স্বপ্নহীন সময়ে বাঙালিকে স্বপ্ন দেখার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন সমরেশ মজুমদার। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
চা-বাগান এলাকাটির নাম স্বর্গছেঁড়া। আর সেখান থেকেই কলকাতায় এসেছিল অনিমেষ। জীবনের প্রথম বড় উপন্যাসে নিজেকেই হয়তো খানিক বিস্তৃত দেখতে চেয়েছিলেন সমরেশ মজুমদার। ‘স্বর্গছেঁড়া’ নামটা বড় বেশি প্রতীকী বলে মনে হয় অনিমেষ নামের আড়ালে থাকা উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স এলাকার গয়েরকাটার ছেলে সমরেশের সেই সত্তাটির ক্ষেত্রে। কলকাতা নামের শহরটির সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠতে সময় লেগেছিল হয়তো। কিন্তু কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্যের মূলধারার অন্যতম শরিক হয়ে উঠতে মোটেই তেমন সময় লাগেনি তাঁর। আত্মপ্রকাশেই নজর কেড়ে নিয়েছিলেন সমরেশ। তার পর অনেকটাই রূপকথা।
বাংলা জনপ্রিয় সাহিত্যের ধারাবাহিক কোনও ইতিহাস লিখতে বসলে তাঁর নামটিতে এসে কলমকে একটু থমকাতেই হবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পর, জনপ্রিয় সাহিত্যের আঙিনায় নতুন মুখ সে ভাবে চোখে পড়েনি ১৯৬০-এর দশকের শেষপাদে। বাংলা গদ্যসাহিত্য তখন পার হচ্ছে বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষার তেপান্তর। হাংরি বা শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন কথাসাহিত্যকে তার চেনা খোলস ত্যাগ করে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিল। তথাকথিত ‘বড়’ কাগজেও তখন ছায়া পড়েছে কালবেলার। রাজনৈতিক ঝঞ্ঝায় টালমাটাল পশ্চিমবঙ্গ। বদলাচ্ছে পারিবারিক পরিসরও। এমন পরিস্থিতিতে এক যুবক লিখে ফেলেন ‘বড় পাপ হে’-র মতো এক গল্প, তিন বিগতযৌবনা দেহোপজীবিনীর অন্ধকারের আখ্যান ছাপা হয়েছিল ‘দেশ’-এর মতো পত্রিকাতেই। অগ্রজ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বা মতি নন্দীর লেখায় উঠে আসা জগতের প্রায় সমান্তরাল এক জগৎকে সেখানে উপস্থাপন করেছিলেন সমরেশ। সেই গল্পই সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিল পাঠকের।
স্বর্গছেঁড়ার অনিমেষ আর গয়েকাটার সমরেশ সম্ভবত তখন একাকার। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলের ছাত্র সমরেশ কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক। স্নাতকোত্তর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’-এ উঠে আসে শহর কলকাতার এক অদ্ভুত পরিসর, রেসের মাঠের কথা। মফস্সলের ছেলে সমরেশের চোখে কলকাতা শহরের প্রথম অভিজ্ঞান চিহ্নই রেসের মাঠ— মনে পড়তেই পারে শিবরাম চক্রবর্তী বা ঋত্ত্বিক ঘটকের কলমে/ ক্যামেরায় উঠে আসা ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’-র বালক কাঞ্চনের কথা। অবশ্য সমরেশ বালক নন তখন। কিন্তু মফস্সল থেকে আসা চোখ এক অন্য কলকাতাকে দেখেছিল প্রথম উপন্যাসেই। সে কলকাতা আগন্তুকের চোখে মায়াঞ্জন বুলিয়ে দেয় না। ঋত্বিক ঘটকের ভাষা ধার করেই বলতে হয় সে শহরে ‘বীভৎস মজা’। সেই ঘোর নরকাগ্নির আঁচই ছিল ‘বর পাপ হে’ অথবা ‘দৌড়’-এ। থাকাটাই স্বাভাবিক। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী থেকে সমরেশ বসু— এক বিশেষ ধারায় বাংলা কথাসাহিত্যে সেই অন্ধকারকেই তুলে এনেছিলেন। সমরেশ হয়ে দাঁড়ান সেই ধারার নবতম সংযোজন।
কিন্তু এর পরের ধাপেই আসে বদল। কলকাতা বদলে গিয়েছে অনেকখানি। শহরের মাথার উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে অন্য এক অগ্নিপ্রবাহ। নকশালপন্থী আন্দোলন। এই আন্দোলনকে মাথায় রেখেই সমরেশ লিখতে শুরু করেন তাঁর ‘কালবেলা’ ট্রিলজি। প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরাধিকার’-এ উত্তরবঙ্গের শ্যামসবুজ মফস্সলে অনিমেষ নামের এক কিশোরের বেড়ে ওঠার সেই কাহিনি স্পর্শ করতে সমর্থ হয় প্রায় সব শ্রেণির পাঠককেই। বদলে যাওয়া সময়ের এক সুবিশাল আলেখ্যকে মাথায় রেখেই কলম ধরেছিলেন সমরেশ। ট্রিলজির পরের ভাগ ‘কালবেলা’ তুলে ধরে নকশালপন্থী আন্দোলনে অনিমেষের জড়িয়ে পড়ার কথা, তার প্রেমিকা মাধবীলতার কথা। যে সময় এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে পত্রিকায় বার হচ্ছে, তখন আন্দোলন আর নেই। আপাতত শান্তিকল্যাণের এক কাল রাজ্যের মাথার উপর। কিন্তু সেই আখ্যানই যেন সদ্য তরুণ প্রজন্মের কাছে জাগিয়ে তুলল তার ঠিক পূর্ববর্তী কালান্তরের পর্বকে। সত্যি বলতে, ১৯৭০-এর সেই উত্তাল সময়ের স্মৃতির সংরক্ষণের কাজ করেছিল ‘কালবেলা’। পরে অনেকেই এই উপন্যাসের সমালোচনায় অতি-রোম্যান্টিকতার অভিযোগ তোলেন। কিন্তু যে কোনও বিপ্লব-ভাবনার পিছনে যে অতি-রোম্যান্টিকতা এক অনিবার্য উপাদান হিসেবে থেকে যায়, তাকে কি অস্বীকার করা যায়? ‘কালবেলা’র পরবর্তী পর্ব ‘কালপুরুষ’ স্বপ্নভঙ্গের আলেখ্য। অনিমেষের জেল থেকে ফেরা এবং এক বস্তি অঞ্চলে মাধবীলতা আর পুত্র অর্ককে নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামের কাহিনি। অর্কের মাথায় কিন্তু কাজ করছে আপাতত শান্তিকল্যাণের কৃত্রিম স্থিতির বিরুদ্ধে জমে থাকা অগণিত ক্ষোভ। ১৯৮০-র দশকে সেই ক্ষোভ যে কোনও সংবেদনশীল বাঙালি কিশোরেরই ভিতরে ভিতরে ধিকিধিকি জ্বলছিল। ‘কালপুরুষ’ হয়তো এক স্বপ্নরাজ্যের ইশারা রাখে। কিন্তু স্বপ্ন দেখার কথা তখন বাংলা সাহিত্য থেকে প্রায় উধাও। সমরেশ সেই স্বপ্ন দেখার কথাটিই যেন মনে করিয়ে দেন।
সাহিত্যের চৌহদ্দি পেরিয়ে ছোটপর্দার আদিপর্বেও তাঁর উপস্থিতি ছিল উজ্জ্বল। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
বাংলা টেলিভিশনের সম্প্রচারেও পালাবদল ঘটছে তখন। জোছন দস্তিদারের পরিচালনায় মুখ দেখাচ্ছে বাংলা ধারাবাহিক। সেই সময় ধারাবাহিকের কাহিনিকার হিসেবে আবির্ভাব সমরেশের। ‘তেরো পার্বণ’-এর লেখক হিসেবে সমরেশ বাঙালি গেরস্থালির অঙ্গ হয়ে উঠলেন। টেলিভিশনের সঙ্গে তাঁর গাঁটছড়া স্থায়ী হয়েছিল দীর্ঘ দিন। বাংলা সিরিয়ালের ‘স্বর্ণযুগ’ বলতে জ্যোছন দস্তিদার-সমরেশ মজুমদার পর্বের কথাই স্মৃতিতে ধরা রয়েছে বাঙালির। সে দিক থেকে দেখলেও সমরেশ এক ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক, যিনি সদ্য আগত এক শিল্পমধ্যমকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। আখ্যানের স্রোত যে ক্রমে দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমের দিকেই ঢলবে, সে কথা কি সেই সময়েই টের পেয়েছিলেন সমরেশ? পরবর্তী কালে তাঁর আর এক সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘সাতকাহন’-ও ধারাবাহিক হিসেবে সফল হয়।
লেখকবৃত্তিকেই জীবিকা হিসেবে নিয়েছিলেন সমরেশ। অক্লান্ত হাতে লিখে গিয়েছেন অনেক রকমের লেখা। ‘সাতকাহন’ বা ‘গর্ভধারিণী’ নিয়ে যখন বড়রা আলোড়িত, সমান্তরালে কিশোরদের মন জয় করে নিচ্ছেন সমরেশ তাঁর অর্জুন-কাহিনির মধ্যে দিয়ে। অর্জুন উত্তরবঙ্গের এক যুবক। ক্রমেই সে জড়িয়ে পড়ে গোয়েন্দাগিরিতে। অর্জুনের কাহিনি কখনও কখনও স্বাভাবিক গোয়েন্দা গল্পের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে কল্পবিজ্ঞানের জগতেও পা রেখেছে। কিন্তু কলকাতাকেন্দ্রিক গোয়েন্দাদের ভুবনে অর্জুন যে একাই মফস্সলের প্রতিনিধি, সে কথা প্রায় প্রতিটি আখ্যানেই স্পষ্ট। পরবর্তী সময়ে ‘নবকুমার’ সিরিজেও নিজের কথাই কি ফিরে বলছিলেন সমরেশ? কলকাতা, ফিল্মজগৎ ইত্যাদির অভিজ্ঞতাকেই কি নতুন করে বুনছিলেন ‘স্বর্গছেঁড়া’ চা-বাগান থেকে আগত এক যুবক? এক দিক থেকে দেখলে, কলকাতা শহরে তাঁর আগন্তুক অস্তিত্বকে কখনও ছুটি দেননি সমরেশ। আজীবন মাথায় নিয়ে ঘুরেছেন পাহাড়তলির সবুজকে, তার মানুষজনকে, তার আনন্দ-বেদনাকে।
কিশোর সাহিত্যেও স্বকীয়তার পরিচয় রেখেছিলেন সমরেশ। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
কালবেলা পেরিয়ে এই মুহূর্তে তিনি কালপুরুষের পথে। ছায়াপথ ধরে এগোলে দেখা যাবে হয়তো তাঁর সঙ্গে চলেছে ক্রাচ হাতে অনিমেষ, ঈষৎ মলিন শাড়ি অথচ দৃঢ় চিবুকরেখা নিয়ে মাধবীলতা, তার যাবতীয় অপ্রাপ্তি আর অঙ্গিকার নিয়ে অর্ক, নিজের অধিকার বুঝতে চাওয়া ‘সাতকাহন’-এর দীপাবলী। হয়তো যাবতীয় রহস্যের কিনার পেরিয়ে অর্জুনও সেই মিছিলে শামিল। এই মিছিল সম্ভবত এখনও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের শেষতম জনপ্রিয় চরিত্রের মিছিল। সমরেশ মজুমদারের পর আর কোনও সাহিত্যিকের কলম থেকে এতগুলি চরিত্র নেমে আসেনি, যারা মধ্যবিত্ত বাঙালির, স্বপ্ন দেখতে চাওয়া বাঙালির, দৈনন্দিনের ক্লিন্নতা এক লাফে পার হতে চাওয়া বাঙালির সব স্বপ্ন, সব প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির, সব বেদনাবোধের শরিক হয়ে উঠেছিল।