ছবি: সুব্রত চৌধুরী।
এই মুহূর্তে সামনে রয়েছে এ বছরে প্রকাশিত চারটি বই। দু’টি কবিতার। প্রতিবাদে জয়, কবিতা ২০২২। দু’টি গদ্যগ্রন্থ, আবার রবীন্দ্রনাথ এবং কবিতা: অমৃতা। মেজাজের দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বইগুলি। কিংবা, ভিন্নও নয়, একই মনের বহুবর্ণ সৃষ্টিপ্রবাহ আর আস্বাদনবিন্দু। বারো-চোদ্দো বছর আগে, একটি ধারাবাহিক লিখতেন জয় গোস্বামী। নাম, ‘ফেসবুক’। এক-এক সংখ্যায় এক-একটি মুখ। আশ্চর্য সব জীবন। তাঁর বই চারটি হাতে নিয়ে ভাবি, এখানেও যেন এক-এক রকম আলো পড়ছে লেখকের মুখে। যেন চার রঙের চার নিশান।
সংলাপ গড়ে ওঠে মনে-মনে। ভাবি, ১০ নভেম্বর সপ্ততিতম জন্মদিবসে পা রাখতে চলেছেন এই কবি। ২০২৪ সালে তাঁর কবিতা প্রকাশেরও পঞ্চাশ বছর পূর্তি। কত বিচিত্র আনন্দ, বেদনা, ক্রোধ, সন্তাপ, প্রেম আর দৃষ্টি-প্রদীপে উদ্ভাসিত এই অভিযাত্রা। মানব অস্তিত্বের বিপুল পরিধি, মানুষের মন, আকাঙ্ক্ষা, পরিক্রমা এবং যাপনের খুঁটিনাটি অনুপুঙ্খ থেকে জাদুবলে কবিতাকে নিষ্কাশন করতে পারেন জয়। রবীন্দ্রোত্তর কালে আর কোন কবি এত ধরনের আঙ্গিক-কাঠামোর নিরবচ্ছিন্ন প্রয়োগে নিজেকে পরীক্ষা করতে চেয়েছেন? সনেটের বন্ধন থেকে তাঁর যাত্রা শুরু, তার পর কাঠামো গড়ে-ভেঙে তিনি নতুন নতুন আয়তনে পৌঁছে যেতে চেয়েছেন। ঝুঁকি নিয়েছেন। নিজেকে নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। লেখা বন্ধ রেখেছেন। দ্বিগুণ বেগে ফিরে এসেছেন। আত্মপরীক্ষা থেকে বিচ্যুত হননি। ‘...আমি স্থির নির্দিষ্ট কোনো পথ খুঁজে পাইনি কখনও, কেবলই পথ খুঁজেছি। এখনও খুঁজছি।... কবিতা রচনার কাজ অবিরামভাবে মনকে সম্পাদনা করে চলার কাজ। কবিতা রচনা কেবল ভাষার অনুশীলন নয়, মনেরও অনুশীলন। এমনও হয়, কবিতা লিখতে লিখতে নিজেকেই নিজে চিনতে পারি না। হঠাৎ হঠাৎ বদল চলে আসে। অথচ সেইসব বদলের কোনো পূর্বাভাস অনুভব করা যায় না।...’ (কবিতা সংগ্রহ ৬, ভূমিকা) এই জয় সম্পর্কেই বলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, ‘এ মুহূর্তে দেশের সব থেকে বড়ো কবি’।
প্রতিবাদে জয় দীর্ঘ পরিক্রমার সযত্ন সঙ্কলন। ভূমিকায় জয় জানিয়েছেন ১৯৬৭ সালে দেখা এক ‘ক্রন্দনরত, ভয়ে আকুল, নাকেমুখে রক্ত লাগা রাজমিস্ত্রির মুখ’। মন্দির চত্বরে ওই অসহায়, বিধ্বস্ত মুখটিই তাঁর আজীবন যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার চালিকাশক্তি। টুকরো টুকরো ইতিহাস-ভূগোলের কোলাজ এই বইয়ে ধরা। ইন্দিরা গান্ধী হত্যা, ইরাক যুদ্ধ, নকশালবাড়ি আন্দোলন, জেহানাবাদে কৃষক হত্যা, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিমানহানা, গড়িয়াহাটের ঝুপড়ি উচ্ছেদ, তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারে ছাত্রহত্যা, ইজ়রায়েল প্যালেস্টাইন যুদ্ধ, গুজরাত গণহত্যা, আমদাবাদের দাঙ্গা, কেশপুর গড়বেতার গণহত্যা, নেতাই-নন্দীগ্রামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ২০১২ সালের দিল্লির নির্ভয়া, ২০১৩ সালের কামদুনি, ২০১৪ মধ্যমগ্রামের ধর্ষিতা, ২০২২ সালের বগটুই গ্রামের গণহত্যা, নদিয়ার হাঁসখালিতে ধর্ষণে মৃতা নাবালিকা, বিলকিস বানোর ধর্ষকদের সংবর্ধনা: জয় যেন দু’হাত প্রসারিত করে জড়িয়ে ধরেন, বহমান অপরাধ তথা ক্ষমতার নারকীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্থান-কালের অবিশ্রান্ত পরিচর্যাগুলিকে। ধিক্কারে, ক্রোধে, বেদনায়, হাহাকারে, আত্মদহনে, প্রতিরোধে, ঘৃণায়, এবং আশ্বাসে, তিনি নিজেও অণু থেকে অতিকায় হয়ে ওঠেন। একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘...এ হল শূন্যতার মধ্যে থেকে নিজেকে একটা বিষয়ের পাথরের গায়ে ক্রমাগত ছুড়ে দেওয়া এবং সেই পাথরে আঘাত লেগে বিস্ফোরিত হয়ে যাওয়া। তার থেকে মনের যে টুকরো টুকরো অণু-পরমাণু ছিটকে পড়ছে, তা-ই হচ্ছে কবিতা।’
মনে পড়ে, ১৯৪০ সালের দিনপঞ্জিতে নিজের কবিতা সম্পর্কে লিখেছিলেন ব্রেখট, ‘এ সব কবিতাই পতন বা অবক্ষয়ের ভাষ্য, সমাজের পতনের ছবি একেবারে নিচুতলা থেকে ধরে রাখা হয়েছে। এই কবিতার সৌন্দর্য ধ্বংসময়তার উপর ভিত্তি করে রচিত...।’ দেশবিদেশের বহু মহাকবির নিরিখেই, ঘটমান মুহূর্ত থেকে জাত প্রতিরোধের তথা আন্দোলনের কবিতা রহস্যহীন, বিবৃতিমূলক এবং প্রত্যক্ষ। সঙ্কেতহীন। সরাসরি। বাংলা কবিতা বা বিশ্বকবিতার এটাই মূলগত দস্তুর। অথচ জয় অকুতোভয়। তিনি ঘটমান বর্তমান থেকে বিপুল সব ব্যঞ্জনা, অনতিক্রম্য সব ইশারাকে চাঁদমারি করেন। ক্রমাগত বিবিধ কাব্যসংরূপে, ছন্দ পরীক্ষায়, ছন্দ মিশ্রণে, অন্ত্যানুপ্রাসের নানা কিসিমের প্রয়োগে, পঙ্ক্তি বিন্যাসের দীর্ঘ গ্রন্থ সজ্জায়, সেস্টিনা-সনেট-সনেটকল্প-অক্টেভ-ত্রিপদী-গর্ব ভাঙচুরে, ছন্দঝঙ্কারে, গদ্যস্পন্দে, নতুন নতুন পথ খনন করেন। দুবলা-হাঘরে-শীর্ণ-নিঃসম্বল ক্ষমতাহীনের পক্ষ থেকে কবি ক্রমে প্রত্যয়ে অতিকায় হয়ে ওঠেন। ঘটনা থেকে আবহমানে পৌঁছন: ‘ভেদ নেই, কোনও ভেদ নেই/ সমস্ত দেশে ঘাতকধর্ম এক’ কিংবা ‘সব সীমান্তরেখায় দ্যাখো একটি বন্দি শুইয়ে রাখা/ মাথার দিকটা জন্মভিটেয়, পা দু’খানি উদ্বাস্তু...,’ অথবা কবেকার দুর্বৃত্তায়নের কবলে ধর্ষিতাকে নিয়ে তাঁর লেখা আজ, এই সদ্যপ্রহরে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে— ‘আলো, মৃত।/ দীপ/ হাহাকার।/ মেয়ের ছবির সামনে মা বসে আছেন/ মা? কার মা? কার? নির্ভয়ার? অপরাজিতার?’
ক্ষমতা ক্রমে স্তাবক আর মাতব্বরের হাতে কলুষিত হতে হতে পচনে পৌঁছয়। ফলে এক মুহূর্তের প্রাজ্ঞবচনে বা আর্ষকথন অন্য কালে অন্য দেশে অন্য প্রেক্ষিতেও কার্যকর থাকে। কবিদৃষ্টির এই তীক্ষ্ণতাই ক্ষমতাকে বিদ্ধ করে। অন্ত্যানুপ্রাসের একটা পরীক্ষার কথা বলি এই প্রসঙ্গে। ‘উট চলেছে মুখটি তুলে— উট। কী বলছে সে? Gujrat riot broke out...’। এই যে উট/ আউট বিন্যাস, এ তো নতুন এক স্ফুলিঙ্গ!
জয় আসলে যে ধরনের অস্তিত্ব তোলপাড় করা আর্তনাদ-বিলাপ-রোষাগ্নি-আশঙ্কা-প্রেম বা স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন সঙ্গম-বিরহ ধরেন, সেখানে সবই যেন থরথর করে সমবেত কম্পনে স্নায়ু থেকে স্নায়ুতে সংবহনে যায়। কোনটা প্রতিবাদ, কোনটা প্রেম, কোনটা কাম কোনটা প্রণাম কোনটা অতিপ্রাকৃত কোনটা পরাবাস্তব কোনটা সঙ্গীত কোনটা রক্ততঞ্চন, এ সব তুচ্ছ হয়ে যায়। একের পর এক দীর্ঘ কবিতায় তিনি অত্যাশ্চর্য সব মুভমেন্ট আনেন, আঙ্গিক দলামচা করে অগ্নিভবলয়ে ছুড়ে দেন। ফর্ম থেকে কনটেন্ট, নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যাপৃত এই কবি প্রায় প্রতিটি মান্য কাব্য আঙ্গিককে ধরতে চান।
আরও থেকে যায় তাঁর উপন্যাস গল্প আখ্যানের বিশিষ্ট দুনিয়া। আত্মসত্তাকে বুঝতে চায় সুড়ঙ্গ আর প্রতিরক্ষার নানা কিসিম, যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল তাদের মনোরম উপাখ্যান। পুরো লেখালিখি দিয়ে সামগ্রিকতায় জয় সামনে আনেন এক অনাদি অতলান্ত ভুবন, ব্যক্তিগত স্নায়ুবিন্দু, অর্থাৎ অতিসূক্ষ্মতা থেকে অপরিসীমের বিস্তার: ‘মুঠোয় তোলো সুপার নোভা বিস্ফোরণ নিয়ে/ ছড়িয়ে দাও ছড়িয়ে দাও শত প্রকার বিকিরণের কণা!’
এই কবি সমানে পূর্বজ থেকে সমকালীন কবিতায় খোঁজেন নবধারাজল। তরুণ, এমনকি সদ্য লিখতে আসা কবির কবিতা থেকে উদ্গত দীপ্যমান অভিব্যক্তিকেও পরখ করেন। জীবনানন্দ, সুভাষ, শঙ্খ, শক্তি, সুনীল থেকে পরবর্তী কালে বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার, ভাস্কর থেকে তাঁর সমকালীন অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের কবিতার তিনি মর্মসন্ধানী পাঠক। অজস্র তরুণ কবির কবিতা তিনি এত যত্নে পড়েন, ছুঁয়ে দেখেন নিরন্তর! তিন খণ্ড গোঁসাইবাগান, অনলাইনে লেখা ‘কবিতার সঙ্গে বসবাস’, তরুণ কবির কবিতা আস্বাদনে নিমগ্ন। তাঁর রানাঘাট লোকাল বহু তীর্থ ছুঁয়ে অনন্ত আর আশ্রম পাশে রেখে পাড়া ক্রিকেট ক্রিকেট-পাড়া ঘুরে গানের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত। সঙ্গীতের উপলব্ধিকে তিনি মহাবিশ্বলোকের ইশারায় আত্মস্থ করেন। ‘এই তো তোমার আলোকধেনু’ গানটি সাতরঙে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তাঁর কবিতায়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জয়ের সংলাপ গানে-কবিতায়: যেন কবি এবং পাঠক উভয়েরই মনের অনুশীলন।
এখনও জয় গোস্বামীর যাপন নিতান্ত সাদামাঠা, বৈভব বা বিলাসচিহ্নহীন। মার্জারবৃন্দের খুনসুটি দস্যিপনা, চায়ের ধূমায়িত পেয়ালার সঙ্গে চিন্তার ফুলকি, কথাস্রোত, শিল্পসাহিত্যজীবন মন্থন। কবিতার সঙ্গে গণিত, মহাবিশ্ব, সঙ্গীত, থিয়েটার, চিত্রকলার ছায়াচরাচর। প্রতিটি মুহূর্ত বাঁচেন তিনি কবিতার জন্য, কবিতার সঙ্গে, কবিতার সন্ধানে। কবিতা লিখতে না পেরে কখনও বেদনাদীর্ণ, কখনও আত্মধিক্কারে মলিন, কখনও উষ্ণতায় সংরক্ত, কখনও নতুন কাব্য ভাবনায় উদ্দীপিত, কখনও কবিতাপাঠে আলোড়িত। জয় জানেন, ঝিনুক-মুক্তোর সঙ্গে মাঝে মাঝে ধরা পড়ে ব্যর্থতাও। মনে করিয়ে দেন, সুনীল গাওস্করের ৩৪টি টেস্ট সেঞ্চুরির পাশে শূন্য বা দশ-পনেরো রানের ইনিংসগুলোর সংখ্যা। কখনও সমালোচকের তোলা প্রসঙ্গকে কবিতায় নিয়ে এসে কবির নিয়তি নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও করেন। আবার, অন্য দিকে, আতঙ্কিত থাকেন সর্বদা, পুনরাবৃত্তির ফাঁদে পা দেওয়া নিয়ে। এতটাই যে, পাঠক হিসাবে মনে হয়, বাংলা ভাষার অধিকাংশ কবির পরিণতি দেখে, রেশ থাকতে থাকতে, কিংবা পাঠকের প্রত্যাশাপূরণের তোয়াক্কা না করেই তিনি ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেন।
২০২৪ সালে তিনি জানিয়েছেন, আপাতত স্থগিত রইল তাঁর রচনা প্রকাশ। তবে, ‘অনুশীলন’ চলবে। এ কি অভিমান, প্রত্যাখ্যান, অজ্ঞাতবাস, গুপ্তসাধনা? না কি ক্ষোভ? মনে হয়, এই অতন্দ্র কবির প্রতি বাঙালি তার দায়িত্ব পালন করেছে তো?
বহু দিন আগে জয় গোস্বামী লিখেছিলেন একটি পঙ্ক্তি, যাকে আজ তাঁর দিকেই ঘুরিয়ে দিতে চাইছি: ‘তুমি গ্রহণ করো হাত পেতে এক প্রৌঢ়ের অল্পবয়স, গ্রহণ করো তার গোপন তারুণ্য,... গ্রামগ্রামান্ত ডুবিয়ে তোমার দিকেই দৌড়ে যাবে তুমি তাকে ভাল-না-বাসা পর্যন্ত।’