‘ফায়ার’-এর চিত্রনাট্যে সমকামকে ‘বিকল্প’ যৌনতা হিসেবে দেখানো হয়েছিল। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
একটি মিছিল আসছে। বিয়ের বরযাত্রীদের মিছিল। বিয়েটি আর পাঁচটা বিয়ের মতো নয়। দুই সমকামী মানুষ বিয়ে করছেন। আর তাতে নিমন্ত্রিতরা আসছেন রীতিমতো ব্যান্ড বাজিয়ে, রামধনু রঙের পতাকা নাচিয়ে এবং মুখোশ পরে।
এমন বিয়েতে সামাজিক (কখনও রাজনৈতিকও) গোলযোগের আশঙ্কা থাকে।সে কারণে পুলিশও মোতায়েন। কর্তব্যরত এক পুলিশ আধিকারিক একদৃষ্টে দেখছে বরযাত্রীদের। তাদের মধ্যে এক অত্যুৎসাহী মুখোশধারী জড়িয়ে পড়ে সমবেত জনতার সঙ্গে বিতণ্ডায়। মাতাল ভেবে পুলিশ আধিকারিক তাকে ডেকে পাঠায়। জানতে চায়, রামধনু-মুখোশের অন্তুরালে কি সে তার পরিচয় লুকোতে চাইছে, সে কি লজ্জিত নিজের যৌন পরিচয়ের কারণে? এক টানে মুখোশ খুলে ফেলে সেই যুবক। লহমায় বুঝে নেয়, তাকে ডেকে পাঠানো পুলিশ আধিকারিকটিও সমকামী।
প্রসঙ্গত, সেই পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গে তার আগের প্রেমিকের পরিচয়ও হয়েছিল রাস্তায় মদ্যপ গাড়িচালকদের ধড়পাকড়ের কাজের সুবাদে। সে বার আধিকারিকের পরীক্ষাযন্ত্রটি খারাপ হয়ে যাওয়ায় সে ছেলেটিকে তার হাতে ফুঁ (হিন্দিতে ‘ফুঁক’)দিতে বলেছিল। কিন্তু ছেলেটি আধিকারিকের হাতে থুতু (হিন্দিতে ‘থুক’) দিয়ে বসে!
সে প্রেম বেশি দিন টেকেনি। আধিকারিকের তরুণ প্রেমিক অন্য সঙ্গীর কাছে চলে যায়। কিন্তু মিছিল থেকে ডেকে পাঠানো পুরুষটিকে যখন পুলিশ আধিকারিক তার হাতে ফুঁ দিতে বলে, তখন সেই মানুষটি ছুড়ে দেয় দীর্ঘ এক প্রশ্বাস। শুরু হয় ‘আরেকটি’ বা ‘অন্য একটি’ প্রেমের গল্প।
উপরে বর্ণিত দৃশ্যটি ২০২২ সালের বলিউডি ছবি ‘বধাই দো’-র। এক সমকামী যুবক আর এক সমকামী যুবতী নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে বিয়ে করে এই শর্তে যে, তারা যে যার ইচ্ছেমতো সঙ্গীর সঙ্গে যৌনজীবন যাপন করতে পারবে। একই বাড়িতে থেকেও। দু’জনে নেহাতই মধ্যবিত্ত পরিবারের।যেখানে ‘সমকাম’ শব্দটিই ঘেঁটে দিতে পারে যাবতীয় স্থিতি। সন ২০২২। কিন্তু এখনও যে ভারতের আম পরিসরে ‘সমকাম’ এক পরিত্যাজ্য বিষয়, সে কথা এই ছবি নতুন করে বলল। ‘নতুন করে’ এ কারণেই যে, নব্বইয়ের দশক থেকেই বলিউড চেষ্টা করতে শুরু করেছিল সমকাম নিয়ে মুখ খোলার। আর তা নিয়ে জলঘোলাও হয়েছিল সমান তালে।
২০২২ সালের বলিউডি ছবি ‘বধাই দো’।
১৯৯৬ সালে মুক্তি পায় হিন্দি ছবি ‘ফায়ার’। পরিচালক দীপা মেহতা। সে অর্থে এটি বলিউডি ছবি না হলেওছবিটির নির্মাণ বলিউড-ঘরানার। শাবানা আজমি ও নন্দিতা দাস অভিনীত চরিত্র দু’টি বিবাহিত, অথচ স্বামীসঙ্গ বঞ্চিত। তাই তারা কাছাকাছি আসে। মানসিক নৈকট্য গড়ায় শরীরী প্রেমের দিকে। এক সময়ে জানাজানি হয়ে যায় তাদের সমকামী সম্পর্কের কথা। বিগত ‘সংসার’-কে আগুনে স্তম্ভিত করে রেখে দুই চরিত্র পা বাড়ায় অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে, যেখানে সামাজিক অনুশাসন তাদের বেঁধে রাখতে পারবে না।
কিন্তু ‘বধাই দো’ এক নিশ্চিত পরিসমাপ্তির কথা বলে। সামাজিক অনুশাসনের নীচে জেগে ওঠে দ্রোহের অনুচ্চার রূপ। ১৯৯৬ থেকে ২০২২ কালপর্বে ‘এলজিবিটি’ বা ‘গে’, ‘লেসবিয়ান’, ‘ট্রান্সজেন্ডার’— এই সব শব্দ মধ্যবিত্ত ভারতীয়ের ঘরোয়া পরিসরে আর ততখানি রক্তচক্ষুর পরোয়া করে না ঠিকই। তবু কোথায় যেন কইতে কথা বাধে। সেই কণ্ঠনালিতে আটকে থাকা কথাগুলিই যেন বলতে চেয়েছে রাজকুমার রাও-ভূমি পেডনেকর অভিনীত এই ছবি।
অনেকে বলেন, ‘ফায়ার’-এর চিত্রনাট্যে সমকামকে ‘বিকল্প’ যৌনতা হিসেবে দেখানো হয়েছিল। অথচ সমকাম যে আর পাঁচটা কামনার মতোই স্বাভাবিক ও সহজাত, তা ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো তাঁর ‘দ্য হিস্ট্রি অব সেক্সুয়ালিটি’ (১৯৭৬) গ্রন্থের প্রথম পর্বে দেখিয়েছেন। ১৯ শতকে ভিক্টোরীয় নৈতিকতা সন্তানজন্মের উদ্দেশ্যরহিত যাবতীয় যৌনচেতনাকেই বর্জনীয় ও নিন্দনীয় বলে বর্ণনা করে। ফলে সমকামের মতো বিষয় চাপা পড়ে যায় নারী-পুরুষের প্রেমের মাহাত্ম্য কীর্তনের তলায়।
বাংলা সিনেমাকে প্রাপ্তবয়স্ক করেছিলেন ঋতুপর্ণ।
নব্বইয়ের দশকের আগে বলিউডি ছবিতে তথাকথিত অন্য যৌনতার বিষয়গুলিকে কখনও রাখা হত কমিক রিলিফ হিসেবে কখনও নেতিবাচক রঙে। রূপান্তরকামী বা ‘হিজড়ে’-র দল নাচাগানা করছে (‘অমর আকবর অ্যান্টনি’, ১৯৭৭) বা ক্রূর ভিলেনের ভূমিকায় (‘সড়ক’, ১৯৯১) অবতীর্ণ হচ্ছে দেখা গেলেও তাদের মূল চরিত্রে দেখা যায়নি। এর পিছনে কাজ করেছে দফা ৩৭৭ এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক নৈতিকতার সক্রিয় ভূমিকা। যে আইন এখন বিলুপ্ত।
মধ্যবিত্ত ভারতীয়ের ঘরে সমকাম বা রূপান্তরকামিতা কী প্রকার আপ্যায়ন পেতে পারে বা তথাকথিত স্বাভাবিক যৌন আত্মপরিচয়ের বাইরে বেরিয়ে আসতে গেলে কী ধরনের অস্থিরতার জন্ম হয়, তা রয়েছে ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত বাংলা ছবি ‘চিত্রাঙ্গদা: ক্রাউনিং উইশ’(২০১২)-এও। ঋতুপর্ণ অভিনীত এবং সঞ্জয় নাগ পরিচালিত ছবি ‘মেমরিজ ইন মার্চ’-ও ছিল সমকাম-কেন্দ্রিক।
কী ভাবে সমলিঙ্গের প্রতি মনোরথের তীব্র গমন সম্ভব, তা ধারণ করতে চেয়েছিল ২০১৫-এর ছবি ‘আলিগড়’। ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক রামচন্দ্র সাইরাসকে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় সাসপেন্ড করে ‘নৈতিকতা’-র দোহাই দিয়ে। রামচন্দ্র সমকামী ছিলেন। তাঁকে সাসপেন্ড করা হয় ২০১০ সালে। তত দিনে গোটা বিশ্বেই সমকাম তথা বিবিধ যৌন আত্মপরিচয়ের বিষয়টি আর নিছক তাত্ত্বিক আলোচনায় আটকে নেই। ১৯৬০-এর দশক থেকে পশ্চিমে ঘটে গিয়েছে ‘কামিং আউট অব দ্য ক্লোজেট’-এর মতো আন্দোলন, যেখানে বহুবিধ যৌন আত্মপরিচয়কে জনসমক্ষে ব্যক্ত করার লক্ষ্যে যোগ দেন অগণিত নর-নারী-রূপান্তরকামী মানুষ।
এলজিবিটি-র সঙ্গে বলিউডের মূলধারার সমঝোতা আজও পুরোপুরি হয়ে ওঠেনি।
২০২০-র ছবি ‘শুভ মঙ্গল জাদা সাবধান’ বলিউডি বিবাহ-চলচ্চিত্রের প্রথাসিদ্ধ ধারণায় এক বড়সড় আঘাত আনে। সমকামী যুগলের যাবতীয় বিঘ্নকে এড়িয়ে মিলিত হওয়ার কাহিনি নিয়ে তৈরি এই ছবিতে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের মাইলফলক ঘোষণা— প্রাপ্তবয়স্ক যুগলের সম্মতি থাকলে সমকাম সহ যে কোনও যৌনাচরণই সিদ্ধ।
১৯৭৭ সালে গণিতবিদ শকুন্তলা দেবী ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অব হোমোসেক্সুয়ালস’ নামে একটি বই লেখেন। পরে এক তথ্যচিত্রে সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, এক সমকামী পুরুষের সঙ্গে দাম্পত্য কাটাতে গিয়েই তিনি ভারতীয় সমাজে সমকামী মানুষের সমস্যগুলিকে অন্তর দিয়ে বোঝেন। কিন্তু লক্ষণীয়, ২০২০ সালে তোলা শকুন্তলা দেবীর জীবনীচিত্রে বইটির প্রসঙ্গ এলেও শকুন্তলার স্বামীকে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবেই দেখানো হয়েছে।
সম্ভবত এলজিবিটি-র সঙ্গে বলিউডের মূলধারার সমঝোতা আজও পুরোপুরি হয়ে ওঠেনি। সমঝোতার রাস্তায় কখনও আপস করতে হয়েছে আইনের সঙ্গে, কখনও পারিবারিক বা সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে, কখনও বা খুব বিখ্যাত কোনও ব্যক্তির জীবনকে বিতর্ক থেকে বাঁচানোর জন্য। ব্যতিক্রম অবশ্যই ‘আলিগড়’-এর মতো ছবি। ‘বধাই দো’ সমকামী মানুষের ভালোবাসার স্বীকৃতিকে অতিক্রম করে আরও বেশি কিছু ভেবেছে। সমকামী যুগলের সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এটি অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
রামধনু রঙের মিছিল আসছে। এটি বরযাত্রীদের মিছিল নয়। এলজিবিটি-র ‘প্রাইড প্যারেড’। ‘কামিং আউট’ আন্দোলনের চূড়ান্ত বিন্দু। আবার পুলিশ ব্যারিকেড। আবার আইনি নজর। অপেক্ষারত সেই পুলিশ আধিকারিক, যার উর্দি, পদাধিকার, রাষ্ট্রীয় কাজের দায়িত্ব তাকে আত্মপরিচয়কে দমন করতে বাধ্য করছে। সে-ই এক দিন রামধনু রঙের মুখোশ পরা একজনকে বলেছিল, সে কি লজ্জা পায় বলে মুখোশ পরে?এখন সেই লোকটিই তার প্রেমিক।
ড্রামের তরঙ্গ উত্তাল হয়ে ওঠে। এগিয়ে আসে প্রেমিক। পুলিশ আধিকারিক মিছিলেরই একজনের কাছ থেকে চেয়ে নেয় মুখোশ। লজ্জায় নয়, গর্বের সঙ্গে মুখোশটি পরেনেয়। বোঝা যায়, আত্মপরিচয় মেলে ধরতে সর্বদা মুখোশ খোলা নয়, মুখোশ পরারও প্রয়োজন আছে। ‘বধাই দো’ সেই আবেগকেই তুলে ধরেছে। বলিউডি মূলধারার ছবিতে একে কি ‘ব্যতিক্রম’ বলা হবে? নাকি হিন্দি মূলধারার ছবির ‘গৌরবযাত্রা’-র (প্রাইড প্যারেড) এটিই শুভারম্ভ?