নিয়োগ দুর্নীতির ফলে ছাত্রসমাজও গভীর সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে
Recruitment Scam

শিক্ষকের সৎ ও অসৎ

অবস্থাটা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প ‘গন্ধটা খুব সন্দেহজনক’-এর মতো। সেই গল্পে ভূত আর মানুষকে যেমন আলাদা করে চেনা যেত না, ছাত্ররাও তেমনি ‘সৎ’ এবং ‘অসৎ’ শিক্ষক নিয়ে চরম বিভ্রান্ত।

Advertisement

তূর্য বাইন

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২২ ০৭:২২
Share:

আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সবার উপরে সিনেমাটিতে ছবি বিশ্বাসের বলা সেই হৃদয়-নিংড়ানো হাহাকার ‘ফিরিয়ে দাও আমার সেই বারোটি বছর’ বাঙালি হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে আছে। বাঁকুড়ার সুরজিৎ গোস্বামী কলকাতা হাই কোর্টে দাঁড়িয়ে তেমন কোনও সংলাপ আওড়েছিলেন কি না জানা যায়নি, তবে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে নিজেকে চাকরি পাওয়ার যোগ্য প্রমাণ করতে তাঁর লেগে গেল আটটি বছর। তার চাইতেও বড় কথা, এর জন্যে তাঁকে দু’-দু’বার ছুটতে হল হাই কোর্টে।

Advertisement

অনবধানবশত দু’-একটা ক্ষেত্রে অঙ্কে ভুল হওয়া কিছু অস্বাভাবিক নয়। প্রমাদ সামনে আসার পর স্কুল সার্ভিস কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উভয় ক্ষেত্রে ওই পরীক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বরে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে মেধা তালিকার পুনর্বিন্যাস করতে পারত। অন্তত স্বচ্ছতার স্বার্থে সেটাই কাম্য ছিল।

তবুও তাঁদের মতো যে দু’-এক জন আদালতের হস্তক্ষেপে বিলম্বে হলেও সুবিচার পাচ্ছেন, তাঁদের ভাগ্যবানই বলতে হবে। কিন্তু যে সব চাকরিপ্রার্থী স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগের দাবিতে ঝড়-জল-শৈত্যপ্রবাহ মাথায় নিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচশো দিন খোলা আকাশের নীচে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের জীবনের কত দিন যে এ ভাবে নিষ্ফলা কেটে যাবে, হলফ করে কেউই তা বলতে পারছেন না।

Advertisement

নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী এবং তাঁর বান্ধবীকে গ্রেফতার করার পর ইডি-র জনৈক আধিকারিক মন্তব্য করেছিলেন, পেঁয়াজের খোসা যত ছাড়ানো হবে, ততই নতুন নতুন তথ্য বেরোবে।

তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলতে শুরু করেছে। যত দিন যাচ্ছে, নিয়োগ দুর্নীতি ঘিরে নতুন নতুন তথ্য সামনে আসছে। মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় এক পরীক্ষার্থী তাঁর উত্তরপত্র বিকৃত করার অভিযোগ করেছেন। আদালত অভিযোগ গ্রহণ করে সেই উত্তরপত্রটি ফরেনসিক পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দিয়েছে। সম্প্রতি এমনও অভিযোগ এসেছে যে, চাকরির পরীক্ষায় না বসেও স্রেফ টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন নদিয়ার এক শিক্ষয়িত্রী।

বিপুল অর্থের বিনিময়ে মেধাতালিকায় কারচুপি, যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে অযোগ্যদের নিয়োগ, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে সুবিধাজনক জায়গায় পোস্টিং কিংবা চাকুরিরতদের পছন্দের জায়গায় বদলি এবং তজ্জনিত অভিযোগের ভিত্তিতে আদালতে মামলার পর মামলা হচ্ছে।

কিন্তু সকলেরই তো আর আদালতে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। প্রশ্ন উঠছে, যাঁরা আদালতে যেতে পারেননি, তাঁদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ অবিচার হয়নি তো? এই সন্দেহ শুধু একটি বা দু’টি নিয়োগ সংক্রান্ত পরীক্ষাতেই সীমাবদ্ধ নয়। বিগত কয়েক বছরে এ রাজ্যে এসএসসি, টেট, পিএসসি-সহ যে স্বশাসিত সংস্থাগুলি নানা সরকারি পদে নিয়োগের জন্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নিয়েছে, তার অধিকাংশ ঘিরেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

চাকরিপ্রার্থীদের প্রতি অবিচারের দিকটি বহুচর্চিত হলেও এই সর্বব্যাপী দুর্নীতির ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে যে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তা কিন্তু সহজে নিরাময়ের নয়।

বেশ কিছু দিন আগে সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছিল, বাঁকুড়ার এক প্রাথমিক শিক্ষক বাংলা উচ্চারণ করে পড়তে পারছেন না, পারছেন না সাধারণ যোগ-বিয়োগের অঙ্ক কষতে। অনেকেরই ধারণা, এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নবনিযুক্ত শিক্ষকদের একাংশের জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

রবীন্দ্রনাথ ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, মানুষের উপরে বিশ্বাস হারানো পাপ। শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার ফলে যে বিশ্বাসহীনতার পাপাঙ্কুর ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক-সহ সমাজের সর্ব স্তরের মানুষের মনে রোপিত হল, তা নির্মূল করা প্রায় অসম্ভব। সনাতন ভারতে গুরুর প্রতি শিষ্যের যে শ্রদ্ধা ও আস্থার পরম্পরা ছিল, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে ধারাবাহিক ভাবে শিক্ষার রাজনীতিকরণের ফলে তা ক্রমশ শিথিল হয়েছে। আমাদের রাজ্যে বাম শাসনকালে শিক্ষাঙ্গনে ‘অনিলায়ন’ এক বহুচর্চিত বিষয়। তবু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সেই সময়েও শিক্ষক সমাজের প্রতি এত অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধার মনোভাব তৈরি হয়নি। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, অনেক শিক্ষকই নিজের পেশা-পরিচয় প্রকাশ করতে লজ্জা পাচ্ছেন। কোন আমলে চাকরি হয়েছে, সেটা নিয়ে ঠাট্টা-রসিকতা হজম করতে হচ্ছে অনেক শিক্ষককেই। যাঁরা যোগ্যতার ভিত্তিতে নিযুক্ত হয়েছেন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন, এই পাহাড় পরিমাণ সামাজিক অসম্মান নিশ্চয়ই তাঁদের প্রাপ্য ছিল না। অথচ, তাঁরা জোর গলায় এর প্রতিবাদও করতে পারছেন না। কারণ, টিচার্স রুমে তাঁর পাশে বসে টিফিন ভাগ করে খাওয়া নতুন সহকর্মীটি যে ওই পঙ্কিল পথ মাড়িয়ে শিক্ষাঙ্গনের পবিত্র ভূমিতে পা রাখেননি, তাঁর মনেও এই বিশ্বাসের চারাগাছটি সাম্প্রতিক কালে প্রকটিত দুর্নীতির আবহে শুকিয়ে এসেছে।

এই একই অবিশ্বাস ছাত্রসমাজকেও এক গভীর সঙ্কটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাদের জীবনে এত কাল যাঁরা রোল মডেল ছিলেন, তাঁরাই ওদের চোখে এখন সন্দেহভাজন হয়ে উঠেছেন। তাদের অবস্থাটা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প ‘গন্ধটা খুব সন্দেহজনক’-এর মতো। সেই গল্পে ভূত আর মানুষকে যেমন আলাদা করে চেনা যেত না, ছাত্ররাও তেমনি ‘সৎ’ এবং ‘অসৎ’ শিক্ষক নিয়ে চরম বিভ্রান্ত। এই বিভ্রান্তির পরম্পরা হয়তো আরও বহু বছর ধরে চলবে। শিক্ষাঙ্গনের এই অবিশ্বাসের দূষণ ভবিষ্যতের নাগরিকদের মাধ্যমে যাতে আগামী দিনে গোটা সমাজকে গ্রাস না করে, তার জন্যে নাগরিক সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement