সহযোদ্ধা: কলকাতায় সংযুক্ত কিসান মোর্চার মিছিলে উপস্থিত রয়েছেন যোগেন্দ্র যাদব, বলবীর সিংহ রাজেওয়াল-সহ অন্য নেতারা। ১২ মার্চ। ছবি: পিটিআই।
পঞ্জাবের কৃষক নেতারা পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন বিজেপিকে একটাও ভোট না দেওয়ার আবেদন নিয়ে। সাড়ে তিন মাস ধরে দিল্লির বিভিন্ন সীমান্ত দখল করে লড়ছেন তাঁরা— বিজেপির তৈরি করা কৃষি আইনের বিরোধিতায়। সেই আইন তাঁদের স্বার্থবিরোধী। কলকাতায় সভা করে এই কৃষক নেতারা জানাচ্ছেন, কী ভাবে বিজেপি ক্রমশ জায়গা করে দিয়েছে পেটোয়া কর্পোরেটকে। পঞ্জাবের কৃষকদের প্রতিনিধিরা বাংলার কৃষকদের এই বিপদ থেকে সাবধান করে দিতে এসেছেন।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকের ভয় পাওয়ার কতটা কারণ আছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে তো বটেই। কিন্তু, তার আগে একটা অন্য প্রশ্ন করা যাক— পঞ্জাবের কৃষকরা যে ভাবে মাসের পর মাস নিজেদের খেতখামার ছেড়ে, কাজ বন্ধ রেখে পড়ে আছেন দিল্লির সীমান্তে, পশ্চিমবঙ্গের ক’জন কৃষকের পক্ষে সেটা সম্ভব? উত্তরটা কৃষিজীবী মানুষরা জানেন। পরিসংখ্যানের শীতল অঙ্কগুলোও সেই উত্তর জানে। রাজ্যে কৃষিজীবী পরিবারের সংখ্যা ৭৩ লক্ষ ২৩ হাজার। তার ৯৬ শতাংশই প্রান্তিক বা ক্ষুদ্র কৃষক। ফলে, এই রাজ্যের অধিকাংশ চাষিই একেবারে মরা গরিব। বাড়ি ছেড়ে, জমি ছেড়ে মাসের পর মাস বিক্ষোভ অবস্থানে থাকার সামর্থ্যই তাঁদের বেশির ভাগের নেই।
এই রাজ্যে জমির খণ্ডিত আয়তন, অধিকাংশ কৃষিজীবী মানুষের মালিকানায় থাকা যৎসামান্য জমি— সব মিলিয়ে রাজ্যের কৃষিচরিত্র অন্য একটা প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষি কর্পোরেট স্বার্থের কাছে কি ততখানি আকর্ষক? আবার, পশ্চিমবঙ্গে যেখানে অধিকাংশ কৃষক এমনিতেই মান্ডির বাইরে, মহাজনের কাছে ফসল বিক্রি করেন, সেখানে নতুন কৃষি আইনের ফলে এই রাজ্যের কৃষকরা আদৌ কোনও অসুবিধার মুখে পড়বেন কেন, সেই প্রশ্ন নিয়েও নাড়াচাড়া হয়েছে যথেষ্ট। অর্থাৎ, পঞ্জাবের কৃষকরা যে সব কারণে বিজেপির উপর চটেছেন, পশ্চিমবঙ্গে সেই কারণগুলোর অধিকাংশেরই অস্তিত্বই নেই।
তা হলে, বিজেপিকে সপাট প্রত্যাখ্যান করার কারণ বাংলার কৃষকদের আছে কি? না কি, বিজেপি ক্ষমতায় এলেও তাঁদের বাড়তি বিপদের আশঙ্কা নেই? গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, কিন্তু আবারও, একটা অন্য প্রশ্নের উত্তর আগে খুঁজে দেখা যাক— রাজনৈতিক ভাবে বিজেপি কাদের স্বার্থরক্ষা করে? দলের চিরাচরিত ভোটব্যাঙ্কের হিসেব ধরলে, বিজেপি মূলত ছোট আর মাঝারি ব্যবসায়ীদের দল। কিন্তু, নরেন্দ্র মোদীর জমানায় পাল্লা ঝুঁকেছে কর্পোরেটের দিকে। তার মোক্ষমতম প্রমাণ এই কৃষি আইনই। প্রায় চার মাসব্যাপী এমন বিপুল বিক্ষোভ, গোটা উত্তর ভারতে প্রবল রাজনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা, আন্তর্জাতিক সমালোচনা— কিছুই কেন্দ্রীয় সরকারকে নতুন কৃষি আইন প্রত্যাহারে বাধ্য করতে পারেনি। বিজেপির বিভিন্ন মাপের নেতারা একাধিক বার বলেছেন যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এই আইনের পক্ষে সওয়াল করেছেন, তাই এর থেকে সরে আসা সরকারের পক্ষে অসম্ভব। সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলেছে, এই আইনকে এমন ব্যক্তিগত জেদাজেদির স্তরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন? কিন্তু, শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর জেদরক্ষায় বিজেপি এমন মারাত্মক রাজনৈতিক ঝুঁকি নিচ্ছে, এই কথাটা কাণ্ডজ্ঞানের ধোপে টিকবে না। এই জেদের একটিমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা সম্ভব— কিছু কর্পোরেটের স্বার্থরক্ষার চেয়ে বিজেপির কাছে আর কিছুই বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেন, সেই তর্ক আপাতত মুলতুবি থাকুক। কিন্তু, কর্পোরেটের সঙ্গে কৃষকের স্বার্থের সংঘাত বাধলে বিজেপি কোন দিকে থাকবে, তাতে সংশয় নেই। পঞ্জাব-হরিয়ানার সঙ্গে বাংলার কৃষকের অবস্থা অন্য প্রশ্নে যতটাই আলাদা হোক না কেন, এই একটা জায়গায় তা অভিন্ন। আর, কৃষিতে কর্পোরেটের স্বার্থ শুধু ফসল কেনার অধিকার পাওয়ার মধ্যেই সীমিত নয়।
তা হলে কি পঞ্জাবের চাষিরা বিজেপির উপর যতখানি বিরক্ত, পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের বিজেপিকে নিয়ে ততটাই উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত? না। উদ্বেগের মাত্রা আরও অনেক বেশি। তার কারণ অবশ্য বিজেপি নয়, বাংলার কৃষক। পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ কৃষকই প্রান্তিক অথবা ক্ষুদ্র, তাঁদের দরকষাকষির ক্ষমতা নেই, আর্থিক জোর যৎসামান্য— এই কারণগুলো তো আছেই, কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণ হল, বাংলায় কৃষকের শ্রেণিভিত্তিক— কৃষক পরিচিতি-কেন্দ্রিক— কোনও রাজনীতি নেই। এ এক বিচিত্র ধাঁধা— যে রাজ্যের সমাজ এমন গভীর ভাবে রাজনীতি-বিভক্ত, যে রাজ্যে সুদীর্ঘ বামপন্থী রাজনীতির ইতিহাস আছে, এবং যে রাজ্যের কৃষি একের পর এক রাজনৈতিক আন্দোলন দেখেছে, সে রাজ্যে কৃষির কোনও নিজস্ব শ্রেণি-রাজনীতি নেই!
হয়তো রাজ্যের সমাজ এমন ভাবে রাজনীতি-বিভক্ত বলেই নেই। পশ্চিমবঙ্গের কৃষি-রাজনীতি সব সময়ই ঢুকে গিয়েছে বৃহত্তর রাজনীতির ছায়ার তলায়— সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন তার মোক্ষমতম উদাহরণ। কৃষক পরিচিতি থেকে নয়, বরং দলীয় রাজনৈতিক অবস্থান থেকে লড়াই হয়েছে কৃষি সংক্রান্ত প্রশ্নে। তার লাভ-ক্ষতির হিসেব অন্যত্র, কিন্তু এই রাজনীতির অনিবার্য ফল— বৃহত্তর রাজনীতির ন্যারেটিভ পাল্টে গেলে, ভিন্নতর কোনও উদ্দেশ্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলে, কৃষকদের কোণঠাসা হয়ে যেতে সময় লাগে না। তার সবচেয়ে উদাহরণ সিপিএম। ক্ষমতায় আসার পর যে দল ভূমি সংস্কার করেছিল, ক্ষমতা থেকে যাওয়ার আগে সে দলই ‘শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ বলে হুঙ্কার দিয়ে কৃষকদের জমি কেড়ে নিতে মাঠে নামল। সেই সিপিএমের প্রতিস্পর্ধী হিসেবেও কিন্তু প্রয়োজন হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসকে— আর একটা রাজনৈতিক দল। কৃষক-পরিচিতির রাজনীতি দিয়ে তার প্রতিরোধ করা যায়নি।
অর্থাৎ, অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলায় কৃষকের স্বার্থরক্ষা করার জন্য— অন্তত, রাজনৈতিক ভাবে সেই স্বার্থরক্ষার কথা বলার জন্য— রাজনৈতিক দল প্রয়োজন হবেই। বিশেষত, যখন ভোটের সময় নয়, তখন। বাংলার রাজনীতিতে কোনও মহেন্দ্র সিংহ টিকায়েত নেই, কোনও বলবীর সিংহ রাজেওয়াল নেই, যাঁরা সরকারকে বাধ্য করতে পারবেন কৃষকের স্বার্থের কথা মাথায় রাখতে। রাজনীতিতে সেই জোর রাজ্যের কৃষকদের এখনও নেই। ফলে, যে দল ক্ষমতায় থাকবে, তারা স্বাভাবিক ভাবে কতটা কৃষিবান্ধব, পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য সেই প্রশ্নটা তাৎপর্যপূর্ণ। গত কয়েক মাসের ঘটনাক্রম প্রমাণ করে দিয়েছে, কৃষকের স্বার্থের কথা বলার সেই রাজনৈতিক দল বিজেপি নয়।
রাজ্যের অর্ধেকের বেশি মানুষ এখনও কৃষিজীবী। গ্রামাঞ্চলে প্রতি দশ জনের মধ্যে সাত জনই সম্পূর্ণত বা আংশিক ভাবে নির্ভরশীল কৃষির উপর। কাজেই, ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে এই কৃষক পরিচিতিটা যদি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হত, অবাক হওয়ার কারণ থাকত না। স্বাভাবিক হত, যদি ভোট দেওয়ার সময় সব কৃষিজীবী মানুষ ভাবতেন, কাকে ভোট দিলে কৃষকের স্বার্থ তুলনায় সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত থাকবে। দুর্ভাগ্য, তা হয়নি। শেষ পর্যন্ত কে কোন যুক্তিতে কাকে ভোট দেবেন, তা প্রত্যেক ভোটারের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তবে, একটা কথা মনে রাখলে ভাল। কৃষকের স্বার্থের উপর যদি কর্পোরেট স্বার্থের রোডরোলার চলে, তবে কোন কৃষক ধর্মে হিন্দু আর কে মুসলমান, সেই ফারাক করে চলবে না। ঠিক যেমন, কে হিন্দুত্ববাদের পতাকা বয়ে বেড়ান, নোট বাতিলের ধাক্কা তার তোয়াক্কা করেনি।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষিজীবী মানুষ তাঁদের সেই পরিচিতিটিকে কেন্দ্র করেই জোট বাঁধতে পারবেন কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। কিন্তু, পঞ্জাবের কৃষকদের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা সাবধান হতে পারবেন কি না, সেটা ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করবে। রাজ্যের ভবিষ্যৎ, কৃষিজীবী মানুষের ভবিষ্যৎও বটে।