সঞ্জয় মঞ্জরেকর কি আবার কোথাও একটা ঝোলাল? ভুলভাল বলল না কী একটা? এশিয়া কাপের কোনও একটা ম্যাচের পর ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটারের ধন্যবাদান্ত বিবৃতি শুনতে শুনতে আনন্দবাজার অনলাইনের ক্রীড়াবিভাগের সহকর্মীকে প্রশ্ন করলাম।
এমনিতেই মঞ্জরেকরের ধারাভাষ্য শুনতে ভাল লাগে না। কেমন যেন কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা। গিট্টু-পাকানো। প্লাস বিভিন্ন ক্রিকেটারকে অনাবশ্যক চিমটি (যার মধ্যে রবীন্দ্র জাডেজাটা সবচেয়ে কুখ্যাত হয়েছে। কিন্তু এমন আরও মণিমুক্তো আছে, যেগুলো সর্বকালের সেরা ‘মঞ্জরেকর সংকলন’-এ যাওয়ার মতো)। শুনে কোথাও একটা মনে হয়, নিজে ওয়ান ডে’তে শানাতে না-পেরে স্বেচ্ছাবসর প্রকল্পে ঢুকে পড়েছিলেন। তাই এখনকার স্মার্ট, ধনী, আপাত-উদ্ধত এবং ‘খাও-পিও-জিও’ দর্শনে বিশ্বাসী ক্রিকেটারদের বোলবোলাও মানতে পারেন না! অথচ চোখের সামনে তাদেরই অহরহ দেখতে হয়। তাদেরই সাফল্যের বর্ণনা দিতে হয়। ফলে মাঝেমধ্যেই অসূয়ার একটা চোঁয়া ঢেকুর ওঠে। কমেন্ট্রি থেকে সেই নিষ্ফল হতাশাটাই চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে। আর কোথাও কেউ ব্যর্থ হলেই তলোয়ার বাগিয়ে কাটতে বসে।
ভাল লাগে না। মনে হয়, এ সেই লোক, যে হাতে সবসময় পেল্লায় আতশকাচ নিয়ে বসে আছে। সকলের ছিদ্র খুঁজে বার করবে! সাধে কি মঞ্জরেকর সম্পর্কে সেরা রসিকতা হল, কোনও একটা জন্মদিনের পার্টিতে গিয়ে গৃহকর্তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলেছিলেন, ‘‘সবই ঠিক আছে। কিন্তু মনে রেখো, মৃত্যুর দিকে আরও একটা বছর এগিয়ে গেলে!’’
দেখা গেল, এ ক্ষেত্রে তা নয়। মঞ্জরেকর ঝোলাননি। মরুশহরের স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে এশিয়া কাপ আয়োজনের জন্য শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। শুনে এতটাই অবিশ্বাস্য লেগেছিল যে মঞ্জরেকরকে সন্দেহ করে বসেছিলাম— খেলা হচ্ছে দুবাইয়ে। আর টুর্নামেন্ট আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ দিচ্ছে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডকে! নিশ্চয়ই আবার একটা গুল্লু করে বসেছে!
কিন্তু সহকর্মী বললেন, নাহ্। মঞ্জরেকর ঠিকই বলেছেন। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডই এই এশিয়া কাপের আনুষ্ঠানিক আয়োজক। ‘আনুষ্ঠানিক’। কিন্তু ব্যবহারিক নয়। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গভীর গাড্ডায় শ্রীলঙ্কা। দীর্ঘ দিন গোটা দেশে আলো জ্বলেনি। বীভৎস মুদ্রাস্ফীতি। ভান্ডারে বিদেশি মুদ্রা নেই। ফলে আগের বৈদেশিক ঋণ শোধ করা তো দূরের কথা, পরিস্থিতি সামাল দিতে নতুন করে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়াও যাচ্ছে না। জ্বালানি তেল নেই। খাবার নেই। এবং এতটাই নেই যে, দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ তাঁদের খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে আধপেটা খেয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্যারিকেড ভেঙে ঢুকে পড়ে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদের দখল নিচ্ছে ক্রুদ্ধ জনতা। রাষ্ট্রপতি স্ত্রী এবং এক দেহরক্ষী নিয়ে প্রাসাদ ছেড়ে পালাচ্ছেন! দ্বীপরাষ্ট্রের এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য গোটা টুর্নামেন্টটা সরিয়ে আনতে হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে। আয়োজক দেশ হয়েও যেখানে অতিথির মতো খেলতে আসতে বাধ্য হয়েছেন দাসুন শনাকা এবং তাঁর সতীর্থেরা।
অভাবনীয় লাগছিল! মনে মনে রিওয়াইন্ড করে পর পর ঘটনাগুলো দেখছিলাম। ২০১৯ সালে বোমা বিস্ফোরণ এবং তার পরে গত দু’বছরে কোভিড পরিস্থিতিতে ভেঙে-পড়া শ্রীলঙ্কার পর্যটন ব্যবস্থা, সরকারের একাধিক বেনজির ভুল সিদ্ধান্ত-সহ উপর্যুপরি বিভিন্ন ঘটনা দেশটাকে এমন এক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে, যার তুলনা এই ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রতিক কালে নেই।
গত ১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল। রাতভর বৈঠকের পর ৩ এপ্রিল ভোরে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া মন্ত্রিসভার প্রায় সমস্ত সদস্য পদত্যাগ করেন। তার পর দিন ইস্তফা দেন দেশের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের গভর্নর। অর্থমন্ত্রী ইস্তফা দেওয়ায় নতুন যে অর্থমন্ত্রীকে নিয়োগ করা হয়েছিল, তিনিও এক দিনের মধ্যে পদত্যাগ করেন। আরও বিপাকে পড়েন রাষ্ট্রপতি। এবং জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে নেন।
কিন্তু তত দিনে ঘোরতর অনিশ্চয়তার গহ্বরে ঢুকে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। এপ্রিলের ১০ তারিখে দেশের চিকিৎসকেরা জানান, জীবনদায়ী ওষুধের ভাঁড়ারে টান পড়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে তার অভিঘাতে যত সংখ্যক মানুষ মারা যাবেন, কোভিডেও সারা দেশে তত লোকের মৃত্যু হয়নি! তার দু’দিন পরে শ্রীলঙ্কার সরকার জানিয়ে দিল, বিদেশি ঋণ শোধ করার ক্ষমতা নেই। কারণ, সঙ্কটসময়ে বিভিন্ন সামগ্রী বিদেশ থেকে আমদানি করতে গিয়ে রাষ্ট্রের তহবিলে আর বিদেশি মুদ্রা অবশিষ্ট নেই। রাস্তায় নেমে পড়েছে ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্ত এবং বাঁধভাঙা জনতা। ১৯ এপ্রিল পুলিশের গুলিতে মারা গেলেন এক বিক্ষোভকারী। কলম্বোয় রাষ্ট্রপতির প্রাসাদের বাইরে শুরু হল বিক্ষোভ-অবস্থান। ৯ মে সেখানে চড়াও হল সরকার-পোষিত দুষ্কৃতীরা। মোট ন’জনের মৃত্যু হল। আহত কয়েকশো। কলম্বো জুড়ে তৈরি হল নজিরবিহীন নৈরাজ্য এবং অরাজকতা। জনপ্রতিনিধিদের বাড়িতে আগুন লাগাতে শুরু করল ক্রুদ্ধ জনতা। প্রধানমন্ত্রীর কলম্বোর বাসভবনে ঢুকে পড়ল জনতা। তাঁকে উদ্ধার করতে হল সেনাবহিনীকে। পদত্যাগ করলেন প্রধানমন্ত্রী।
১০ মে সরকারি নির্দেশ জারি হল— ‘শ্যুট টু কিল’! অর্থাৎ, বিক্ষোভকারীদের গুলি করে মারার নির্দেশ। কিন্তু তত দিনে বোতল থেকে দৈত্য বেরিয়ে পড়েছে। প্রতিবাদীরা সরকারি কার্ফুর তোয়াক্কা করছেন না। কলম্বো শহরে শীর্ষ পুলিশ আধিকারিককে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে বেধড়ক ঠ্যাঙানো হয়েছে। তাঁর গাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জুলাইয়ের ৯ তারিখে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ দখল করে নিল জনতা। সেই অট্টালিকার সুইমিং পুল থেকে শোওয়ার ঘর জুড়ে দাপাতে লাগলেন সাধারণ মানুষ। আর ফৌজি সুরক্ষার আড়ালে অজানা গন্তব্যে চলে গেলেন রাষ্ট্রপতি। চার দিন পর, ১৩ জুলাই সেনাবাহিনীর বিমানে স্ত্রী এবং এক দেহরক্ষীকে নিয়ে দেশ ছেড়ে পিঠটান দিলেন রাষ্ট্রপতি। পিছনে পড়ে রইল দু’কোটির কিছু বেশি জনসংখ্যার এক অরাজক, নাচার এবং ক্ষিপ্ত দেশ। যে দেশে শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু হয় ১৫ জনের!
৯ মে-র পর থেকে কলম্বো জুড়ে তৈরি হল নজিরবিহীন নৈরাজ্য এবং অরাজকতা।
এই ঘটনাপ্রবাহে শ্রীলঙ্কার বদলে নিজের দেশের নামটা বসিয়ে ভাবার চেষ্টা করছিলাম। শিউরে ওঠার মতো! অর্থনৈতিক ভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত এবং অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগতে-থাকা একটা দেশ। স্কুল-কলেজ এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কারণ, দিনের বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে। দেশ বাঁচাতে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে দাঁড়াতে হয়। ভাবছিলাম, নয়াদিল্লির রাইসিনা হিলের রাস্তায় কাতারে কাতারে ক্রুদ্ধ মানুষ। তারা ঢুকে পড়ছে, দখল করে ফেলছে রাষ্ট্রপতি ভবন। রাষ্ট্রপতি দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন বায়ুসেনার বিমানে। আর তার কিছু দিনের মধ্যে রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলীরা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলতে নেমে পড়ছেন বিদেশের মাটিতে।
এবং ট্রফি জিতছেন!
রূপকথা লিখিয়েরাও সম্ভবত এই সাহস দেখাতে পারবেন না। এ এক আশ্চর্য ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনি। যা ঘটলে এই জীবনেই ঘটে। বাস্তবেই ঘটে। আমাদের আশপাশেই ঘটে। যেমন ঘটল শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের কাছে হেরেছিল শ্রীলঙ্কা। তখন এক বারও মনে হয়নি, ফাইনালে প্রবল প্রতাপান্বিত এবং প্রতিভাশালী ক্রিকেটারে ভরা পাকিস্তানকে মেরে ট্রফি নিয়ে চলে যাবে তারা। কিন্তু ওই যে, রূপকথা লিখিয়েদের সাহসও মাঝেমধ্যে কম বলে মনে হয়!
গত রবিবার রাতে নীল জার্সি পরা যে চেহারাগুলো মুষ্টিবদ্ধ হাত নিয়ে দৌড়ে আসছিল দুবাইয়ের মাঠে, একে অপরের কাঁধে উঠে পড়ছিল, দলবেঁধে ঘাসের উপর শুয়ে পড়ছিল বা যূথবদ্ধ হয়ে সারা মাঠ প্রদক্ষিণ করছিল, তাদের কাউকে অতিমানব মনে হচ্ছিল না। তাদের মধ্যে কোথাও কোনও বহ্বাস্ফোট ছিল না। ছিল না ‘কেমন দিলাম’ মার্কা বিবৃতি জাহির করার তাগিদ। তাদের মুখে শুধু এক অনাবিল হাসি ছিল। আর সেই হাসিতে মাখামাখি হয়ে ছিল ক্লিন্ন দেশবাসীকে উপহার দেওয়ার খুশিটুকু।
ম্যাচের পর ফাইনালের হিরো ভানুকা রাজাপক্ষে বলছিলেন, ‘‘সমস্ত শ্রীলঙ্কাবাসীই এখন একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের আশা, এই সঙ্কটের সময়েও আমরা আমাদের দেশবাসীর মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারলাম।’’ তার পর ট্রফিটা তুলে ধরে, ‘‘দিস ইজ টু দ্য হোল নেশন। দে ওয়্যার ওয়েটিং ফর দিস ফর সো লং! এই ট্রফিটা গোটা জাতির জন্য। তারা দীর্ঘ দিন একটা ট্রফির অপেক্ষায় ছিল।’’
শ্রীলঙ্কা অধিনায়ক শনাকা বলেছেন, ‘‘একেই বলে সত্যিকারের ঘুরে দাঁড়ানো! চারপাশে অনেক খারাপ কাণ্ড-কারখানা ঘটছে। কিন্তু ক্রিকেটারদের উপর বিশ্বাস রাখুন।’’
দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি টুইট করেছেন, ‘এই জয় দেখাল, নিবেদিতপ্রাণ এবং দৃঢ়সংকল্প থাকলে আমরা জাতি হিসেবেই ঘুরে দাঁড়িয়ে সমস্ত চ্যালেঞ্জ জিততে পারব।’
এই ট্রফিটা মৃতসঞ্জীবনীর মতো একটা দেশকে খানিকটা হলেও বাঁচিয়ে দিয়ে গেল।
দেখতে দেখতে আবার মনে হচ্ছিল, সত্যিই তো! অতিমানব হওয়ার দরকার নেই। দরকার অনুশাসন, দরকার অনুশীলন, দরকার জেতার উদগ্র ইচ্ছে। দরকার জীবনের মঞ্চে কঠিন পরিস্থিতিকে জয় করার তীব্র একমুখিতা। আর দরকার কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত রাখা। মান গিয়েছে। ধন গিয়েছে। কিন্তু ওই ট্রফিটা মৃতসঞ্জীবনীর মতো একটা দেশকে খানিকটা হলেও বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্টকে বাউন্ডারির দড়ির মধ্যে আবদ্ধ না-রেখে দিয়ে গেল জীবনের উড়ান। দিয়ে গেল জীবনে জীবন যোগ করার শিক্ষা।
বয়স মাত্রই বাইশ। কিন্তু ঠিক বলেছেন শ্রীলঙ্কার এশিয়াকাপ জয়ী ক্রিকেটার মহেশ টিকসানা, ‘‘নো নিড টু হ্যাভ ওয়ার্ল্ড ক্লাস প্লেয়ার্স, হোয়েন ইউ হ্যাভ ইলেভেন ব্রাদার্স।’’ বিশ্বমানের প্লেয়ার দরকার নেই। ১১টা ভাই থাকলেই হয়। ওটা আসলে নিছক কোনও টিম নয়। সঙ্কটসময়ে কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত রাখার সৌভ্রাতৃত্ব একাদশ।
সঞ্জয় মঞ্জরেকর কী বলেন?
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)