একসূত্রে: সোনার কেল্লা-র শুটিং-এ সত্যজিতের কলাকুশলীরা, ১৯৭৪। ছবি: তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সিনেমা তৈরি করে কারা? পুরনো প্রশ্নটা সম্প্রতি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল মাস্টার অংশুমান ছবিটা দেখতে দেখতে। সত্যজিৎ রায়ের গল্পটা যখন প্রকাশিত হয় তখন কমবয়সের চড়া মেজাজে নানা সমালোচনা করে বলেছিলাম যে অন্যান্য দুর্বলতা বাদ দিলেও স্টান্টম্যান চরিত্রের নিটোল, নিশ্ছিদ্র সততা পুরো গল্পটাকে অবাস্তব করে দিয়েছে। সে সব শুনে আমার শিক্ষকস্থানীয় এক অগ্রজ ধীরে ধীরে বলেছিলেন, বছরের পর বছর ছবি বানাতে লেখককে এত রকম কলাকুশলী, সহকারী ও স্টান্টম্যান-সদৃশ কর্মীদের সঙ্গে নিবিড় ভাবে কাজ করতে হয়েছে যে, তাঁর অবচেতনে এই গুণী অথচ অনামী মানুষগুলোর প্রতি একটা গভীর সমবেদনা সৃষ্টি হওয়া খুবই স্বাভাবিক; সেটার ছাপই পড়েছে ‘ক্যাপ্টেন কৃষ্ণন’-এর চরিত্রায়ণে। তাঁর যুক্তি যে মেনে নিয়েছিলাম তা নয়, কিন্তু তখন থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণে যাঁদের শ্রম অপরিহার্য তাঁরা এই শিল্পের ইতিহাসে কেন এত অবহেলিত, সেই প্রশ্নটা মাঝে মাঝেই মনে আসে।
আমরা মুখে যতই বলি না কেন যে ফিল্ম একটা যৌথ শিল্প, কাজের বেলায় কিন্তু আমাদের দৃষ্টি অভিনেতা, পরিচালক, খুব বড়জোর ক্যামেরাম্যান ও শিল্পনির্দেশক ছাড়া আর কারও দিকে পড়ে না। তাও শুধু তথাকথিত ‘আর্ট ফিল্ম’-এর ক্ষেত্রে— সাধারণ বাণিজ্যিক ছবির আলোচনায় অভিনেতা, সঙ্গীত পরিচালক, প্লেব্যাক শিল্পীর তুলনায় অন্য কেউ তেমন পাত্তা পান না। প্রতিটা ছবি, সে শিল্পকীর্তিই হোক বা নিছক বাজারি পণ্য, তৈরি হয় এক বিশাল ‘সেনাবাহিনী’র মিলিত পরিশ্রমে, অথচ মান পান কেবল ‘সেনাপতি’ ও কয়েক জন সহচর। অন্যান্য শিল্পেও সহকারীদের ভাগ্যে (সামান্য পরিমাণ) অর্থ ছাড়া কিছু জোটে না। তবলিয়া ছাড়া দেবব্রত বিশ্বাসের গান একই রকম সুশ্রাব্য; ঋত্বিক ঘটক বা সত্যজিৎ রায় কিন্তু ছবিই করতে পারতেন না এক দল সহযোগী ছাড়া। তাঁদের মতো প্রখ্যাত নির্দেশকের ‘স্যাটেলাইট’দের কারও কারও কপালে শিকে অবশ্য ছেঁড়ে, কিন্তু তেমন উদাহরণ বেশ কম।
সত্যজিতের টিমের কথাই ধরা যাক। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত সহকারী পরিচালক রমেশ (পুনু) সেনের স্মৃতিকথার মতো মনোগ্রাহী বই কমই আছে, ক্যামেরাম্যান সৌম্যেন্দু রায়ের জীবন ও শিল্পকর্ম সম্বন্ধেও আমরা অনেক কিছু জেনেছি অরুণেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, উজ্জ্বল চক্রবর্তী, দেবপ্রিয়া সান্যাল প্রমুখের তথ্যনিষ্ঠ গবেষণায়। এ ছাড়া অতনু চক্রবর্তী, অনিরুদ্ধ ধর ও উজ্জ্বল চক্রবর্তী সত্যজিতের ইউনিটের একাধিক সদস্যের টুকরো স্মৃতিকথার সাহায্যে পথের পাঁচালী থেকে চারুলতা অবধি প্রতিটি ছবির নির্মাণের নানা অজানা কাহিনি উদ্ধার করেছেন, যদিও পরবর্তী ছবিগুলির ক্ষেত্রে তাঁরা আর এ পথ নেননি। সহকারী পরিচালক অমিয় সান্যাল লিখেছেন তাঁর স্মৃতিকথা, ব্যবস্থাপক অনিল চৌধুরী শুনিয়েছেন পথের পাঁচালী ও অপরাজিত-র জন্মবৃত্তান্ত। অন্য কোনও পরিচালকের সহকারীবৃন্দ এর একাংশ মনোযোগও আকর্ষণ করতে পারেননি বটে, কিন্তু যে সব সত্যজিৎ-সহকর্মীর নাম সবাই শুনেছেন, তাঁরাই রয়ে গেছেন প্রায়ান্ধকারে। আলোকচিত্রশিল্পী সুব্রত মিত্রের জীবন ও কাজ সম্বন্ধে আমরা কতটুকু জানি? কিছু কাল আগে কান্তিরঞ্জন দে-র নেওয়া সুব্রতবাবুর শেষ জীবনের দুটো সাক্ষাৎকার পড়ে চমকে উঠেছিলাম, তার পর গবেষক সৌরপ্রভ চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি যে সব তথ্যের সন্ধান পেয়েছেন ও পাচ্ছেন তা দেখে নিয়ত চোখ বিস্ফারিত হচ্ছে। কিন্তু আরও বিস্মিত হই যখন ভাবি যে এ ধরনের প্রয়াস এত দিন কেউ করেননি। অন্য দুই মহারথী বংশী চন্দ্রগুপ্ত ও দুলাল দত্ত সম্বন্ধে চর্চা হয়েছে আরও কম; তাঁদের বিক্ষিপ্ত কয়েকটি সাক্ষাৎকার এবং বংশী চন্দ্রগুপ্ত সম্বন্ধে অরুণকুমার রায়ের একটি পুস্তিকাই আমাদের সম্বল, এবং এগুলির কোনওটাই আবার সহজলভ্যও না। সত্যজিতের ছবিতে এই তিন শিল্পীর অবদানের গুরুত্ব সম্বন্ধে কোথাও কোনও মতদ্বৈধ নেই অথচ তাঁদের কাজ, চিন্তা, আদর্শের খুঁটিনাটি উদ্ধার করার উৎসাহও হয়নি কারও— এ এক আশ্চর্য পরিস্থিতি। এমনকি, যে সন্দীপ রায়ের অগুনতি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় বাংলা প্রচারমাধ্যমের সর্বত্র, সেই সন্দীপ রায়ের তাঁর বাবার ছবিতে সহায়তার অভিজ্ঞতার বিশদ বিবরণ ধরে রাখার কোনও প্রচেষ্টা হয়েছে বলেও জানি না। অন্যান্যের নামটুকুও বিশেষ কেউ শোনেননি, তাই তাঁরা ছবির পরিচয়লিপিতেই শুধু বেঁচে আছেন। যেমন ধরা যাক, শব্দযন্ত্রীদের কথা। বম্বের রাজকমল কলামন্দিরে কাজ সেরে এসে পুনু সেন আক্ষেপ করেছিলেন, “কলকাতায় ওরকম সেটআপ ছিল না। কিন্তু তার মধ্যেও শ্যামসুন্দর ঘোষ কি দুর্গাদাস মিত্ররা যা কাজ করতেন, তুলনা হয় না। ‘গুপী গাইন’-এর মতো ছবি শ্যামসুন্দর কী অনবদ্যই না করেছিলেন। বাংলা ছবির এসব কারিগরদের কথা কতটুকুই বা আলোচনা হয়েছে! কতটুকুই বা লেখা হয়েছে সেই ইতিহাস!”
এ-হেন অবস্থায় স্টান্টম্যানদের ইতিহাস বা তাঁদের কর্মজীবনের বর্ণনার প্রত্যাশা করাটাই বাতুলতা। খুব বেশি হলে জলসাঘর-এর স্টান্টম্যানের ঘোড়ার পিঠ থেকে নিক্ষিপ্ত হওয়ার কাহিনি নিয়ে টিটকারি করা যায়, সে মানুষটার আর কোনও অস্তিত্ব যে থাকতে পারে, তাঁর ব্যক্তিগত অপারগতা ছাড়াও অন্য কোনও কারণে যে তাঁর পতন হয়ে থাকতে পারে, সে সব নিয়ে ভাবার অবকাশ কোথায়? এই কাহিনিটির জনক যিনি, তিনি কিন্তু ভাবতেন। ‘মাস্টার অংশুমান’ সত্যজিতের সেরা গপ্পের তালিকায় স্থান পাক বা না-ই পাক, তার স্টান্টম্যান চরিত্রটির অভিনবত্ব কেউ অস্বীকার করবেন বলে মনে হয় না। ক্যাপ্টেন কৃষ্ণনের একমাত্রিক চরিত্রায়ণ সম্বন্ধে আমার যুবাবয়সের আপত্তি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন না হলেও আমার অগ্রজের মন্তব্যটির গুরুত্ব বেশি। সত্যজিৎ নির্দেশককে ছবির সর্বময় কর্তা মনে করতেন ঠিকই, কিন্তু গুণী সেনাপতির মতোই অধস্তন সৈনিকদের তিনি পুতুল বলে ভাবতেন না, এবং সে জন্যই তাঁরা সর্বস্ব ঢেলে দিতেন তাঁর ছবিতে। সুব্রত মিত্র ব্যতীত তাঁর কোনও সহযোগী সত্যজিতের ব্যবহারে ক্ষুণ্ণ তো হনইনি, তাঁদের অনেকেই মুগ্ধ হয়েছেন তাঁদের কাজের প্রতি পরিচালকের শ্রদ্ধাশীলতায়। ছবির সম্পাদনার ছক মাথায় রেখে শুটিং করতেন সত্যজিৎ, বাড়তি ফুটেজ তুলতেন না, কিন্তু তা সত্ত্বেও দুলাল দত্তের মতামতকে কতটা গুরুত্ব দিতেন তা দুলালবাবু নিজেই বলে গেছেন। অনেক সময় একটা দৃশ্য কয়েক বার তুলে এনে এমনও বলেছেন, “আমি পাঁচটা টেক করেছি, যেটি আপনার ভাল লাগে সেটি রাখবেন।” এক বার কোনও এক ফোটোগ্রাফার সম্পাদনার ছবি তুলতে গিয়ে দুলালবাবুকে বলেন মুভিওলা থেকে সরে যেতে; ছবিতে কেবল সত্যজিৎকেই ধরা হবে কেননা তিনিই প্রকৃত সম্পাদক, দুলালবাবু শুধুমাত্র তাঁর নির্দেশমতো ফিল্ম জোড়াতালি দেবার কাজটুকু করে দেওয়ার জন্য রয়েছেন। এই ‘আদেশ’ শুনে সত্যজিৎ গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চান, সম্পাদনার ছবি তুলতে এসে শুধু পরিচালকের ছবি তোলার যুক্তিটা কী— “আমি কি এডিটর নাকি? এডিটর তো দুলাল!” আজও অনেক তথাকথিত বিশেষজ্ঞ— যেমন অ্যান্ড্রু রবিনসন— ঠিক সেই ফোটোগ্রাফারের মতোই যখন সত্যজিৎকে সর্বশক্তিমান প্রতিপন্ন করতে দুলালবাবু বা অন্যান্য সহকর্মীর ভূমিকা খর্ব করেন, তখন বোঝা যায় আসল সত্যজিতের পরিচয় এখনও তাঁরা পাননি।
জলসাঘর-এর পর সত্যজিৎ নিজের ছবিতে স্টান্টম্যান ব্যবহার হয়তো করেননি, কিন্তু কোনও স্বীকৃতির প্রত্যাশা না করে এই মানুষগুলো কতটা নৈপুণ্য, শারীরিক ক্ষমতা ও সাহসের পরিচয় দেন প্রতি দিন, সেটা যে তাঁকে ভাবিয়েছিল তার প্রমাণ ‘মাস্টার অংশুমান’ গল্পটি। সেই গল্পের ভিত্তিতে বানানো যে ছবিটি দেখে এত সব কথা মনে এল, তাতে এই বিষয়টি চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন চিত্রনাট্যকারদ্বয়, শ্রীপর্ণা মিত্র ও সাগ্নিক চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিতের প্লটের উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন না করে কৃষ্ণনের চরিত্রটি ঘিরে নানা নতুন ঘটনা সাজিয়েছেন তাঁরা, দেখিয়েছেন এ ধরনের কর্মীকে কত তাচ্ছিল্য, অভব্যতা, অপমান মেনে নিতে হয় প্রতি দিন। সোম চট্টোপাধ্যায়ের সাবলীল অভিনয়ে কৃষ্ণন হয়ে উঠেছে চলচ্চিত্রশিল্পের অনামী অবহেলিত কর্মীদের প্রতিনিধি। এটাই মাস্টার অংশুমান ছবির একমাত্র থিম নয়, অধিকাংশ দর্শকের চোখে হয়তো অন্যতম প্রধান থিমও না। এটুকুই বলার, ফিল্ম-জগতের প্রান্তিক কর্মীদের যে পরিচয় এ ছবিতে পাই তা যেমন মর্মস্পর্শী, তার ঐতিহাসিক, সামাজিক ও মানবিক প্রাসঙ্গিকতাও গভীর।