CryptoCurrency

ক্রিপ্টো-নৈরাজ্য থেকে সাবধান

Advertisement

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২২ ০৯:৪৫
Share:

বিটকয়েনের মতো ভার্চুয়াল মুদ্রা নিয়ে আগ্রহ গত বছর থেকেই তুঙ্গে উঠেছে। এই মুদ্রার জোগানের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে গাণিতিক ও কম্পিউটার বিজ্ঞানের জ্ঞানসমৃদ্ধ ও তৎসম্পর্কিত মেধাসম্পন্ন মানুষজনের হাতে। কোনও রাষ্ট্র তার নিজের আইনি মুদ্রাকে যে ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, ক্রিপ্টোকারেন্সিকে সে ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।

Advertisement

ধরুন, কাল ভারত সরকার বলল যে, এখন থেকে এ দেশে ভারতীয় মুদ্রার সঙ্গে সঙ্গে কোনও একটি বিশেষ ক্রিপ্টোকারেন্সিকেও দেশের আইনি মুদ্রা হিসাবে গণ্য করা হবে। অর্থাৎ, সেই ক্রিপ্টো-মুদ্রা দিয়েও জিনিসপত্র কেনাকাটা, ব্যাঙ্কে সঞ্চয়, শেয়ার বাজার বা বাড়িঘর বিক্রিতে লেনদেন করা যাবে। টাকার অঙ্কে সেই ক্রিপ্টো-মুদ্রার একটি দামও স্থির হল। ধরা যাক, দেশে ভারতীয় মুদ্রায় মোট টাকার পরিমাণ ছিল ১০০ টাকা; ক্রিপ্টো-মুদ্রা বাবদ তাতে যোগ হবে আরও ১৫০ টাকা। অর্থাৎ, দেশের বাজারে নগদের জোগান বাড়বে। কিন্তু, নগদের জোগান বেড়েছে বলে রাতারাতি উৎপাদন বাড়বে না। ধান-চাল, দুধ-ফলমূল, লোহা, পুতুল সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার— সবেরই জোগান আগে যা ছিল, স্বল্পমেয়াদে সেটাই থাকবে। বেশি মুদ্রা একই পরিমাণ জিনিসের পিছনে দৌড়লে দাম বাড়বে।

এক দল অর্থনীতিবিদ মনে করেন যে, এই ঘটনাটা মন্দ নয়। হাতে অতিরিক্ত পয়সা এলে লোকে বেশি জিনিস কিনবে— তাতে বিক্রি না হওয়া জিনিস, কাজ না পাওয়া মানুষ, সবারই উপকার হবে। দেশের উপকার হবে। বাজারে চাহিদা বাড়লে যে যে জিনিসের উৎপাদন দ্রুত বাড়ানো সম্ভব, উৎপাদন বাড়বে, ফলে মূল্যবৃদ্ধি কম হবে। যেখানে সেটা সম্ভব নয়, সেখানে দাম বেশি বাড়বে। কিন্তু, অর্থব্যবস্থার চাকা গড়াতে আরম্ভ করবে।

Advertisement

একটি রাজনৈতিক সমস্যাও আছে। দেশের অর্থব্যবস্থা যখন গাড্ডায় পড়ে, তখন সুদের হার কমিয়ে, টাকার জোগান বাড়িয়ে অর্থব্যবস্থাকে চাঙ্গা করা একটি কার্যকর পন্থা। সব দেশের সরকারই কাজটি করে। ভারতীয় সরকারও বহু বার করেছে। ক্রিপ্টো-মুদ্রা যদি আইনি মুদ্রার মর্যাদা পায়, এবং কালক্রমে যদি দেশের মুদ্রার উপর মানুষের বিশ্বাস কমে যায়, তা হলে টাকার জোগান বাড়িয়ে অর্থব্যবস্থাকে চাঙ্গা করে তোলার ওষুধটি কমজোরি হয়ে পড়বে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা ব্যাহত হবে। যদি আইন করে দেশে সামগ্রিক ক্রিপ্টো-মুদ্রার জোগানকে অপরিবর্তিত রাখাও যায়, তবুও আর্থিক নীতির নিয়ন্ত্রণক্ষমতা খুবই ব্যাহত হতে পারে।

সরকারের কল্যাণমূলক কাজকর্ম, দেশের সঙ্কটাবস্থায় মানুষকে স্বস্তি দেওয়া, দেশের অর্থনীতিকে ঠিক দিকে চালিত করা, সব কিছুতেই সরকারের একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে। দেশের অর্থব্যবস্থায় দেশের সার্বভৌম গণ্ডির বাইরের একটি মুদ্রাব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ হলে দেশের স্বাধীন আর্থিক নীতি বিপর্যস্ত হতেই পারে, সেখানে সমস্যা।

এ দেশের টাকা এবং ক্রিপ্টো-মুদ্রা, এই দুটোর বিনিময় মূল্য স্থির করা শক্ত। ক্রিপ্টো-মুদ্রার জোগানের পরিমাণ বাড়লে-কমলে, অথবা আন্তর্জাতিক চাহিদার পরিবর্তন ঘটলে টাকার সাপেক্ষে তার দামও পাল্টাবে। মানুষ যদি ভার্চুয়াল টাকাকড়িই বেশি পছন্দ করে, তা হলে ভারতীয় টাকা সমস্যায় পড়বেই। তার জন্য কোমর বাঁধার প্রয়োজন আছে বইকি। তবু এ কথা সত্যি যে, বিভিন্ন ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে জিনিসপত্র কেনাবেচা, টাকাকড়ির লেনদেন ইত্যাদি দেশের অর্থনীতির গতি বাড়াতে সাহায্য করে। তবে এর ফলে জাতীয় আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এ সবের আমূল পরিবর্তন বা আদৌ কোনও উন্নতি হচ্ছে কি না, সেটা বোঝা শক্ত এবং এ বিষয়ে কোনও প্রামাণ্য দলিল এখনও তৈরি হয়নি। তবে, রাজনৈতিক স্বার্থে নগদের জোগান বাড়িয়ে, সুদের হার কমিয়ে সরকার দেশে ‘অচ্ছে দিন’-এর আগমনী শোনাতে চাইলে ক্রিপ্টো-মুদ্রা তাতে বাদ সাধবে।

ক্রিপ্টো-মুদ্রার জোগান গাণিতিক অ্যালগরিদম দিয়ে নির্ধারিত হওয়ার কথা। এখন অবধি যা জানা যাচ্ছে, তাতে ক্রিপ্টো-মুদ্রার জোগানের বৃদ্ধির হার গাণিতিক ভাবেই স্বনিয়ন্ত্রিত। কিন্তু একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ভবিষ্যতে যদি ক্রিপ্টো-মুদ্রার সিংহভাগ কুক্ষিগত করে ফেলে এবং ক্রিপ্টো-মুদ্রা যদি বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে জনপ্রিয় হয়, তা হলে বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থা তাদের উপর স্বাভাবিক ভাবেই খানিকটা নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এক জন বড় মাপের আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী ব্রিটেনকে বাধ্য করেছিলেন, পাউন্ড-স্টার্লিংকে নিয়ন্ত্রিত থেকে অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রামানে নিয়ে যেতে, এই রাস্তা ধরেই।

যা দৃশ্যত অ-বাস্তব, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা এক অর্থে প্রায় অসাধ্য। দৃশ্যত অ-বাস্তব, অথচ কোটি কোটি টাকার ব্যবসাতে কোনও ধরনের কর বসানো ভীষণ শক্ত। তা ছাড়া, যে ক্ষেত্রে বেশি কর দিতে হচ্ছে, মুহূর্তের মধ্যে পুঁজি সেই ক্ষেত্রটি ছেড়ে অন্য ক্ষেত্রে চলে যেতে পারে। ব্যবসার ক্ষেত্রে হয়েও থাকে। তাই ই-কমার্স ব্যবসাকে ত্বরান্বিত করলেও, সেখান থেকে সরকার আয় করে সমাজের কল্যাণমূলক কাজের জন্য খরচাপাতি করতে পারবে, সেটা অত সহজ নয়। তাই দৃশ্যত অ-বাস্তব টাকাকড়ির নিয়ন্ত্রণও, তা সে যে কারণেই হোক, কঠিন কাজ। তাই হয়তো ভার্চুয়াল টাকাকড়ির মোকাবিলায় সরকারি স্তরেও প্রতিযোগী ভার্চুয়াল টাকাকড়ি সৃষ্টির প্রস্তাবনা শুরু হয়েছে।

প্রযুক্তির ভাল নিশ্চয়ই মন্দকে ছাপিয়ে যায়। কিন্তু হ্যাকারদের নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রবণতা, মানুষের প্রতিষ্ঠানবিরোধী এক জৈবিক মানসিকতার প্রতিফলন— মানসিকতাটি হল, আমি যা পছন্দ করি না, তাকে ধ্বংস করে দেওয়া বা উল্টে দেওয়াই আমার পরিচিতির একমাত্র রাস্তা। নৈরাজ্য কখনও কাম্য হতে পারে না। তাই ক্রিপ্টো-নৈরাজ্য নিয়ে বিশ্বের সাবধান হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement