বাণিজ্যে সফল হলেও চা এ দেশের মহান সংস্কৃতি হয়ে ওঠেনি
China

সেই সাধনা আর নিষ্ঠা কই

প্রাচীন চিনে দীর্ঘ ধ্যানের সময় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জাগিয়ে রাখত চা, যা এক সময় তাঁদের হাত ধরেই জাপানে ছড়ায়। চিন-জাপানে চা পান এক উৎসব।

Advertisement

নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:২৪
Share:

নান্দনিক: অতিথিদের হাতে তুলে দিতে হয় এই সুষমা-পানীয়। জাপানি চা-চক্র ঐতিহ্যের কাঠখোদাই ছবি। উইকিমিডিয়া কমন্স

চার হাজার বছর আগে চিনে প্রথমে ওষুধ, তার পর পানীয় হিসেবে চা-এর প্রচলন। সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ায় চিন থেকে ওলন্দাজরা ইউরোপে চা নিয়ে যায়। এক সময় শুধু চিনেই উৎপাদিত হত চা, ইংল্যান্ডকে চা দিয়ে চিন পেত আফিম। সেই বোঝাপড়ার টানাপড়েনে ঊনবিংশ শতকে এই দুই দেশের ভিতর বাঁধে দুটো যুদ্ধ, ইতিহাসে যাদের নাম ‘ওপিয়ম ওয়ার’। ইংরেজদের থেকে চা পেয়েছিল ভারতবর্ষ। সেরা চা উৎপাদক দেশ হিসেবে আজ চিন-জাপানের সঙ্গেই প্রথম সারিতে ভারত। ভারতে চা পানের ধারায় কিছু আঞ্চলিক বৈচিত্র থাকলেও, কোথাও একটা ঐক্যের গ্রন্থি রয়েছে— যার নাম যেন ‘প্রয়োজন’। অমৃতসমান দার্জিলিং, অসম আর নীলগিরি চায়ের জন্মভূমি, ভারতের চা পানের ধারা সেই ‘প্রয়োজন’কে ছাপিয়ে শিল্প হয়ে ওঠেনি, যেমন হয়েছে চিন, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ানে। ভারতের চা-অভ্যাস মূলত ইউরোপ প্রভাবিত। ১৮৩৯-এ ইংরেজদের ‘অসম কোম্পানি’ ভারতে বাণিজ্যিক ভাবে চা চাষ করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্যোগে, জীবন বাজি রেখে, ১৮৪৮-এ উদ্ভিদবিদ রবার্ট ফরচুন তিন বছর প্রত্যন্ত চিনে ঘুরে, লুকিয়ে সংগ্রহ করে কলকাতায় পাঠান উচ্চমানের চা গাছের বীজ আর প্রায় কুড়ি হাজার চারাগাছ। ১৮৫০ নাগাদ সেই নিষিদ্ধ সম্পদে দার্জিলিঙের চা বাগান গড়ে ওঠা শুরু। কয়েক জন চিনা চা-উৎপাদন বিশেষজ্ঞকে ফরচুনসাহেব দার্জিলিঙে নিয়ে এলেও ইউরোপের কোনও নন্দনবেত্তা উৎসাহী হননি চিনে চায়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নান্দনিকতা আর আধ্যাত্মিক ধারাকে গ্রহণ করতে। অথচ, প্রথমে চিন থেকে চায়ের সঙ্গেই চায়ের সরঞ্জামও ইউরোপে রফতানি হয়েছে। ক্ষুদ্র চিনা পেয়ালার আকার বৃদ্ধি করে অষ্টাদশ শতকের শেষে ইউরোপ তাতে হাতলও জুড়ে দেয়। ইংরেজের হাত ধরে ভারতে এসেছিল দুধ-চিনিবান্ধব চায়ের যে ধারা, তা যেন শুধুই প্রয়োজন-সর্বস্ব, আত্মাবিহীন অভ্যাস, যার স্বাদ ছিল, সৌরভ ছিল, মন ছিল না।

Advertisement

প্রাচীন চিনে দীর্ঘ ধ্যানের সময় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জাগিয়ে রাখত চা, যা এক সময় তাঁদের হাত ধরেই জাপানে ছড়ায়। চিন-জাপানে চা পান এক উৎসব। অতিথি, প্রকৃতি, পরিবেশ, সময়, এমনকি চায়ের সুন্দর উপকরণ আর সরঞ্জামের সঙ্গে একাত্ম হয়ে, মৈত্রীর লক্ষ্যে, শ্রদ্ধা, একাগ্রতা আর সংযমের সঙ্গে চা তৈরি আর পরিবেশন করে নান্দনিক আনন্দ আর আধ্যাত্মিক পূর্ণতা লাভ করাই চা-উৎসবের লক্ষ্য। এই চা-উৎসবে পাওয়া যায় তাওবাদ, কনফুসিয়াস আর গৌতম বুদ্ধের ভাবনার ছায়া— অন্তবিহীন মহাবিশ্বের রহস্যময়তাকে স্বীকার করে প্রকৃতি, মানুষের সঙ্গে এক গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক রচনা করা। জাপানি নন্দনবেত্তা কাকুজো ওকাকুরা তাঁর বিশ্ববন্দিত বই দ্য বুক অব টি-তে বলেছেন, জাপানের চা-সংস্কৃতি আসলে ছদ্মবেশে তাওবাদ।

চিনের জনপ্রিয় চা-উৎসবের ধারার নাম ‘গংফু চা’, অর্থাৎ দক্ষতার সঙ্গে তৈরি হয় যে চা। ‘গংফু চা’-এর জন্য প্রয়োজন হতে পারে পঁচিশটারও বেশি সরঞ্জামের। তবে চায়ের পেয়ালা আর কেটলি অতি ক্ষুদ্র। শান্ত পরিবেশে, চিনের চা-উৎসবে উপভোগ করা হয় চায়ের বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ এমনকি চায়ের জলে খুলতে থাকা চা পাতার রূপ ও আকার। সরঞ্জামের বাহুল্য অথবা আচারের আড়ম্বর এখানে যেন মনঃসংযোগ আর সুন্দরের উপাসনারই উপলক্ষ। এই চা তৈরির প্রক্রিয়া আর তা পরিবেশনের ভিতর দিয়ে কখন যেন গড়ে ওঠে মানবতা আর স্বর্গের এক সেতু— চিনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের মতে, স্বর্গ আসলে প্রকৃতি। চা-সরঞ্জাম সাজানো ও উত্তপ্ত করা; ধূপ প্রজ্বলন, ফুল সাজানো; চায়ের পাতার সৌরভ গ্রহণ করে তাকে উষ্ণ জলে জাগিয়ে তোলা; ক্ষুদ্র, শূন্য পেয়ালা ধীরে চায়ে পূর্ণ করা, প্রণতিগৌরবে অতিথিকে পেয়ালা এগিয়ে দেওয়া, অতিথির পক্ষ থেকে চায়ের আচার্যকে নীরবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন— এ ভাবেই যেন প্রতিষ্ঠিত হয় একের প্রতি অন্যের শ্রদ্ধা, প্রেম, সুন্দর আর প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা। চা পানের অভিজ্ঞতা যেন এক আনন্দময় যাত্রা— একই পাতা বার বার ভিজিয়ে ক্ষুদ্র পেয়ালায় পরিবেশিত চায়ে প্রতি বার বদলাতে দেখা রং, বর্ণ, স্বাদ— আমাদের অস্থায়ী, পরিবর্তনশীল জীবনের মতো।

Advertisement

‘কিউসু’, অর্থাৎ কেটলিতে চা পাতা উষ্ণ জলে ভিজিয়ে জাপানের রোজকার চা পানের অভ্যাস পদ্ধতিগত ভাবে চিনের ‘গংফু চা’-এর কাছাকাছি, যদিও জাপানের ‘সাদো’ অথবা ‘চা-নো-ইউ’ বলতে যে চা-উৎসবকে বোঝায়, তা আলাদা। পাতা চায়ের বদলে জাপানের চা-উৎসবে ব্যবহৃত হয় সবুজ, গুঁড়ো চা, যা তুলনায় প্রশস্ত ও গভীর এক চা-পাত্রে গাঢ়, ঘন, ফেনিল দ্রবণে প্রস্তুত হয়ে পরিবেশিত হয় নির্দিষ্ট প্রথায়। ধ্যানের আদর্শে বিশ্বাসী বৌদ্ধ ‘জেন’ সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে চিন থেকে জাপানে আসা চা-পানের ধারাকে ষোড়শ শতকে এক নতুন রূপ দেন চায়ের বিশ্ববিশ্রুত আচার্য সেন নো রিকিউ। সহজতা, স্বল্পতা, অসম্পূর্ণতা, অ-পেলব, আপাত রুক্ষতার সৌন্দর্যকে জাপানের চা-উৎসবের সঙ্গে যুক্ত করে রিকিউ চিনিয়ে দেন তাঁর ‘ওয়াবি-সাবি’ দর্শন-সঞ্জাত বিশেষ রীতির চা-গৃহ-স্থাপত্য, বাঁশের ফুলদানি, চিত্রকলা, ক্যালিগ্রাফি, কবিতা, চায়ের চামচ, পেয়ালা ও অন্যান্য সরঞ্জাম— যার ভিতর কোথাও যেন কিছু মায়া, কিছু ছায়া, দারিদ্রের আভিজাত্য আর বিষণ্ণতা খেলা করে যায়। জাপানের চা-উৎসবের ক্ষুদ্র, বিনয়ী, সুন্দর চা-গৃহকে ঘিরে থাকে কিছুটা এলোমেলো বাগান। পাথুরে জলাধারে হাত ধুয়ে, বাগানের পথ হেঁটে মনকে শান্ত করে, অতি সঙ্কীর্ণ এক দরজা দিয়ে নতমস্তকে প্রবেশ করতে হয় আসবাব-আতিশয্যহীন, ক্ষমতার বৈভব আর দম্ভহীন চা-গৃহের অপার নিস্তব্ধতায়, যেখানে শুধুই রয়েছে মৈত্রী, শ্রদ্ধা, বিশুদ্ধতা আর অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে নিজেকেই খুঁজে পাওয়ার এক সুযোগ। চিনের চকচকে, নকশা-বহুল ও দামি চা-সরঞ্জামের বদলে রিকিউ খুঁজে নিতে শিখিয়েছিলেন সাদাসিধে, অথচ নান্দনিকতায় অনন্য সব উপকরণ। তাঁর সমকালীন শাসকের ক্ষমতার দম্ভে উঁচু হতে থাকা দুর্গের নীরব প্রতিবাদ হিসেবে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে তুলেছিলেন রিকিউ তাঁর চা-গৃহ। ওকাকুরা লিখেছেন, “…যত ক্ষণ না এক জন নিজেকে সুন্দর করে তুলতে পারেন, সৌন্দর্যচর্চার অধিকার নেই তাঁর। এই কারণেই চায়ের আচার্যেরা হয়ে উঠতে চাইতেন শিল্পীর চেয়েও বড় কিছু— খোদ শিল্পই।”

বাঙালির সব পথের শেষ ঠিকানা রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বুঝেছিলেন চিন আর জাপানের চা-উৎসবের আধ্যাত্মিক শক্তির কথা। পড়েছিলেন বন্ধু ওকাকুরার দ্য বুক অব টি। ১৯১৬-য় প্রথম বার জাপানে গিয়ে আসাহি শিন্‌বুন সংবাদপত্রের কর্ণধার র‍্যুহেই মুরায়ামার বাড়ির চা-উৎসবে বিমোহিত রবীন্দ্রনাথ জাপানযাত্রী-তে লিখেছিলেন, “সমস্ত ব্যাপারটা এই। শরীরকে, মনকে একান্ত সংযত করে নিরাসক্ত প্রশান্ত মনে সৌন্দর্যকে নিজের প্রকৃতির মধ্যে গ্রহণ করা। ভোগীর ভোগোন্মাদ নয়; কোথাও লেশমাত্র উচ্ছৃঙ্খলতা বা অমিতাচার নেই; মনের উপরতলায় সর্বদা সেখানে নানা স্বার্থের আঘাতে, নানা প্রয়োজনের হাওয়ায় কেবলই ঢেউ উঠছে, তার থেকে দূরে সৌন্দর্যের গভীরতার মধ্যে নিজেকে সমাহিত করে দেওয়াই হচ্ছে এই চা-পান অনুষ্ঠানের তাৎপর্য।” চা-উৎসবের বিশুদ্ধ সৌন্দর্যবোধ যে স্বার্থ এবং বস্তুর সংঘাত থেকে মনকে রক্ষা করে, তা অনুভব করে তিনি এও লিখেছিলেন, “সেইজন্যেই জাপানির মনে এই সৌন্দর্য রসবোধ পৌরুষের সঙ্গে মিলিত হতে পেরেছে।” চিন আর জাপানের চায়ের ধারা শান্তিনিকেতনের নান্দনিকতার অঙ্গ করে তোলার চেষ্টাও করেন তিনি। চৈনিক কবি সু-সি-মো-এর সহায়তায় শান্তিনিকেতনে গড়ে তোলেন ‘সু-সি-মো চা চক্র’, যা পরে ‘দিনান্তিকা’ চা-গৃহে স্থানান্তরিত হয়। জাপান থেকে রাসবিহারী বসুর শ্যালিকা মাকিকো হোশি রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে এসে শিখিয়েছিলেন জাপানের চা-উৎসব আর ফুল সাজানোর বিদ্যা, ‘ইকেবানা’।

গৌতম ভদ্রের লেখায় দেখা যায়, মদ্যপকে ‘মাতাল’ বলার চটুল আনন্দে, প্রাক্‌স্বাধীনতা যুগে ‘চা-খোর’কে ‘চাতাল’ বলেছে বাঙালি। বিজ্ঞান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সম্ভবত স্বদেশি বিশ্বাসে, চা-কে ক্ষতিকারক মনে করে ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছেন, বাংলার অন্তঃপুরবাসী মেয়েদের রাস্তায় নামিয়ে আনার জন্য দায়ী করেছেন চা-কে। শিক্ষাবিদ অ্যানি বেসান্ত অমনোযোগী ছাত্রকে তিরস্কার করতে গিয়ে বলেছেন, সেই ছাত্রের শুধু এক রাস্তার চায়ের দোকানে কাজ করার যোগ্যতা রয়েছে। চা যেন ভারতে প্রথম থেকেই বিদেশি শাসকের আমদানি করা ভোগ, নেশার আর সময় কাটানোর এক অলস উপাদান, যার সঙ্গে সম্পর্ক নেই চিন-জাপানে চায়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সংস্কৃতি আর পবিত্রতার। চা-কে কেন্দ্র করে আমাদের প্রভূত বাণিজ্য হয়েছে, কিন্তু উচ্চ আদর্শের ভিত্তিতে কোনও মহান সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। সুস্বাদু চা নিয়ে আমাদের ঘুম-ভাঙা; জনসংযোগ, হুলোড় আর গল্পগাছা আছে; পাড়ায় পাড়ায় চায়ের দোকান, তাপে কুণ্ঠিত প্লাস্টিকের কাপ আর নির্বিকল্প মাটির ভাঁড়ও আছে, চটজলদি ‘টি ব্যাগ’, বরফ চা, লেবু চা, মশলা চা সবই আছে— কিন্তু তার মন আছে কি? সুন্দরের সাধনায়, ধ্যানের একাগ্রতায়, উপাসনার নিষ্ঠায় নিঃস্বার্থ চায়ের পেয়ালা আমরা এগিয়ে দিতে পেরেছি কি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement