প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।
রাজা-মহারাজারা কি দেবতা ছিলেন? বা দেবতার অংশ? দেবতাদের বংশধর? নিদেনপক্ষে তাঁদের প্রিয়জন? সব রাজাই মনে করেছেন, তিনি দেবত্বের অধিকারী। সম্রাট অশোক মনে করতেন, তিনি দেবতাদের প্রিয়। শিলালিপিতে তাঁর দু’টি নাম পাওয়া যায়— ‘প্রিয়দর্শী’ এবং ‘দেবনামপ্রিয়’। প্রথম নামটি কাজে লেগেছিল ইন্দিরা গান্ধীর। দ্বিতীয় নামটি স্বচ্ছন্দে কাজে লাগাতে পারেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কারণ, তিনিও দেবতাদের বিশেষ প্রিয় হয়ে উঠেছেন। তবে তিনি এ নাম কাজে লাগাবেন না দু’টি কারণে। প্রথমত অশোক ছিলেন ব্রাহ্মণতন্ত্রের বিরোধী। তিনি নিজেও বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আরও সমস্যা। তিনি শুধু দেবতাদের নন, জওহরলাল নেহরুরও প্রিয় ছিলেন। অশোকচক্র আমাদের জাতীয় পতাকায় স্থান পেয়েছে। তার একটা বড় কারণ ছিলেন নেহরু।
কিন্তু রাজা-মহারাজাদের ভালবেসেছেন বলে কি দেবতারা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকেও ভালবাসতে পারেন? কেন পারবেন না! আমাদের ধর্মে যদিও সনাতন দেবতারা পরিবর্তনশীল। তাঁরা আজকের পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। আর প্রধানমন্ত্রীরাও তো পরিবর্তনশীল। খুব কাছ থেকে না দেখলে পার্থক্য বোঝা যায় কি? তবে একটা শর্ত তাঁদের মানতে হয়। ইংল্যান্ডে যখন রাজা প্রমাণ করলেন তিনি দেবতার দূত, তখন তাঁর উপর পার্লামেন্টের আর নিয়ন্ত্রণ রইল না। আমাদের স্মরণে আছে যে, মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রথম বার লোকসভায় ঢুকেছিলেন সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে। সংসদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে। কোনও দেবপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী কি সংসদের নিয়ন্ত্রণাধীন হতে পারেন? আমাদের সৌভাগ্য যে, এটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি। কারণ, সংসদও অত্যন্ত নমনীয় ভাব দেখিয়েছে।
২০১৪ সালেই কিন্তু মোদী আমাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ঈশ্বর তাঁকেই নির্বাচন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কঠিন দায়িত্ব পালন করবার জন্য। ভারতবাসীর কাছে তাঁর অনুরোধ ছিল, ঈশ্বরের এই ইচ্ছাকেই মান্যতা দিতে। প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি চাইলেন, প্রশাসনের খোলনলচে পালটে দিতে। প্রথমে এল নোটবন্দি। দেশের গরিব মানুষের অযথা হয়রানি হল। কাজের কাজ কিছুই হল না। কোথাও কোনও কালো টাকা উদ্ধার হল না। তার পর এল ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’। এর দ্বিতীয় সংস্করণ ‘আত্মনির্ভর ভারত’। অর্থনীতিতে কোনও পরিবর্তন আনতে দু’টি প্রকল্পই ব্যর্থ হয়। তার পর এল জিএসটি। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ছোট ব্যবসায়ীদের বিপদে ফেলা হল তাতে।
আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ মোদী নিশ্চয়ই ভেবেছেন সব উদ্যোগই সফল। কোথাও কিন্তু তাঁকে এই সাফল্যের জন্য দেবতাদের ধন্যবাদ দিতে দেখা যায়নি। ইদানীং আবার তাঁর মুখে শোনা যাচ্ছে দেবতাদের কথা। নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনে এ কথাই বললেন মোদী। অনুরূপ কথা শোনা গেল যখন মহিলাদের জন্য লোকসভার আসন সংরক্ষণের বিল পাশ হল। আবার আমরা সে কথা শুনলাম অযোধ্যায় রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানে। তিনটি ক্ষেত্রেই খুঁজলে পাওয়া যায় দেবতাদের আরাধনার কারণ।
সংসদের প্রধান প্রধানমন্ত্রী নন। শীর্ষে রাষ্ট্রপতি। নতুন ভবনের উদ্বোধনে তাঁরই পৌরোহিত্য করার কথা। দেশের সাংবিধানিক প্রধানের প্রতি মোদীর সৌজন্যের অভাব কারও নজর এড়ায়নি। শিক্ষিত মানুষমাত্রেই এর সমালোচনা করেছেন। এই পরিস্থিতিতে দোষটা দেবতাদের উপর চাপিয়ে দেওয়াটা মন্দ হয়নি। অযোধ্যার মন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার সমালোচনা কম হয়নি। চার জন শঙ্করাচার্য সমবেত হয়ে বলেছেন, মন্দিরের নির্মাণ শেষ না হলে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয় না। সেই উপদেশ যতই শাস্ত্রসম্মত হোক না কেন, অনুষ্ঠান নির্বাচনের আগে সম্পন্ন করতেই হত। মোদী সে আপত্তিতে কান দেননি। মহিলাদের আসন সংরক্ষণের ব্যাপারে সমালোচনা আরও ব্যাপক হয়েছে। কারণ, ঘোষণা করা হলেও এ সিদ্ধান্ত কবে কার্যকর করা যাবে তাঁর কোনও নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু নির্বাচনে তো লাভার্থী হবেন উনিই!
তিনটি ক্ষেত্রেই বলা চলে দেবতাদের স্মরণ করা যুক্তিযুক্ত হয়েছে। সমালোচনা ঠেকাতে সেটাই শ্রেষ্ঠ উপায়। আর কী কারণ থাকতে পারে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করার? মোদী কি নির্বাচন নিয়ে উদ্বিগ্ন? যত দূর বোঝা যাচ্ছে, প্রাক্-নির্বাচনী মুহূর্তে মোদী খুব একটা চাপে নেই। বলতে পারেন মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে নেই। কর্মসংস্থান হচ্ছে না। অন্য দিকে, এ কথা পরিষ্কার যে, বিরোধীরা জোট বাঁধতে পারবে না। তা হলে ঘন ঘন ভগবানের নাম কেন? ছোটবেলায় শোনা গল্প মনে পড়ল। ভগবান নারায়ণ এক দিন তাঁর ভক্তের হাতে একটি জলভরা পাত্র দিয়ে এমন ভাবে হাঁটতে বললেন যে, এক ফোঁটা জলও যেন চলকে না যায়। হাঁটা শেষ হলে তিনি ভক্তের কাছে জানতে চাইলেন, সে কত বার তাঁর নাম নিয়েছে? দেখা গেল, সে জল সামলাতে এত ব্যস্ত ছিল যে, নারায়ণ নারায়ণ বলার সময় পায়নি। কাজের চ্যালেঞ্জ কম থাকলেই কি ভগবানের নাম মুখে আসে বেশি?
প্রাচীন হিন্দু রাজারা ছিলেন শ্রীরামচন্দ্রের মতো সূর্যবংশীয়। অথবা শ্রীকৃষ্ণের মতো চন্দ্রবংশীয়। মোদী অযোধ্যায় সুবিশাল রামমন্দির নির্মাণ করিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণের জন্য কিছু করবেন না? এ প্রশ্নে আমি যখন জর্জরিত, তখনই দেখি, সৌম্যকান্তি মোদী উঠে এলেন গভীর সমুদ্র থেকে। কংস নিধনের পরে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর রাজধানী নিয়ে গিয়েছিলেন দ্বারকায়। শ্রীকৃষ্ণের তিরোধানের পর সেই বড় বড় তোরণ এবং ভবনে সুসজ্জিত নগরকে গ্রাস করে সমুদ্র। মোদী সেই নিমজ্জিত দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের পুজো করে ভগবানকে একটি ময়ূরের পালক উপহার দেন। এক দিন আমরা সেখানে নিশ্চয়ই দেখব, জলের নীচে শ্রীকৃষ্ণের বিশাল মন্দির!
কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বলেছেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রজাদের বুঝিয়ে দেওয়া দরকার, মহারাজ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। পুজোর সময় তিনি দীর্ঘ ক্ষণ দেবতার সঙ্গে কথোপকথন চালান। অনুচর আড়াল থেকে তাঁর কথার উত্তর দেবে। সাঁতার জানা মহিলা এজেন্টকে নাগকন্যা সাজানো যেতে পারে। মহারাজ জলের উপর হাঁটতে স্বচ্ছন্দ দেখাতে একটা ভেলা ব্যবহার করা যেতে পারে। জলে আগুন লাগাবার সরঞ্জামও তৈরি রাখা দরকার। এ কথা পড়ে ভাবলাম, তথ্যের অধিকার আইনে খবর নিই, জলের নীচের ছবিগুলি কোন স্টুডিয়োয় তোলা হয়েছিল? সাহস পেলাম না।
(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)