিটার রাস্তা সফর করেছিলেন।
বিজেপির সংস্কৃতিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের এই লাগাতার রাজ্যে রাজ্যে চষে বেড়ানো বা ‘প্রবাস’-এর ঐতিহ্য আগেও ছিল। অমিত শাহ বিজেপির হাল ধরে তাতে আরও শান দিয়েছেন। দলের প্রভাব বিস্তার ও সংগঠন মজবুত করতে রাজ্যে গিয়ে ঘাঁটি গেড়ে ফেলা নামক ‘প্রবাস’-কে নিয়ম করে ফেলেছেন। ভোটার তালিকায় এক একটি পৃষ্ঠার দায়িত্বে এক এক জন ‘পন্না প্রমুখ’ থেকে প্রতি দশটি বুথ পিছু একটি করে ‘শক্তি কেন্দ্র’ তৈরি করেছেন। মুখে অস্বীকার করলেও এই নির্বাচন জয়ের যন্ত্র অমিত শাহের নিজের হাতে সাজানো। শুধু বিধানসভা ভোট বলে নয়। এর পরে কলকাতা বা রাজ্যের অন্য পুরসভার ভোট হলেও এই যন্ত্র একই ভাবে পূর্ণ শক্তিতে ঝাঁপাবে। কিছু দিন আগে তেলঙ্গানার হায়দরাবাদ পুরভোটে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের দল বেঁধে প্রচারে যাওয়ার উদাহরণ তো হাতের সামনেই রয়েছে।
প্রাণপণ চেষ্টার পরেও যদি মোদী-শাহ এ বার পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করতে না পারেন, তা হলেও বিজেপি তার মতাদর্শগত লড়াইয়ে ইতিমধ্যেই অনেকখানি সফল। মুসলিম তুষ্টিকরণের অভিযোগ তুলে ভোটের মেরুকরণ, নাগরিকত্বের আশ্বাস দিয়ে মতুয়াদের পরিচিতিসত্তাকে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির একেবারে মূলস্রোতে এনে ফেলেছে। উগ্র হিন্দুত্ব ও উগ্র জাতীয়তাবাদ এরই পরের ধাপ। এতে কোনও ভুল নেই, তুষ্টিকরণের অভিযোগ ও মতুয়াদের নিয়ে পরিচিতিসত্তার রাজনীতি— দুই হাতিয়ারই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে যত্ন করে বিজেপির হাতে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু তা বলে বিজেপির নির্বাচনী যন্ত্রের কৃতিত্বও কোনও ভাবে খাটো করা যায় না। চোখের আড়ালে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে প্রচার থেকে বিজেপির শীর্ষনেতারা বারে বারেই অনুপ্রবেশ, গরু পাচারের বিষয়ে ধর্মের রং লাগাতে সফল। চায়ের দোকান থেকে টিভির পর্দা— কোনও রাজনৈতিক বিতর্কই এখন আর এই হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। শীতলখুচির কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে হতদের ধর্ম পরিচয়টাই তাই আসল হয়ে উঠেছে। তাই বিজেপি নেতারা দাপটের সঙ্গে শীতলখুচিতে চার জনের বদলে আট জনকে মেরে ফেলা দরকার ছিল বলতেও পিছপা হন না। নির্বাচনী যন্ত্র এ ভাবেই কখনও সশব্দে, কখনও নিঃশব্দে কাজ করে চলে।
কিন্তু তা বলে কি বিজেপি অপ্রতিরোধ্য? ২০১৪-র পরে ২০১৯-এ বিজেপির ‘প্রচণ্ড বহুমত’-এ জয়, দেশের ১৩টি রাজ্যে বিজেপি বা তার জোটের সরকার চললেও মনে রাখা দরকার, ২০১৮-র পরে গত ১৮টি বিধানসভা ভোটে বিজেপি মাত্র দু’টি রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জিতেছে। ত্রিপুরা ও অরুণাচল প্রদেশ। হরিয়ানা, বিহারে বিজেপি শরিকদের সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছে ঠিকই। কিন্তু কান ঘেঁষে। রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ডে বিজেপি ক্ষমতা হারিয়েছে। দিল্লি, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, এমনকি বাংলার পাশের রাজ্য ওড়িশায় বিজেপি ক্ষমতা দখল করতে পারেনি।
ওড়িশায় মুসলিমরা জনসংখ্যার মাত্র ২.২ শতাংশ। হয়তো সে কারণেই ‘জয় জগন্নাথ’-এর রাজ্যে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে মেরুকরণ করা কঠিন।