মঞ্চায়ন: বাবাসাহেব আম্বেডকরকে নিয়ে একটি সরকারি অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি, দিল্লি, ২২ ফেব্রুয়ারি। পিটিআই
পাতা ঝরা মরসুমের দিল্লির পথে হালফিলে একটা বিজ্ঞাপন প্রায়ই চোখে পড়ছে। ‘বাবাসাহেব—দ্য গ্র্যান্ড মিউজ়িক্যাল’। আয়োজনে দিল্লি সরকারের পর্যটন উন্নয়ন নিগম। বিজ্ঞাপনে বি আর আম্বেডকর এবং পাশে হাসিমুখে অরবিন্দ কেজরীওয়াল।
মুম্বই-দিল্লির নামী শিল্পীদের নিয়ে প্রতি দিন জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে দু’টি করে শো। মঞ্চে আম্বেডকরের জীবনকাহিনি শুরু হওয়ার আগে পিছনে ডিজিটাল পর্দায় ফের ভেসে ওঠে অরবিন্দ কেজরীওয়ালের ছবি।
দেখেশুনে নরেন্দ্র মোদীর কথা মনে পড়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদী দিল্লির জনপথে আম্বেডকর ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার নির্মাণ করিয়েছেন। দিল্লির এক প্রান্তে, এক সময় যেখানে আম্বেডকর বাস করতেন, সেখানে আম্বেডকর জাতীয় স্মারকের উদ্বোধন করেছেন। সংবিধানের প্রণেতা আম্বেডকর দলিতদের ‘আইকন’ ছিলেন। নরেন্দ্র মোদী তাঁকে আত্মস্থ করে ফেলতে চেয়েছেন। বোঝাতে চেয়েছেন, তিনিই আম্বেডকরের উত্তরসূরি।
অরবিন্দ কেজরীওয়ালও সেই পথে। তিনি শুধু আম্বেডকর নন, একেবারে নরেন্দ্র মোদীকেই আত্মস্থ করে, প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁর উত্তরসূরি হয়ে উঠতে চান। আত্মস্থ করছেন বটে। তবে ভাল-মন্দ দেখে। কেজরীওয়াল নিজের সুবিধেমতো নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়ন ও সুশাসনের বুলি, গরিব মানুষকে নানা সুরাহা, জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, মন্দিরে গিয়ে পুজোআচ্চাটুকু নিজের মধ্যে নিয়ে ফেলছেন। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সরিয়ে রাখছেন বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ব, মুসলিম বিদ্বেষ।
দিল্লির পরে আম আদমি পার্টির পঞ্জাবের ক্ষমতা দখল দেশের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। আম আদমি পার্টি ওরফে আপ নিজেই ঘোষণা করেছে, তাদের প্রধান লক্ষ্য জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের বিকল্প এবং বিজেপির প্রধান চ্যালেঞ্জার হয়ে ওঠা। সে পথে হাঁটতে গিয়ে অরবিন্দ কেজরীওয়াল যে ভাবে নিজেকে সময়ের সঙ্গে বদলে ফেলছেন, তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা প্রধানমন্ত্রী পদের স্বপ্ন দেখা অন্য রাজনীতিবিদদের রক্তচাপ বাড়তে বাধ্য।
অরবিন্দ কেজরীওয়ালের শুরুটা হয়েছিল কংগ্রেস ও বিজেপি দুই দলকেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলে দোষারোপ করে। দিল্লির যন্তর মন্তরে ‘কংগ্রেস বিজেপি ধোঁকা হ্যায়, দেশ বাঁচাও, মওকা হ্যায়’-এর স্লোগান তুলতেন তিনি। অণ্ণা হজারেকে সামনে রেখে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন দ্রুত মনমোহন-সরকার বিরোধী আন্দোলনের চেহারা নিল। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে ফয়দা তুলল বিজেপি। কেজরীওয়াল অবশ্য তার আগেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তাঁকে জন লোকপাল বিল পাশ করাতে দেওয়া হচ্ছে না বলে পদত্যাগও করে ফেলেছেন। তার পরে ২০১৫ ও ২০২০-তে দু’বার বিপুল ভোটে জিতে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন কেজরীওয়াল। দিল্লিতে অবশ্য এখনও লোকপাল তৈরি হয়নি। কেজরীওয়াল তা নিয়ে আর হইচই বাঁধান না। ধর্নায় বসেন না। রাগ করে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন না। দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনের বদলে তাঁর হাতিয়ার এখন সুশাসন। নিখরচায় ‘বিজলি-পানি’। উন্নত মানের সরকারি স্কুল, হাসপাতাল। গরিব মানুষের হাতে নানা রকম সরকারি অর্থ সাহায্য।
কেজরীওয়াল জানেন, শুধু সুশাসন দিয়ে ভোট জেতা যায় না। তিনি আরও ভাল ভাবে জানেন, দিল্লির যে সব ভোটার তাঁকে বিধানসভায় বিপুল ভোটে জিতিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসান, তাঁরাই আবার লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদে জিতিয়ে আনতে বিজেপিকে হইহই করে ভোট দেন। তিনি তাই কড়া মোদী-বিরোধী হতে চান না। কংগ্রেস তাঁকে বিজেপির বি-টিম বললেও তিনি গায়ে মাখেন না।
বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ব ও কংগ্রেসের সংখ্যালঘু তোষণের মাঝামাঝি থেকে, আবার বেশি বাম দিকে না ঝুঁকে, অরবিন্দ কেজরীওয়াল নিজের এক নতুন অবতার তৈরি করেছেন। উন্নয়নবাদী হনুমান-ভক্ত উদারমনস্ক হিন্দুর অবতার। যিনি প্রকাশ্যে পুজোআচ্চা করতে সঙ্কোচ করেন না, আবার ধর্মনিরপেক্ষতার ঠেলায় পড়ে সংখ্যালঘু তোষণেরও ধার ধারেন না। যিনি স্কুল-হাসপাতাল ঢেলে সাজাবেন। আবার ভোটে জিতে হনুমান মন্দিরে গিয়ে পুজো দেবেন। অযোধ্যায় রামলালার পুজো দিয়ে উত্তরপ্রদেশের ভোটের প্রচার শুরু করবেন। দিল্লির বাসিন্দাদের জন্য সরকারি খরচে তীর্থযাত্রার তালিকায় অযোধ্যার রামমন্দিরের নাম জুড়ে দেবেন। তাঁর রাজত্বে সরকারি খরচে আম্বেডকরের লড়াই তুলে ধরা হবে। আবার দীপাবলির সময় সরকারি খরচে রামমন্দিরের আদলে দিল্লির স্টেডিয়ামে মন্দিরও তৈরি হবে। যেখানে সপরিবারে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী পুজোয় বসবেন।
পঞ্জাবে ভোটের প্রচারে জালন্ধরে গিয়েছিলেন কেজরীওয়াল। সঙ্গে ছিলেন ভগবন্ত মান। পঞ্জাবের নতুন মুখ্যমন্ত্রী। ঠিক ছিল, পঞ্জাবের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলবেন কেজরীওয়াল। চাষিরা কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ নিয়ে তাঁর অবস্থান জানতে চাইলেন। কেজরীওয়াল বললেন, এর সঙ্গে চাষিদের সমস্যার কোনও সম্পর্ক নেই। কৃষকরা মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, যে মোদী সরকার ৩৭০ রদ করেছে, তারাই তিন কৃষি আইন এনেছে। কেজরীওয়াল দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। বলেননি, তিনি অনেক আগেই মোদী সরকারের ৩৭০ রদ করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদী ৩৭০ রদ করেন। তিন তালাক নিষিদ্ধ করেন। রামমন্দিরের শিলান্যাস করেন। নয়া নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করেন। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরির কথা বলেন। সবটাই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কর্মসূচি মেনে। প্রতিটি পদক্ষেপে হিন্দুত্ববাদের গন্ধ লেগে থাকে। কেজরীওয়াল ৩৭০ রদের সমর্থন করেন জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে। চিনের অনুপ্রবেশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পাশে দাঁড়ান। রামমন্দিরে পুজো দেন। কিন্তু বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের নামাবলি গায়ে চড়ান না।
হিন্দু উদারমনস্ক হিসাবে নিজেকে তুলে ধরলেও কেজরীওয়াল ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির দায়ে কংগ্রেসের সংখ্যালঘু তোষণের পথ মাড়ান না। সিএএ-এনআরসি’র বিরুদ্ধে দিল্লির শাহিন বাগে প্রতিবাদ হলে কেজরীওয়াল তার সমর্থনে বা বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি। বিজেপি নেতারা সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনকারীদের তোপ দেগেছেন। সেখান থেকেই ২০২০-তে কেজরীওয়াল তৃতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরেই উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক হিংসা হয়েছিল। কিন্তু দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হাত গুটিয়ে বসে থেকেছেন। তিনি মুসলিম তোষণ করেন— এমন কোনও সংশয় দিল্লির ভোটারদের মনে তৈরি হতে দেননি। অরবিন্দ কেজরীওয়াল ধর্মে থাকেন। জিরাফে থাকেন না। তিনি বামে নেই। উদারমনস্কতায় রয়েছেন।
বিজেপির প্রধান চ্যালেঞ্জার ও কংগ্রেসের বিকল্প হয়ে উঠতে গেলে অরবিন্দ কেজরীওয়ালকে পঞ্জাবেও দিল্লির মতো সুশাসনের মডেল খাড়া করতে হবে। শহরকেন্দ্রিক দিল্লি ও গ্রামীণ অর্থনীতির পঞ্জাবের চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। জনসঙ্ঘের আমল থেকে হিন্দুত্ববাদী অবস্থানের জন্য বিজেপি পঞ্জাবের শিখদের মনে জায়গা পায়নি। কংগ্রেস, অকালি দলের থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষ আপ-কে ভোট দিয়েছে। দুর্নীতি, চাষ থেকে কমতে থাকা আয়, ড্রাগের সমস্যা, সরকারি কোষাগারে টানাটানির পঞ্জাবে আম আদমি পার্টি সত্যি কিছু করে দেখাতে পারছে কি না, তার উপর নির্ভর করছে কেজরীওয়ালের অশ্বমেধের ঘোড়া আর কত দৌড়বে?
কেজরীওয়ালের পরের গন্তব্য গুজরাত। বছরের শেষে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের রাজ্যে ভোট। কেজরীওয়ালের লক্ষ্য, সবরমতীর তীরে ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেসের স্থান দখল এবং নরেন্দ্র মোদীকে ঘরের মাঠে তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানানো। নরেন্দ্র মোদী ‘গুজরাত মডেল’ দেখিয়ে দিল্লির মসনদ দখল করেছিলেন। কেজরীওয়াল ‘দিল্লি মডেল’ দেখিয়ে গুজরাতের মন জয় করতে চাইবেন। মোদীর অস্ত্রেই মোদীর চ্যালেঞ্জার হয়ে ওঠার এ-হেন চেষ্টা আগে কেউ করেননি।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দিল্লি থেকে বারাণসী গিয়ে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলেন অরবিন্দ কেজরীওয়াল। তাঁর চোখে হয়তো দিন বদলের স্বপ্ন ছিল। এখন তাঁর চোখে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার স্বপ্ন স্পষ্ট। নরেন্দ্র মোদীর দুর্ভাবনা পরের প্রশ্ন। কেজরীওয়াল তার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কে চন্দ্রশেখর রাওদের দুর্ভাবনায় ফেলে দিচ্ছেন।