শতবর্ষে পৌঁছে আরএসএস এখন নারীর গুরুত্বের কথা বলছে
RSS

হেলা করি মোরে রাখিবে...

এত দিন সঙ্ঘের চিন্তাভাবনায় নারীসমাজের ভূমিকা মূলত সীমাবদ্ধ ছিল ঘর সামলানোয়— পিতা, ভ্রাতা, স্বামী ও পুত্রের মঙ্গলকামনায়।

Advertisement

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৮:১৬
Share:

অপরিবর্তনীয়: রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। ১৮ সেপ্টেম্বর, নয়াদিল্লি। ছবি: পিটিআই।

আজই শতবর্ষে প্রবেশ করছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। এক শতাব্দীর পথ পেরিয়ে এসে সঙ্ঘ এত দিনে নারীসংক্রান্ত চিন্তাভাবনায় বিশেষ জোর দিয়েছে। সঙ্ঘ পরিবারের সংগঠক দ্রৌপদী মুর্মুকে দেশের রাষ্ট্রপতি করা থেকে সঙ্ঘের বার্ষিক অনুষ্ঠানে ১৯৩৪-এর পর ২০২২-এ প্রথম কোনও মহিলা প্রধান অতিথির উপস্থিতি (পর্বতারোহী সন্তোষ যাদব) বা আইনসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিলে সমর্থন— গত দু’তিন বছরে মহিলাদের নজর টানার মতো একাধিক পদক্ষেপ করেছে আরএসএস। সংগঠনের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, তাঁরা ঘরে ও বাইরে মহিলাদের বৃহত্তর যোগদান দেখতে চান। ২০২২ সালের অক্টোবরে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত বলেন, “আমরা তাঁদের মা বলে ডাকি। আমরা তাঁদের জগজ্জননী বলে মনে করি। আমি জানি না কেন আমরা (হিন্দু সমাজ) তাঁদের কার্যকলাপের ক্ষেত্রকে সীমিত করেছিলাম। পরবর্তী পর্যায়ে বিদেশি হানাদাররা এলে এই নিষেধাজ্ঞাগুলো বৈধতা পায়। হানাদাররা চলে গেলেও আমরা বিধিনিষেধ রেখে দিলাম। আমরা কখনও তাঁদের মুক্ত করিনি।”

Advertisement

এত দিন সঙ্ঘের চিন্তাভাবনায় নারীসমাজের ভূমিকা মূলত সীমাবদ্ধ ছিল ঘর সামলানোয়— পিতা, ভ্রাতা, স্বামী ও পুত্রের মঙ্গলকামনায়। ২০১৩ সালে তৎকালীন বিজেপি সাংসদ যোগী আদিত্যনাথ ঋষি মনুর আদর্শের অনুরণনে বলেছিলেন, “নারীরা স্বাধীনতার যোগ্য নয়... নারীরা পুরুষের মতো কার্যকর হলে ঘর ধ্বংস হয়ে যায়।” তাঁর মতে, “নারীকে যেহেতু মুক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত রেখে দিলে তার শক্তি নষ্ট হয়ে যায় এবং ক্ষতি হতে পারে, তাই নারীশক্তির কোনও স্বাধীনতার প্রয়োজন হয় না, তাদের প্রয়োজন সুরক্ষা।”

সে দিক থেকে ভাগবতের বক্তব্য নিশ্চয়ই এক ধাপ এগোনো। কিন্তু কতটা এগোনো? কোন পরিপ্রেক্ষিতে? এ ক্ষেত্রে আমরা মাপকাঠি হিসাবে সঙ্ঘের জন্মের অনেক আগেই বিপুল প্রতিষ্ঠা পাওয়া দুই ব্যক্তিত্বের চিন্তাভাবনা দেখতে পারি— বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভাগবত যে বললেন, তিনি জানেন না কেন মহিলাদের উপরে এত বাধানিষেধ এসেছিল, বঙ্কিমচন্দ্র তার উত্তর দিয়েছিলেন সেই উনিশ শতকে, তাঁর ‘প্রবীণা ও নবীনা’ প্রবন্ধে— “আত্মপক্ষপাতী পুরুষগণ, যতদূর আত্মসুখের প্রয়োজন, ততদূর পর্য্যন্ত স্ত্রীগণের উন্নতির পক্ষে মনোযোগী; তাহার অতিরেকে তিলার্দ্ধ নহে। এ কথা অন্যান্য সমাজের অপেক্ষা আমাদিগের দেশে বিশেষ সত্য।” ভাগবত যে বললেন, ‘বিদেশি হানাদার’দের আগমনে নারীদের উপরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলি হিন্দু সমাজে বৈধতা পায়, এটাও ঠিক নয়। একাধিক প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র বিস্তারিত ভাবে হিন্দু শাস্ত্রে লিঙ্গবৈষম্যের বৈধতা দেখিয়েছেন— “প্রাচীন কালের কথা বলিতে চাহি না; তৎকালীন স্ত্রীজাতির চিরাধীনতার বিধি; কেবল অবস্থা-বিশেষ ব্যতীত স্ত্রীগণের ধনাধিকারে নিষেধ; স্ত্রী ধনাধিকারিণী হইলেও স্ত্রীর দান বিক্রয়ে ক্ষমতার অভাব; সহমরণ বিধি; বহুকাল প্রচলিত বিধবার বিবাহ নিষেধ; বিধবার পক্ষে প্রচলিত কঠিন নিয়মসকল, স্ত্রীপুরুষে গুরুতর বৈষম্যের প্রমাণ।”

Advertisement

মূল আরএসএস সংগঠনে মহিলাদের কোনও স্থান নেই। কিন্তু তাদের একটি মহিলা শাখা আছে— রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি। এ ছাড়া বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, সংস্কার ভারতী, সেবা ভারতী, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠানে মহিলাদের কিছু অংশগ্রহণ থাকে। দুর্গা বাহিনীর মতো একটি তরুণীদের সংগঠনও আছে। রাষ্ট্র সেবিকা সমিতির শাখায় নিয়মিত প্রার্থনা হয়: “পিতাপুত্রভ্রাতৃশ্চ ভর্তারমেবম/ সুমার্গ প্রতি প্রেরয়ন্তিমিহ”— পিতা, পুত্র, ভাই ও স্বামীকে যাতে সুপথে চলার প্রেরণা দিতে পারি, এমন শক্তি দাও আমায়। এখানে নারীর চাহিদা পুরুষকেন্দ্রিক। সে নিজের জন্য কিছু চাইছে না। সমিতি-প্রকাশিত প্রেরিকা পুস্তিকায় সম্পাদিকা বলছেন, প্রতি সফল পুরুষের পিছনে যে-হেতু নারীর অবদান থাকে, তাই কন্যা, বোন, স্ত্রী ও মা— এই চার ভূমিকায় সফল হওয়ার মধ্যে দিয়েই সংসারের সমৃদ্ধি আনা যায়। লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাওয়া ব্যক্তিকে (পুরুষকে) আবার ধর্মপথে ফেরানোর দায়িত্ব তাঁদেরই। অর্থাৎ পুরুষের সাফল্যে ভূমিকা রাখাই নারীর মূল কাজ।

এই যে নারীদের ভাল চাই কারণ তাতে আখেরে পুরুষের ভাল হবে, এই চিন্তাভাবনাকে বহু বছর আগে খোঁচা দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। ‘প্রাচীনা ও নবীনা’ প্রবন্ধে তিনি লেখেন, যাঁরা স্ত্রীজাতির মহত্ত্ব কীর্তন কালে পুরুষের জীবনে তাঁদের ভূমিকার কথা বলেন, “তাঁহাদিগের আন্তরিক ভাব এই যে, পুরুষই মনুষ্যজাতি; যাহা পুরুষের পক্ষে শুভাশুভ বিধান করিতে সক্ষম, তাহাই গুরুতর বিষয়; স্ত্রীগণ পুরুষের শুভাশুভবিধায়িনী বলিয়াই তাহাদিগের উন্নতি বা অবনতির বিষয় গুরুতর বিষয়।” এর বিরোধিতায় বঙ্কিমচন্দ্র বলেন, “তাঁহারা পুরুষগণের শুভাশুভবিধায়িনী হউন বা না হউন, তাঁহাদিগের উন্নতিতে সমাজের উন্নতি...।”

সঙ্ঘ নারীকে মাতৃশক্তি হিসাবেই বন্দনা করে। ভাবনাটি গোলমেলে, কারণ এতে মহিলাদের উপরে সুনির্দিষ্ট ভাবে মায়ের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। অধিকারশূন্য দায়িত্ব। এই হল সঙ্ঘের মূল চিন্তা— অধিকার নয়, দায়িত্ব। নারীতে দেবত্ব বা মাতৃত্ব আরোপ, কিছুই অবশ্য তাকে দাসীত্ব থেকে মুক্তি দেয়নি। নারীকে একই সঙ্গে দেবী ও দাসী বানানোর এই প্রবণতার বিরুদ্ধে চিত্রাঙ্গদার কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন সেই বাণী: “পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে/ সে নহি নহি, হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে/ সে নহি নহি। যদি পার্শ্বে রাখ মোরে/ সংকটে সম্পদে,/ সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে/ সহায় হতে,/ পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।” কিন্তু সঙ্ঘ ভিন্ন চিন্তায় লালিত। বাঞ্চ অব থটস বইতে ‘গুরুজি’ মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর লিখেছিলেন, “এখন ‘নারী সাম্য’ এবং ‘পুরুষের আধিপত্য থেকে তাদের মুক্তি’র জন্য আওয়াজ উঠেছে! তাদের পৃথক লিঙ্গের ভিত্তিতে ক্ষমতার বিভিন্ন পদে আসন সংরক্ষণের দাবি করা হচ্ছে। এই ভাবে জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা, ভাষাবাদ ইত্যাদির সঙ্গে আরও একটি ‘বাদ’— ‘লিঙ্গবাদ’— যোগ করা হচ্ছে।”

গোলওয়ালকরের মতে, “‘আধুনিকতাবাদ’ আমাদের জীবনের আরও অনেক মূল্যবোধের ক্ষতি করছে। জ্ঞানেশ্বরীর একটি শ্লোক বলে, ‘এক জন ধার্মিক ব্যক্তি তাঁর ভাল কাজের উপরে বিনয়ের আবরণ বিছিয়ে দেন, ঠিক যেমন এক জন সদাচারী মহিলা তাঁর শরীরকে ঢেকে রাখেন।’ এটি পুণ্যময় নারীত্বের প্রকৃতি বর্ণনা করে। কিন্তু ‘আধুনিক’ মহিলারা মনে করেন যে ‘আধুনিকতা’ তাঁদের শরীরকে আরও বেশি করে জনসাধারণের দৃষ্টিতে উন্মুক্ত করার মধ্যে রয়েছে। কী অধঃপতন!” স্মর্তব্য, সাম্প্রতিক কালে ধর্ষণের ঘটনায় বারে বারেই নারীর পোশাককে দায়ী করা হয়েছে— খোলামেলা পোশাকই নাকি ধর্ষণের উস্কানির কারণ।

এই খোলামেলা পোশাকের জন্যও সঙ্ঘ পরিবার বার বার পশ্চিমি সংস্কৃতিকে দায়ী করেছে, ধর্ষণের জন্যও। ২০১২-র ডিসেম্বরে, নির্ভয়া-কাণ্ডের পর যখন গোটা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, তখন মোহন ভাগবত বললেন, গণধর্ষণ বা যৌন অপরাধের মতো ঘটনা সেখানেই ঘটে, “যেখানে ‘ভারত’ পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে ‘ইন্ডিয়া’ হয়ে ওঠে।” তাঁর মতে, “প্রকৃত ভারতীয় মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত যেখানে নারীকে ‘মা’ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।” ২০১৩-র জানুয়ারিতে মধ্যপ্রদেশে একটি সভায় তিনি বলেন, “স্বামী-স্ত্রী একটি চুক্তিতে জড়িত, যে চুক্তির অধীনে স্বামী স্ত্রীকে বলছেন যে, আপনি আমার বাড়ির যত্ন নিন এবং আমি আপনার সমস্ত প্রয়োজনের যত্ন নেব। আমি আপনাকে নিরাপদ রাখব। তাই, স্বামী চুক্তির শর্তাবলি অনুসরণ করেন। যত ক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রী এই চুক্তি অনুসরণ করেন, স্বামী তাঁর সঙ্গে থাকেন। যদি স্ত্রী চুক্তি লঙ্ঘন করেন, তবে স্বামী তাঁকে অস্বীকার করতে পারেন।” উনি কিন্তু স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে অস্বীকার করার কথা বলেননি।

হিন্দুত্ববাদীরা বার বার সনাতনের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলেন। তা কিসের ইঙ্গিতবাহী? তাঁরা কি নারী সুরক্ষার সমাধান সনাতন বিধিতে দেখেন? রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “স্থূলতম তামসিকতাই বলে যাহা যেমন আছে তাহা তেমনিই থাক, যাহা বিনাশের যোগ্য তাহাকেও এই তামসিকতাই সনাতন বলিয়া আঁকড়িয়া থাকিতে চায়।” আরও কঠোর ভাবে তিনি বলছেন, “বস্তুত অবিচলিত সনাতন প্রথার বড়াই যদি কেহ করিতে পারে তবে সে পশুপক্ষী কীটপতঙ্গ মানুষ নহে।” আজ যখন সঙ্ঘপ্রধান নারীর বৃহত্তর ভূমিকার কথা বলছেন,তখন বিজেপি-আরএসএস-এর নেতারা এক বার এটাও জানাবেন যে, নারীসংক্রান্ত মনুর বচন বা গোলওয়ালকরের উদ্ধৃত বক্তব্য সম্পর্কে তাঁদের ভাবনা কী? এ সব বচন কি ‘বিনাশের যোগ্য’, না নয়?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement