পঞ্জাবি-ভারতীয় বংশোদ্ভূত আফ্রিকা-ফেরত হিন্দু সন্তান ঋষি সুনক ২৫ অক্টোবর দীপাবলির দিন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হয়ে অনেক আশার সঞ্চার করেছেন, আবার কিছু আশঙ্কারও। শুরুতে শুভ ইঙ্গিতগুলির কথা বলি।
সুদূর ১৮৮৬ সালে, যখন বম্বের (এখন মুম্বই) পার্সি সমাজ-সংস্কারক দাদাভাই নওরোজি বিলেত গিয়ে হাউস অব কমনস-এর সদস্যপদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে লন্ডনের হোবর্ন আসন থেকে হেরে গেলেন, তখন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী লর্ড সলসবেরি বলেছিলেন, ‘কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ’-এর পক্ষে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নির্বাচিত হওয়া অসম্ভব। ‘পুরুষ’, কারণ তখনও আইনসভায় নারী প্রতিনিধিত্ব ছিল না। যাই হোক, সলসবেরিকে ভুল প্রমাণ করে মাত্র ছয় বছর পর ১৮৯২ সালে ফিন্সবেরি সেন্ট্রাল আসন থেকে জিতলেন দাদাভাই। আসল সত্য যা প্রমাণিত হল, তা হচ্ছে গণতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা, যা সেই অতীত ভিক্টোরীয় যুগেও পাঞ্জা লড়ে হারিয়ে দিয়েছিল গাত্রবর্ণ, জাতিপরিচয়, ধর্ম ইত্যাদি নানাবিধ মানুষে মানুষে অন্তরায়। লিঙ্গভেদটিও যে অভেদ্য প্রাকার নয়, তা ১৯৭৯ সালে দেখিয়েছেন মার্গারেট থ্যাচার। তবে যে অদৃশ্য অন্তরায়টি রয়ে গিয়েছিল আরও ১৩০ বছর— ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে অশ্বেতাঙ্গের অধিকার— সেটিও ঘুচিয়ে দিলেন এই তাম্রবর্ণ হাসিখুশি পঞ্জাবি যুবকটি, যিনি বলেন যে, তিনি দেশপরিচয়ে ব্রিটিশ, কিন্তু জাতি ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ে পুরোদস্তুর ভারতীয়। তিনি ধর্মে হিন্দু, শুধু এ কথা জানিয়েই ক্ষান্ত না হয়ে তিনি যে সপ্তাহান্তে মন্দিরে পূজা দিতে যান, তাও জানিয়েছেন। টুইটার ছেয়ে গিয়েছিল গো-সেবারত সুনকের ছবিতে।
সুনক অধ্যায় থেকে কি পশ্চিমি দুনিয়ার ধনী দেশগুলিতে বর্ণ-সচেতনতার প্রকোপ কমতে আরম্ভ করবে? কথাটি আমেরিকায় চালু হয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গ বারাক ওবামা ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর। অতি-রক্ষণশীল সমাজে তার প্রত্যাঘাত ছিল অবশ্যম্ভাবী। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভ্যুদয়ের সেটি অন্যতম কারণ। সে ধরনের গোঁড়ামি হয়তো আমেরিকায় কমার মুখে। প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতির কপাট খোলার প্রথম লক্ষণ যদি হয় আধা-তামিল কমলা হ্যারিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন, কপাট হয়তো আরও খুলবে যদি ভারতীয় বংশোদ্ভূত রিপাবলিকান নিকি হেলি-কে দেখা যায় ২০২৪ সালে হোয়াইট হাউসের দৌড়ে।
ব্রিটেনে সুনকের প্রধানমন্ত্রিত্ব নিশ্চয়ই সে দেশে প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতির উন্মোচনে এক বিশাল মাইলফলক। এবং ভারতের পক্ষে তা এক সতর্কবার্তা। জন্মসূত্রে ভারতীয় নন, এমন কারও পক্ষে এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া আইনত দুরূহ, এবং রাজনীতির বিচারে অসম্ভব। প্রসঙ্গটি এক বারই উঠেছিল, ২০০৪ সালে সনিয়া গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত করবার প্রস্তাব প্রসঙ্গে। কিন্তু সেই প্রস্তাবের রাজনৈতিক বিরোধিতা ছিল তীব্র, আপত্তি তোলা হয়েছিল আইন দেখিয়ে। পরে সেই আপত্তিটি সুপ্রিম কোর্ট নাকচ করে দেয়। তবে তার এক দশক পরে ভারত আবারও চলতে শুরু করেছে উল্টো পথে। বিশ কোটি মুসলমানের বাসস্থান হওয়া সত্ত্বেও ভারতের বর্তমান শাসক দলের ৩০৩ জন লোকসভা সাংসদের মধ্যে এক জনও সে সম্প্রদায়ের নন। অথচ, ব্রিটিশ সংসদের নিম্নকক্ষে (হাউস অব কমনস) এখন ৬৫ জন অ-শ্বেতাঙ্গ সদস্য, যার মধ্যে আছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যান। ভারতের বর্তমান শাসক দল অবশ্য বিদেশে কী হচ্ছে তা নিয়ে মাথা ঘামায় না, তবে প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে সর্বদা হিন্দুত্বের ধ্বজা উঁচিয়ে রাখলে এক দিন তার যুগপৎ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
তা ছাড়া ঋষি সুনকের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পদপ্রাপ্তির এক পরোক্ষ শুভফল হতে পারে ভারতে। অনেকের বোধোদয় হবে যে, ‘হিন্দু’ হয়ে মানুষের সমর্থন ও প্রশংসা কুড়োতে হলে অন্য সম্প্রদায়ের প্রার্থনাস্থল গুঁড়িয়ে নিজের সম্প্রদায়ের ভগবানের নামে জয়ধ্বনি করার প্রয়োজন নেই। ভাল হিন্দু হওয়ার আরও সুস্থ ও সভ্য বিকল্প আছে, যা উন্নত সমাজের চোখে গ্রহণযোগ্য। আশা করা যায় যে, সেই সঙ্গে বদলাবে ইংল্যান্ডের কিছু কিছু অংশে (বিশেষ করে দক্ষিণে) শ্বেতাঙ্গদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা, যা ত্রিশের দশকের চার্চিল (শুধু ঘৃণা) এবং ভিক্টোরীয় যুগের কিপলিং (হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন)-এর তাচ্ছিল্যের সংমিশ্রণ। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুনক যদি তাঁর যোগ্যতার নিদর্শন দিতে পারেন সব নাগরিকের কাছে, ধনী ও দরিদ্র নির্বিশেষে, তবে তা হয়তো এক নতুন আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি আনবে।
তবে কয়েকটি আশঙ্কার দিকও আছে। ব্রিটেনের রাজনীতি আমূল বদলে গিয়েছে ২০১৬ সালে ‘ব্রেক্সিট’ গণভোটের পর। তখন খুব অল্প ব্যবধানে ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আসার সিদ্ধান্তটি গণভোটে জেতে। সে দেশে চিরকালই এক ধরনের মানুষ ছিলেন, যাঁদের কাছে সার্বভৌমত্ব ও স্বাধিকার অন্য সব প্রয়োজনের চেয়ে অগ্রগণ্য। কিন্তু বিগত দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই মানসিকতার এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটে বিকৃতিও। জাতীয়তাবাদের চেহারা পাল্টে তা হয়ে যায় ব্যক্তিপূজা ও জনমোহনবাদের এক বিষাক্ত সংমিশ্রণ, যার ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০১৬ সালেই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া। নৈতিক অবনমনের একই পঙ্ক্তিতে বসানো উচিত ২০১৪ সালে ভারতের নির্বাচনকেও, যখন ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ গুলিয়ে দিয়ে জিতলেন নরেন্দ্র মোদী।
ব্রিটেনে কোনও অর্থনৈতিক বা সামাজিক প্রয়োজন ছিল না ব্রেক্সিটের। বরং ঘোরতর আশঙ্কা ছিল যে, আনাজ থেকে ফলমূল ও দুগ্ধজাত খাদ্য, মোটরগাড়ি, ওষুধ থেকে যান্ত্রিক সরঞ্জাম, ডাক্তার থেকে রাজমিস্ত্রি— ইউরোপ থেকে এ সব সামগ্রী ও পরিষেবার অভাবে দেশে দেখা দেবে প্রবল মূল্যবৃদ্ধি। হয়েছেও তাই। কোভিডে তার তীব্রতা আরও বেড়েছে।
কিন্তু, তত দিনে বহুপ্রাচীন কনজ়ারভেটিভ পার্টি দখল করে বসে আছেন ব্রেক্সিট-পন্থীরা। ব্রেক্সিট তাস খেলেই বরিস জনসন ২০১৯ নির্বাচনে হলেন প্রধানমন্ত্রী। হয়তো ক্ষমতার মই দেখিয়েই তিনি সঙ্গে আনেন কিছু আফ্রিকা ফেরত ভারতীয়কে—যেমন সুনক, ব্রেভারম্যান ও প্রীতি পটেল। আফ্রিকা থেকে আগত ভারতীয়দের চরিত্র অনেকটা আলাদা হয় সরাসরি আসা অভিবাসীদের থেকে। আফ্রিকা থেকে রাজনৈতিক কারণে বিতাড়িত হয়ে তাঁদের স্বদেশভাবনা গড়ে ওঠে ইংল্যান্ডের যে জেলায় তাঁরা বাস করেছেন, তাকে ঘিরে। ক্রমে তা বিস্তৃত হয় ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের সীমা পর্যন্ত। এ এক প্রাদেশিকতা, যা আন্তর্জাতিক বিশ্ব-ধারণার বিরোধী। সুনক সেই মনোজগতের অন্তর্গত। তাঁরা ব্রেক্সিটপন্থী, কারণ অন্যান্য দেশের সঙ্গে দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে সমাধান তাঁরা পছন্দ করেন না। এ মাসে রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু সম্মেলনেও সুনক হাজির হতে প্রথমে নারাজ ছিলেন।
মনে রাখা উচিত যে, ব্রেক্সিট, কোভিড, ইউক্রেন যুদ্ধ ও তজ্জনিত মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় জনমত টোরিদের পরিত্যাগ করে লেবারের দিকে ঘুরতে আরম্ভ করেছিল। কিন্তু সুনক কিছু ব্যাপারে— যথা, কর হ্রাস বা সরকারি ব্যয়সঙ্কোচ— জনপ্রিয়তার জন্য খয়রাত না করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে সমর্থন আবার কিছুটা ঘুরেছে টোরি সরকারের দিকে।
তবে সুনক সরকারের বৃহত্তর সমস্যা হল তাঁর দল আর নতুন সমর্থক আকর্ষণ করতে পারছে না। ব্রিটেন মূলত এক পরিষেবা-ভিত্তিক অর্থনীতি, যেখানে মোট উৎপাদনে পরিষেবার অনুপাত ৮০ শতাংশের বেশি। তা সম্ভব হয়েছিল ইউরোপ থেকে অপর্যাপ্ত পরিযায়ী কর্মীর চলাচলের জন্য। পড়শি দেশগুলি থেকে মানুষের, ও সেই সঙ্গে পণ্যের, অবাধ চলাচলে ব্রেক্সিট এত বেশি বাধানিষেধ তৈরি করছে যে, দুর্বিষহ হয়ে উঠছে সাধারণ মানুষের জীবন। বিশেষত অভিবাসীরা মনে করেন যে, ব্রেক্সিট সমর্থকেরা অভিবাসন-বিরোধী। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা এখন লেবারের দিকে ঝুঁকছেন। তার পর এসেছেন নতুন প্রজন্মের ভারতীয় অভিবাসীরা, যাঁরা যাত্রা শুরু করেছেন মোদীর ভারত থেকে। তাঁদের ইসলাম-বিদ্বেষ জনসমক্ষে প্রকট হচ্ছে; লেস্টারে সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ তার প্রমাণ।
সুনক দেশকে ‘ইউনাইট’ করতে পারেন কি না, তা-ই হবে তাঁর যোগ্যতার পরীক্ষা। তার জন্য যদি উগ্র জাতীয়তাবাদী ‘ব্রেক্সিটপ্রেমী’ তকমাটি বিসর্জন দিতে হয়, তবে কী আসে যায়?a