কুকথা ও অশালীনতার বান ডেকেছে এই বঙ্গদেশে। মাঠে-ময়দানে, সভা-সমাবেশে এখন শুধুই পরস্পরের উদ্দেশে গালিগালাজ আর হুমকি। শুধুই আস্তিন গোটানোর পালা। শাসক দল ও বিরোধীদের এই ক্ষমতা প্রদর্শনের ঠেলায় গোটা বঙ্গদেশ এই মুহূর্তে যেন কুস্তির আখড়া। আখড়ার চতুর্দিকে আমআদমির ভিড়, বিনা পয়সায় এই আমোদ কি সব সময় মেলে?
কুকথা ও অশালীনতার এই প্রদর্শনী অবশ্য মুদ্রার একটি পিঠ। আর একটি পিঠে হিংসার চোরাস্রোত। আপাতদৃষ্টিতে এই দু’টি দিকের মিল চোখে পড়ে না। কিন্তু, একটু তলিয়ে ভাবলেই দেখা যায়, দু’টি বিষয়ের মধ্যে গভীর যোগাযোগ আছে।
গত ৭ জানুয়ারি নেতাই দিবসে রাজ্যের মন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদা, বিধায়ক দেবনাথ হাঁসদা প্রমুখ নেতাইয়ে সভা করছিলেন। ওই সভার কাছে, ঝিটকার জঙ্গলে পুলিশ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর গাড়ি আটকে দেয়। উত্তেজিত শুভেন্দু গাড়ি থেকে নেমে দেবনাথ হাঁসদা ও বীরবাহা হাঁসদা সম্বন্ধে পুলিশের কাছে যে ভাষায় মন্তব্য করেন, তার পুনরাবৃত্তি অপ্রয়োজনীয়, চাইলে কেউ খুঁজে দেখতে পারেন। প্রশ্ন হল, দুই রাজনীতিক সম্বন্ধে এ-হেন ভাষা প্রয়োগ কি কোনও সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে? পাশাপাশি, রাজ্যের মন্ত্রী অখিল গিরি রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু সম্পর্কে যে অশালীন মন্তব্য করলেন, তাতে তাঁর রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়েও বড়সড় প্রশ্ন ওঠে। তাঁর ওই মন্তব্যের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পর্যন্ত ক্ষমা চাইতে হয়। শুভেন্দু অধিকারী ও অখিল গিরির এ-হেন মন্তব্য নিয়ে রাজ্য বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন, শুভেন্দুবাবু ও অখিলবাবু, কুরুচিকর মন্তব্যের জন্য দু’জনেই সমান ভাবে দায়ী। তাঁর মন্তব্য: “এখন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, কে কত কটু কথা বলতে পারে। এটা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়।”
কাকে ছেড়ে কাকে বাছবেন? ক্ষমতার দম্ভের প্রদর্শনে যে শব্দাবলি ব্যবহৃত হয়, তাকেও তো কুকথাই বলতে হবে। কিছু দিন আগে বিজেপির নবান্ন অভিযানের সময় আহত, কলকাতা পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার দেবজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে দেখতে গিয়ে পুলিশকে বিক্ষোভকারীদের মাথায় গুলি করার কথা বলেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কাঁথিতে ‘অধিকারী গড়’-এ সভা করতে গিয়েও অভিষেকের নানা মন্তব্য নানা সময়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে কাঁথির সভা থেকে ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বলেছিলেন, “এক জন আবার ফেসবুকে পোস্ট করে বলছে, যদি না শোধরাও এই করব, ওই করব! আরে তোর... বাড়ির পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি, যা করার কর। আয়...আয়...আয়! হিম্মত আছে?”
জানা নেই, যাঁদের উদ্দেশে এ কথা বলা, তাঁদের সে হিম্মত আছে কি না। তবে, এটুকু নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, যাঁরা সুস্থ মননের অধিকারী, যাঁরা রাজনীতির মঞ্চে সুস্থ রুচি ও সংস্কৃতির আবহ আনতে চান, তাঁরা নেহাতই সংখ্যালঘু। একশো শতাংশ ইচ্ছা থাকলেও তাঁদের সেই সংস্কৃতি আনার হিম্মত নেই।
কয়েক মাসের মধ্যে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন আসতে চলেছে। তার আগেই নেতাদের বক্তৃতামালায় উত্তেজনার পারদ চড়তে শুরু করেছে। পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হিংসা। ২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটের স্মৃতি অনেকেই ভোলেননি। মনোনয়নপত্র পেশে বিরোধীদের বাধা দিয়ে, পঞ্চায়েতের পর পঞ্চায়েত বিরোধীশূন্য করে দিয়ে, অবাধ হিংসাকে প্রশ্রয় দিয়ে, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘উন্নয়ন’। এ বারেও কি তার পুনরাবৃত্তি হবে?
আতঙ্কের স্রোত কিন্তু ইতিমধ্যেই বইতে শুরু করেছে। কিছু দিন আগেই নৈহাটিতে বোমা বিস্ফোরণে একটি শিশুর মৃত্যু হয়, জখম হয় আর একটি শিশু। মিনাখাঁতেও মারা গিয়েছে একটি শিশু। কাঁকিনাড়া, ভাটপাড়া থেকে বেশ কিছু বোমা উদ্ধার হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপিতে বোমা বিস্ফোরণে দুই কিশোর আহত হয়। পুলিশি তল্লাশিতে কুলপি থেকে মোট ৪৯টি কৌটো বোমা ও কার্তুজ ভর্তি পাইপগান উদ্ধার হয়। মালদহের মানিকচকেও বোমা ফেটে দু’টি শিশু জখম হয়। মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি ও সাগরপাড়া থেকে বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। অন্য কিছু জেলা থেকেও এ ধরনের দুষ্কর্মের খবর আসছে। অভিযোগ উঠছে যে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের অনেক আগে থেকে বোমা-গুলি মজুত রাখার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে।
বস্তুত, নেতা-মন্ত্রীদের নানা অশালীন মন্তব্য ও গালিগালাজের আর একটি দিক হল এই নির্বিচার দুষ্কর্ম। নেতারা হিংসার বাণী ছড়ান, আর তাঁদেরই কারও কারও আশ্রয়ে থাকা দুষ্কৃতীরা বোমা বাঁধে, পাইপগানের সংগ্রহ বাড়ায়। কারণ, এটা একটা বহমান সংস্কৃতি। হিংসার সংস্কৃতি। হিংসার ভাষাই হল: মারের বদলা মার, চোখের বদলা চোখ!
ভারতে গণতন্ত্রের অনুশীলন করা রাজনৈতিক দলগুলো অহিংসায় বিশ্বাস করে, এমন কথা কেউ বলবেন না নিশ্চয়! বস্তুত, যেখানে নীতির অভাব থাকে, তা প্রণয়নে আগ্রহ না থাকে, সেখানে হিংসা আসবেই। কারণ, দলীয় নির্বাচনী ইস্তাহারে নীতির কথা বলাটা যতটা সহজ, তাতে বিশ্বাস রাখাটা ততটাই কঠিন। তাতে বিস্তর অনুশীলন, প্রকৃত শিক্ষা ও সংযমের প্রয়োজন। কুকথা বলে ক্ষমা চাওয়া নয়, প্রয়োজন মর্মে চেতনা আনা। কারও উদ্দেশে কুবাক্যের স্রোত বইয়ে দেওয়া, অথবা প্রকাশ্যেই হুমকি দেওয়া, এর কোনওটাই রাজনৈতিক চেতনার প্রকাশ নয়।
গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, যাঁরা ‘পাবলিক ফিগার’, তাঁদের চারটি ‘ডি’ মেনে চলা উচিত— ‘ডিসিপ্লিন’, ‘ডিগনিটি’, ‘ডেকোরাম’ এবং ‘ডেমোক্র্যাসি’। তিনি কিন্তু সেই চেতনার কথাই বলতে চেয়েছিলেন। মুশকিল হল, চেতনা শব্দটাই যে এখন ফসিল হয়ে গিয়েছে।