৯ অগস্ট ২০২৪। সে দিন সারা ভারত জুড়ে ভারত ছাড়ো আন্দোলন বা অগস্ট বিপ্লবের বিরাশি বছর পূর্তি উদ্যাপিত হচ্ছে। আর সে দিনই সংবাদমাধ্যম তোলপাড় হল এক মর্মান্তিক দুঃসংবাদে— আর জি কর হাসপাতালের এক পড়ুয়া মহিলা-ডাক্তার ভোররাতে কলেজের সেমিনার রুমে খুন ও ধর্ষিত হয়েছেন। তার পর থেকে যে গণআন্দোলন শুরু হল, যা এখনও অব্যাহত, তা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়কার গণআন্দোলনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ৯ অগস্টের ওই রাতের পর থেকে হয়ে চলেছে মিছিলের পর মিছিল, ধর্না, অবস্থান বিক্ষোভ, মানববন্ধন। প্রতিবাদের বিচিত্র সব পন্থা উদ্ভাবিত হচ্ছে প্রতি দিন। লক্ষ মানুষের সম্মিলিত স্বরে ধ্বনিত হচ্ছে বিচিত্র সব স্লোগান। এর মধ্যে একটি হল, ‘প্রীতিলতার এই বাংলা ধর্ষকদের হবে না’। অথবা ‘প্রীতিলতার এই মাটিতে ধর্ষকদের ঠাঁই নাই’।
কে এই প্রীতিলতা? একটু জানার চেষ্টা করি। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বা ওয়াদ্দার এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বৈপ্লবিক ধারার প্রতিভূ। ৫ মে ১৯১১, অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রামের ধলঘাটে তাঁর জন্ম। জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার ও প্রতিভাময়ী দেবীর দ্বিতীয় সন্তান প্রীতিলতার শিক্ষার সূত্রপাত ড. খাস্তগির সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে। ওই স্কুল থেকে সসম্মানে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রীতিলতা ঢাকা যান ইডেন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়তে। ঢাকায় এক দিকে পড়াশোনা চলছে, অন্য দিকে প্রীতিলতা নাম লিখিয়েছেন লীলা নাগের দীপালী সঙ্ঘে। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ১৯২৯-এ অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক্ট কংগ্রেসে তিনি যোগ দেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কল্পনা দত্ত এবং আরও কয়েকজন। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট বোর্ড পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হওয়ার পর কুড়ি টাকা মাসিক বৃত্তি পেয়ে তিনি কলকাতায় বেথুন কলেজে ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। মেয়েরা তখন সবে পড়াশোনা করার উদ্দেশ্যে ঘরের ঘেরাটোপ পেরিয়ে জনপরিসরে পা রাখছেন। দূরের শহরে হস্টেল বা মেসবাড়িতে থেকে পড়াশোনা করছেন। পড়াশোনার সঙ্গে কেউ সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছেন।
প্রীতিলতা হস্টেলে থেকে বেথুনে যখন পড়াশোনা করছেন, তখন তাঁর এক দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদার বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়ের পিসিমার বাড়িতে থেকে যাদবপুরের এঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ছেন। এই পিসিমার বাড়ি হয়ে উঠেছিল বিপ্লবীদের গোপন ঠেক। বিপ্লবী দলের নানা পরিকল্পনা যখন চলছে, তখন জনৈক সাহেবকে হত্যার চেষ্টার অপরাধে চট্টগ্রাম দলের রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের উপর মৃত্যু পরোয়ানা জারি হল। প্রীতিলতার ডায়েরি থেকে জানা যায় যে, পিসিমার সাহায্যে রামকৃষ্ণের বোন সেজে প্রীতিলতা কম করে চল্লিশ বার আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে যান।
রামকৃষ্ণের মৃত্যু প্রীতিলতার মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। অনার্স কোর্স ছেড়ে তিনি সাধারণ গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পরীক্ষায় বসেন, ডিসটিংশন নিয়ে পাশ করেন। চট্টগ্রামে ফিরে তিনি নন্দনকানন উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার চাকরি নেন। একই সঙ্গে দেশের স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে আত্মবলিদানের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন। সূর্য সেনের নেতৃত্বে ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনীর একনিষ্ঠ সৈনিক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। মাস্টারদা তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, আত্মবলিদানের জন্য এত উদ্গ্রীব না হয়ে মেয়েদের সংগঠিত করতে। কিন্তু প্রীতিলতা সঙ্কল্পে অনড়।
১৯৩২-এর ১২ জুন এক ঝড়-জলের দিনে বন্ধুর বাড়ি সীতাকুণ্ডে যাওয়ার অজুহাতে ধলঘাটে এসে পৌঁছন। মা-বাবা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি, কী উদ্দেশ্যে প্রীতিলতা ঘর ছেড়েছেন। বিপ্লবী দলে যে মহিলারা যোগ দিতেন, তাঁদের পরিবারের প্রতি গোয়েন্দা বিভাগের পরামর্শ ছিল, “দ্য পেরেন্টস অর গার্ডিয়ানস অব দিজ় উইমেন শুড বি ওয়ার্নড দ্যাট দে উইল বি অ্যারেস্টড ইফ ফারদার রেভলিউশনারি অ্যাক্টিভিটি অন দেয়ার পার্ট(স) কামস টু লাইট, সো প্লিজ় টু বি আস্কড টু কিপ আ ওয়াচ ওভার দেম” (আইবি রিপোর্ট ফাইল নং ২২৩/১৯১৯)। গোয়েন্দা বিভাগের নির্দেশে বিপ্লবী মেয়েদের পরিবার তাদের উপর নজরদারি করেছিল কি না জানা যায় না, তবে পরিবারকে লুকিয়ে দলে দলে প্রীতিলতারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতার লড়াইয়ে।
১৯৩২-এর ১৩ জুন ধলঘাটে ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের আকস্মিক হানায় ক্যামেরন ও নির্মল সেন-সহ অনেকের মৃত্যু হয়। শুধু পালিয়ে যেতে পারেন প্রীতিলতা ও সূর্য সেন। প্রীতিলতা বাড়ি ফিরলেও কিছু দিনের মধ্যে বোঝেন, তাঁর পরিবার পুলিশের নজরে পড়বে। কাউকে না জানিয়ে তিনি আবার ঘর ছাড়েন। এর পর ১৯৩২-এর ২৪ সেপ্টেম্বর, তাঁর নেতৃত্বে পনেরো জন সশস্ত্র বিপ্লবী পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। এক জনের মৃত্যু হয়, কয়েক জন আহত হয়। বিপ্লবীদের অধিকাংশ ধরা পড়েন। প্রীতিলতা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে জীবনের ইতি টানেন।
পুলিশ তাঁর পকেটে একটি চিরকুট খুঁজে পায়: ‘লং লিভ রেভলিউশন’ নামে প্রীতিলতার মৃত্যু-পূর্ববর্তী বয়ান। তাতে যে প্রশ্নগুলো তিনি তুলেছিলেন তার উত্তর আজও মেলেনি। লিখেছিলেন, “আমি ভেবে বিস্মিত হই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী পুরুষের মধ্যে পার্থক্য থাকবে কেন? যদি দেশমাতৃকার জন্য ভাইয়েরা ভাবতে পারে এবং লড়াইয়ে সামিল হতে পারে তবে বোনেরা নয় কেন?”
২৪ সেপ্টেম্বর, আন্দোলনের মাঝেই প্রায় নিঃশব্দে পেরিয়ে গেল প্রীতিলতার ৯২তম মৃত্যুবার্ষিকী। তবে যুগপৎ দেশের পরাধীনতা ও লিঙ্গভিত্তিক অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রীতিলতার এই আপসহীন দ্রোহ, তাঁর নির্ভীক আত্মবলিদানের আদর্শ যে বাঙালিকে আজও উদ্দীপিত করে, তার প্রমাণ তাঁর নামে এই সব স্লোগান। প্রীতিলতার বাংলায় আজও মেয়েদের রক্তপাত ঘটে চলেছে অবিরাম, নির্মম অত্যাচারের ফলে দেশের মাটিতে বইছে নারী-রক্তের স্রোত।
ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়