অতিমারির প্রকোপ থেকে দুনিয়া সবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার মাত্রা ফের বাড়তে শুরু করল। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক হামলা শুরু হয় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। এই আক্রমণের কারণে আমেরিকা-সহ বহু পশ্চিমি দেশ রাশিয়ার উপরে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আর্থিক নিষেধাজ্ঞার ফলে গ্লোবাল জিডিপি বা বিশ্বের মোট উৎপাদনের উপরে কী প্রভাব পড়বে, তা শুধু সময়ই বলবে। যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে ছন্দপতন ঘটেছে, তার মধ্যে দেশের অর্থব্যবস্থাকে যত দূর সম্ভব নিরাপদ রেখে চলার এমন পথ খুঁজে বার করা, যাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ যথাসাধ্য কম হয়— এটাই এখন সব দেশের কাছে প্রধানতম চ্যালেঞ্জ।
অতিমারি এবং যুদ্ধের কারণে তৈরি হওয়া এই ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার আবহে বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রধানত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে— সরকারি এবং বেসরকারি, উভয় ক্ষেত্রেই ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা; মূল্যস্ফীতি; এবং, আর্থিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার প্রকাশিত মার্চের আর্থনীতিক তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে বহু দেশেই মূল্যবৃদ্ধির হার প্রত্যাশিত হারের তুলনায় বেশি; সাপ্লাই চেন বা জোগান-শৃঙ্খল ব্যাহত হয়েছে; আর্থিক ক্ষেত্রেও অস্থিরতার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। যুদ্ধ শুরু হওয়া ইস্তক ভারতের শেয়ার বাজারেও তুমুল ওঠা-পড়া চলছে। এ ছাড়া, বিদেশি বিনিয়োগও লক্ষণীয় ভাবে দেশ থেকে বেরিয়ে গিয়েছে এই সময়ে।
ফেব্রুয়ারিতে ভোগ্যপণ্যের সূচকের নিরিখে মূল্যস্ফীতির হার গত আট মাসের মধ্যে সর্বাধিক ৬.০৭ শতাংশে ছিল। মার্চেই তা পৌঁছে গেল সাত শতাংশের দোরগোড়ায়। এই নিয়ে টানা তিন মাস মূল্যস্ফীতির হার রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার নির্ধারিত সহনসীমা ৬ শতাংশের উপরে। অপরিশোধিত তেল এবং খাদ্য-বহির্ভূত অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়ার কারণে পাইকারি মূল্যবৃদ্ধিও ফেব্রুয়ারির ১৩.১১ শতাংশ থেকে মার্চে ১৪.৫৫ শতাংশে পৌঁছল। গত ১০ ফেব্রুয়ারি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছিল যে, আগামী অর্থবর্ষে ৪.৫ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি ঘটতে চলেছে। এই হারটি বর্তমান অর্থবর্ষের মূল্যস্ফীতির সম্ভাব্য হার ৫.৩ শতাংশের চেয়ে বেশ খানিকটা কম। যে ভাবে মূল্যস্ফীতির মাত্রা দিন দিন বাড়ছে, তা যদি অব্যাহত থাকে তবে এই পূর্বাভাস না মেলার সম্ভাবনাই বেশি। ২২ এপ্রিল রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের মনিটরি পলিসি কমিটির বৈঠকের যে তথ্য প্রকাশিত হয়, তাতে তাদের দ্বিধা স্পষ্ট। এমপিসি-র বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, তাদের মুদ্রানীতি এমন থাকবে যাতে বর্তমান সময়ে বাজারে অর্থের জোগান থাকে; কিন্তু ধীরে ধীরে সেই জোগান তারা শুষে নেবে, যাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায় এবং আর্থিক বৃদ্ধিও বজায় থাকে। এ ছাড়াও তারা বলেছে যে, তাদের লক্ষ্য আর্থিক বৃদ্ধির প্রতি সহায়ক অবস্থান গ্রহণ করেও ভোগ্যপণ্যের সূচকের নিরিখে মূল্যস্ফীতির হার ৪ শতাংশের মধ্যে রাখা, ২ শতাংশ-বিন্দু বৃদ্ধি বা হ্রাসের মাত্রা-সহ।
কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের বিবৃতিতে স্পষ্ট ভাবে বলা না হলেও এটা পরিষ্কার যে, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ব্যাঙ্কের কাছে প্রবল উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতিমারি শুরুর পর থেকে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার বাড়ায়নি। এবং, বাজারে যথেষ্ট নগদের জোগান বজায় রেখে দেশের আর্থিক বৃদ্ধিকে পুনরুজ্জীবিত করার উপরেই বেশি নজর দিয়েছিল ব্যাঙ্ক। সেটার দরকার ছিল। কিন্তু, পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে। দেশের আর্থিক বৃদ্ধির পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়াটি যে শুরু হয়ে গিয়েছে, তা স্পষ্ট। কোভিডের কারণে ফের কোনও বড় মাপের আর্থিক ধাক্কা না লাগলে ভারতের পক্ষে এই বৃদ্ধির ভরবেগ বজায় রাখা সম্ভব, উচিতও। এই পরিস্থিতিতেও কি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক আর্থিক বৃদ্ধিতে সহায়তা বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করবে? না কি, সেটা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হবে?
মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে কঠোরতর মুদ্রানীতি গ্রহণ করলে আর্থিক বৃদ্ধির উপর তার কী প্রভাব পড়বে, এই প্রশ্নটিই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের দোলাচলের মূলে রয়েছে। সুদের হার বাড়ানো মানেই বিনিয়োগের খরচ বেড়ে যাওয়া— কারণ, ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে গেলে সাধারণ গ্রাহক বা কোনও সংস্থাকে বেশি সুদ বহন করতে হবে। এমনিতেই অতিমারিকালে দেশে বিনিয়োগ অত্যন্ত ব্যাহত হয়েছিল। সুদ বৃদ্ধির ফলে বিনিয়োগ কমে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব বৃদ্ধিতে পড়বেই। অন্য দিকে, ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির ফলে মানুষের আয় কমবে, ক্রমানুসারে তার প্রভাব পড়বে ক্রয়ক্ষমতার উপরে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে দরিদ্রতর পরিবারগুলি। তাই, পণ্যের দামের ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা শুধু আর্থিক বাজারের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, পণ্যের দাম বাড়ার কারণে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যে সমস্যা হয়, তা কমানোর জন্যেও প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধিকে উপেক্ষা করলে চলবে না, তার উপরে অবিলম্বেই নজর দেওয়া দরকার। তাই আরবিআই-এর সুদের হার বাড়ানোর বিষয়ে দ্বিধা করা উচিত নয়।
আরও একটা কথা স্পষ্ট ভাবে বুঝতে হবে যে, মূল্যস্ফীতির হারের এই ঊর্ধ্বগতি কিন্তু পুরোপুরি যুদ্ধের কারণে নয়। গত দু’বছরে দেশের রাজস্ব ও মুদ্রানীতি যে পথে হেঁটেছে, এটা তারও ফল বটে। গত দু’বছরের অর্থনৈতিক নীতির মূল লক্ষ্য ছিল আর্থিক বৃদ্ধি। তার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদ না বাড়িয়ে অর্থনীতিতে টাকার জোগান বজায় রেখেছিল, এবং সরকার বর্ধিত রাজকোষ ঘাটতি স্বীকার করেই ব্যয়ের পথে হেঁটেছিল। সেই নীতিগুলিই এখন পণ্যমূল্য এবং মূল্যস্ফীতির উপরে চাপ সৃষ্টি করছে। কাজেই, এখন কঠোরতর রাজস্ব ও মুদ্রানীতি গ্রহণ করাই বিধেয়। এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিকে যদি আগামী দিনে ৮ শতাংশের বৃদ্ধিহার বজায় রাখতে হয়, তা হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, এবং সরকারি ব্যয়কেও আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সুস্থায়ী করতে হবে।
সরকারের আর্থিক সুস্থায়িত্ব বিষয়েও কিছু সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। ২০২০-২১’এর তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে এসে সরকারের আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, তাতে সংশয় নেই; কিন্তু, এই অনিশ্চিত সময়ে আর্থিক পুনরুদ্ধারের কাজটি চালিয়ে যেতে হবে, সেটা কোনও সামান্য চ্যালেঞ্জ নয়। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কী প্রভাব ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ভারতীয় অর্থব্যবস্থার উপর পড়বে, এখনই তা বলা মুশকিল। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, ২০২১-২২ অর্থবর্ষের সংশোধিত অনুমানে দেখা যাচ্ছে যে, সরকারের ঋণের উপরে সুদ দিতে হয়েছিল রাজস্ব ব্যয়ের ২৫.৭ শতাংশ ও রাজস্ব আয়ের ৩৯.১৪ শতাংশ। এর অবশ্যম্ভাবী ফল, সরকারের হাতে উন্নয়নের খাতে খরচ করার জন্য টাকার পরিমাণ তুলনায় ছিল কম। সরকারি ঋণে সুদের বোঝা কম করতে বকেয়া ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে, এবং সরকারের আয়-ব্যয় এমন ভাবে পরিকল্পনা করতে হবে যাতে তা সুস্থায়ী হয়। তা যদি না করা যায়, তবে ২০২১-২২’এ আর্থিক বৃদ্ধির পথে পা বাড়ানোর যে লক্ষণ দেখা গিয়েছিল এবং ২০২২-২৩ সালেও তার যে প্রত্যাশা করা হচ্ছে, সেই সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি যেন না হয় যেখানে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, আর্থিক বৃদ্ধি কমবে এবং রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ ক্রমে বাড়তে থাকবে। সৌভাগ্যক্রমে ভারতের ঋণ এবং ঘাটতি আর সে ভাবে বাড়েনি, রাজস্ব আদায় এবং বিনিয়োগ বাড়ার কারণে। ২০২১ অর্থবর্ষে জাতীয় আয়ের সঙ্গে ঋণের অনুপাতে বিরাট হেরফের না হলেও আইএমএফ-এর ফিসকাল মনিটর (২০২১)-এর মতে, “অতিমারির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে বিভিন্ন দেশের নানা খাতে আর্থিক বিনিয়োগে, ফারাক বাড়বে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে এবং প্রভাব পড়বে জাতীয় আয়েও।” অর্থ ভান্ডার আরও জানিয়েছে, “এর ধাক্কায় ঋণের বোঝা অনেকখানি বেড়ে যাওয়ার ফলে আগামী বেশ কিছু বছর ধরে ঋণের পরিমাণ অতিমারির আগে ঋণের পূর্বাভাসের তুলনায় ধারাবাহিক ভাবে বেশিই থাকবে— উন্নত দেশগুলির ক্ষেত্রে ২০২৬ পর্যন্ত এই বোঝার মাত্রা ২০ শতাংশ বেশি হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।”
উন্নত দেশগুলিতে যেমন এখন সুস্থায়ী রাজস্ব নীতি এবং কঠোরতর মুদ্রানীতি গ্রহণ করার সময় এসেছে, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশকেও ক্রমেই সেই পথে হাঁটতে হবে।