Adani Group Crisis

আদানির মতো শিল্পপতি না থাকলে আমরা পারব পাঁচ ট্রিলিয়নে পৌঁছতে?

আমার কিন্তু মনে হয় না, এফপিও বিভ্রাটের জন্য ‘শর্ট সেলিং’ দায়ী। হিন্ডেনবার্গের নাম ভারতে ক’জন শুনেছে? রিপোর্ট কি গুজরাতি বা মরাঠিতে অনূদিত হয়েছে?

Advertisement

অর্ধেন্দু সেন

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:১৪
Share:

আদানির মতো শিল্পপতি না থাকলে আমরা পারব পাঁচ ট্রিলিয়নে পৌঁছতে? এখন মোদী থেকে মমতা, মমতা থেকে বিজয়ন— কারও মনে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।   গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আমাদের ছোটবেলায় হোয়াটস্‌অ্যাপ ছিল না। তাই যথাসাধ্য চেষ্টার পরেও ছোটবড় ফাঁক থেকে গিয়েছে শিক্ষায়। প্রাচীন ভারতে কী ভাবে পারদের ইঞ্জিন (বা ‘ডবল ইঞ্জিন’) ব্যবহার করে মাধ্যাকর্ষণের শক্তিকে অতিক্রম করা হত, তা-ও জানলাম এই সে দিন। আমরা হাল্কা জ্বালানির খোঁজে হাইড্রোজেনে পৌঁছেছি। ওঁরা ঠিক কী কারণে ভারী জ্বালানি বেছে নিয়েছিলেন, তা হয়তো কোনও দিনই জানা যাবে না। তবে এটুকু জানলাম যে, ওদের ‘বিমান’ তখন পাড়ি দিত গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। তার পর বহু যুগ কেটেছে। পৃথিবী উন্নত হয়েছে। বাসযোগ্য হয়েছে। ভিন্‌গ্রহে যাওয়ার তাগিদ কমেছে। শূন্যে ভেসে থাকার বিদ্যাটা কিন্তু আমরা ভুলিনি। আমার শেয়ারের মূল্য হওয়া উচিত ১৫ টাকা। কিন্তু তা কেনাবেচা হচ্ছে ১০০ টাকায়। আমার ভ্রুক্ষেপ নেই। বাজার পড়ে যাবে? বাঁচাবার লোক আছে।

Advertisement

‘হিন্ডেনবার্গ’ নামটা কোথায় শুনেছেন মনে আছে? চ্যান্সেলর ফন হিন্ডেনবুর্গের নামটা মনে না থাকলেও তার পাকানো গোঁফটা নিশ্চয়ই মনে আছে। আর একটা ঘটনা মনে আছে কি না জানি না। জার্মানরা তাঁর নামে একটা উড়োজাহাজ তৈরি করে। উড়োজাহাজ না বলে বেলুন বলাই ভাল। ১৯৩৭ সালে সেটা আমেরিকায় ভেঙে পড়ে। ৩৬ জনের মৃত্যু হয়। ভেসে থাকার ব্যাপারটা সবাই আয়ত্ত করতে পারে না। ওই নামে এক সংস্থা এখন লেগেছে অন্যের বেলুন ফুটো করার কাজে। যাকে ইংরেজিতে বলে ‘শর্ট সেলিং’।

ধরুন বাজারে আমার শেয়ারের দাম ১০০ টাকা। আমি প্রচুর শেয়ার বিক্রি করলাম ৮০ টাকায়। বাজার শঙ্কিত হল। অন্যেরাও বেচতে শুরু করল। দাম নেমে গেল ৬০ টাকায়। ৮০ টাকায় যতগুলো বিক্রি করেছিলাম, এ বার ৬০ টাকায় ততগুলোই কিনে নিলাম। সব সময়ে যে আগে কিনে পরে বিক্রি করতে হবে তা তো নয়। ‘শর্ট সেলার’ এই ভাবে লাভ করে। শেয়ারের দাম কিন্তু পড়া চাই। না হলে ‘নো প্রফিট’। তাই এদের কারও কারও সঙ্গে থাকে রিসার্চের টিম। তারা যে সব কোম্পানিকে ‘টার্গেট’ করে, তাদের হাঁড়ির খবর রাখে। মওকা বুঝে এমন কিছু তথ্য প্রকাশ করে দেয় যে, কোম্পানির হাতে হ্যারিকেন! গত ২৪ জানুয়ারি হিন্ডেনবার্গ আদানি গ্রুপের উপর তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে। সাত দিনে দেখা গেল শেয়ারের মোট মূল্য থেকে দশ হাজার কোটি ডলার উধাও!

Advertisement

আমাদের দেশে খুব সম্ভব এই প্রথম হানা দিল ‘শর্ট সেলার’। গৌতম আদানির উচিত ছিল, প্রক্রিয়াটা আমাদের বুঝিয়ে বলা। তার বদলে তিনি ৪০০ পাতার এক দীর্ঘ বিবৃতিতে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন, তিনি যদিও তাঁর এয়ারকন্ডিশন্‌ড ঠাকুরঘরেই আছেন, কিন্তু কলা তিনি খাননি। সেই সঙ্গে এ কথাও মনে করিয়ে দিলেন যে, ভারতবর্ষকে অত সহজে দমানো যাবে না। ফল হল প্রত্যাশিত। সাধারণ মানুষ বুঝল, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। বিদগ্ধ মানুষ প্রশ্ন তুললেন কে এই হিন্ডেনবার্গ? কী চায় সে? ওদের পিছনে কারা? আমেরিকার ‘ডিপ-স্টেট’ না জিনপিং-এর চিন? আপত্তি কি শুধু আদানিকে নিয়ে না ভারতের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতি নিয়ে?

উদ্দেশ্য কি শেয়ার ক্রেতাদের সুরক্ষা না জি-২০র সভাপতিত্ব কলঙ্কিত করা? ভারতের উন্নতি কাদের চিন্তার কারণ, তা কি কারও অজানা আছে? ধরুন মেনেই নিলাম, অভিযোগ কিছু অংশে সত্যি। আমেরিকা, ইউরোপের পুঁজিপতিরা কি সব ধোয়া তুলসীপাতা? যত আইন সব কি আমাদের জন্য? আদানির মতো শিল্পপতি না থাকলে আমরা পারব পাঁচ ট্রিলিয়নে পৌঁছতে? এখন মোদী থেকে মমতা, মমতা থেকে বিজয়ন— কারও মনে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

মজার কথা হল, একই আপত্তি উঠেছিল এক অন্য প্রসঙ্গে। আমরা যখন জেএনইউ–এ, সেখানে তখনও তুমুল তর্ক চলছে— ট্রটস্কির স্থায়ী বিপ্লব না স্তালিনের ‘এক দেশে সমাজতন্ত্র’? আমাদের মনে হত, স্তালিন ছিলেন অত্যন্ত স্বার্থপর। অন্য দেশের মানুষ সমাজতন্ত্রের সুফল থেকে বঞ্চিত হবে? এ কেমন কথা! যুগ পাল্টাল। রাশিয়ার লোক বলল, ঠিক আছে এক দেশেই হোক সমাজতন্ত্র। কিন্তু আমাদের দেশে কেন বাবা? অন্যেরা ধনতন্ত্রে ফুর্তি করবে আর আমরা সমাজতন্ত্র করব? এখন কোনও ভারতীয় চায় না, নেহরুর আমলের কিছু কানুন মেনে আমরা দেশের উন্নয়ন ব্যাহত করি। আমাদের ‘সুপার পাওয়ার’ হতে হবে না?

এ তো গেল ফলিত জাতীয়তাবাদের কথা। এ বার মূল বিতর্কে আসা যাক। আমাদের পকেটে যে হেতু বেশি পয়সা নেই, আমরা তাই এ ধরনের বিতর্কে নিরপেক্ষ থাকতে পারি। দেখা যাক কোন পক্ষ কী বলছে। হিন্ডেনবার্গের বক্তব্য, আদানিরা তাদের কোম্পানির শেয়ারের মূল্য বাড়াতে কারচুপি করেছে। আমাদের দেশে পাবলিক কোম্পানিতে প্রোমোটারের শেয়ার ৭৫ শতাংশের বেশি হতে পারে না। মনে করা হয়, স্বচ্ছ গভর্ন্যান্সের জন্য এই সীমা জরুরি। বাকি শেয়ার কাদের হাতে তা আমাদের জানানো কোম্পানির কর্তব্য। হিন্ডেনবার্গের একটা বড় অভিযোগ, আদানিরা এই কর্তব্য পালন করেনি। পরিবারের সদস্যেরা বিদেশে অজস্র শেল কোম্পানি খুলেছে। আদানিদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা ছাড়া এদের অন্য কাজ নেই। এই কোম্পানিগুলি মরিশাস, ক্যারিবিয়ানের মতো ‘ট্যাক্স হেভেন’-এ পঞ্জিকৃত, তাই এদের মালিকানা সম্বন্ধে তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এই বিষয়ে লোকসভায় প্রশ্ন উঠেছে। সেবি বলেছে, ‘চোপ! অনুসন্ধান চলছে।’

হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ শুধু সেবি নয়, অর্থ মন্ত্রক, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক— কেউই আদানিদের শাসন করার চেষ্টা করেনি। গৌতম আদানি বিবৃতি দিয়ে বললেন, হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ ভিত্তিহীন। এ অভিযোগ আগেও হয়েছে। বিভিন্ন ফোরামে তার নিষ্পত্তিও হয়েছে। নতুন করে কিছু বলার নেই। আগাগোড়া ইংরেজিতে লেখা এই বিবৃতির পরে সাধারণত কিছু করার থাকে না। এ ক্ষেত্রে কিন্তু দেখা গেল সমূহ বিপদ! কোথায় ‘পাঠান’ বয়কট করবে, তা নয়! দেখা গেল খুচরো ক্রেতা আদানির এফপিও বয়কট করেছে। দেশের সম্মান রাখতে এগিয়ে এল স্টেট ব্যাঙ্ক, এলআইসি, বিশিষ্ট শিল্পপতিরা, এমনকি, অম্বানীরাও। কিন্তু তত ক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। আদানি বাধ্য হলেন, এফপিও বাতিল করে টাকা ফিরিয়ে দিতে। সাধারণ নির্বাচনে কেন খুচরো ভোটদাতার হাতে এই ক্ষমতা থাকে না? সেখানে কেন নাগরিক পিছিয়ে থাকে? দলগুলি থাকে এগিয়ে?

কত টাকার শেয়ার কেনে খুচরো ক্রেতা? যৎসামান্য। তা হলে কেন শেয়ার ‘রিজার্ভ’ করে রাখা হয় তার জন্য? অম্বানীর শেয়ার হোল্ডারের সংখ্যা তিরিশ লক্ষ। আদানির মাত্র দু’লক্ষ। এমতাবস্থায় ‘আদানিই ভারত’ বলাটা হাস্যকর। কিন্তু যে দিন এই সংখ্যা দু’কোটি হবে? অন্য দিকে, কয়েক লক্ষ মানুষের আশাআকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন মিলিয়ে দিতে পারলে ‘ন্যারেটিভ’ তৈরি করা সহজ হয় বৈকি! লক্ষাধিক লোক একসঙ্গে রাস্তায় নেমে ঘণ্টা বাজালে তো কথাই নেই। একসঙ্গে ব্রিফকেস নিতে এজিএম-এ এলেই বা কম কি? অনেকে ভাবেন, ওঁর বিমানগুলি আরামদায়ক বলে মোদী গৌতম আদানিকে পছন্দ করেন। তা নয়। ভারতের উন্নয়নে দু’জনেই নিবেদিতপ্রাণ।

আমার কিন্তু মনে হয় না, এফপিও বিভ্রাটের জন্য ‘শর্ট সেলিং’ দায়ী। হিন্ডেনবার্গের নাম ভারতে ক’জন শুনেছে? রিপোর্ট কি গুজরাতি বা মরাঠিতে অনূদিত হয়েছে? বাজারে যখন শেয়ার কম দামে পাওয়া যাচ্ছে, তখন সাধারণ ক্রেতা বেশি মূল্য দিয়ে এফপিও কিনতে চাননি। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুবে আছি বলে ধরেই নিয়েছি যে, ইন্ডিয়া স্টোরির বিরোধিতা নিষ্ফল হতে বাধ্য। প্রকৃত পরিস্থিতি হয়তো সে রকম নয়। সাধারণ মানুষ হয়তো এখনও হাল ছেড়ে দেয়নি। অবশ্য এ কথাও ঠিক যে, বিদেশিদের আক্রমণ থেকে দেশকে বাঁচানো জরুরি। আচ্ছা, বিবিসির তথ্যচিত্রটির মতো ‘শর্ট সেলিং’-কেও ‘নিষিদ্ধ’ করা যায় না?

(লেখক পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement